আমি হরি
কিশোরদার লেখা “রাজনৈতিক হিপোক্রেসি, ঐক্য ও আমার কিছু কথা” শীর্ষক ফেসবুক নোটটি পড়েছি৷
তার প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, তিনি মহা হিপোক্র্যাট দীপায়ন খীসার সাথে যেভাবে
তাল, লয় ও সুর মিলিয়েছেন তাতে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক৷
এটা বলা কি অত্যুক্তি হবে যে, ফ্যাসিস্ট সন্তু লারমার পক্ষে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে
ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে সক্ষম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো হরি কিশোরদার
মতো মানুষদের মধ্যে তার (সন্তু লারমার) সাপোর্ট বেস থাকা? স্বৈরাচারী এরশাদ ৯ বছর
ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন, কারণ শাহ মোয়াজ্জেম ও কাজী জাফরদের মতো ভ্রষ্টরা ছাড়াও
বহু বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক ও টিভি উপস্থাপক (যেমন রেজাউর রহমান) তাকে নানা
সুবিধার বিনিময়ে সমর্থন যুগিয়েছিল৷
হরি
কিশোরদা হয়তো তার "প্রিয় নেতা" সন্তু লারমাকে ফ্যাসিস্ট বললে মনোকষ্ট
পেতে পারেন, কিন্তু তাতে আমার কিছু করার নেই৷ আমি তার ফ্যাসিস্ট নীতি ও আচরণের
পক্ষে অকাট্য তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো৷ তাই বলে আমি বা ইউপিডিএফ
সন্তু লারমাকে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অবজ্ঞা করছি মনে করা ভুল হবে৷ আমরা পার্বত্য
চট্টগ্রামের আন্দোলনে তার ইতিবাচক ভূমিকার কথা অকপটে স্বীকার করি, কিন্তু সাথে
সাথে এটাও আমরা বলতে দ্বিধা করি না যে, তার বহু গুরুতর রাজনৈতিক ভুল রয়েছে, যার
মাসুল অতীতে জুম্ম জনগণকে দিতে হয়েছে এবং এখনো দিতে হচ্ছে৷ সে সম্পর্কে বিস্তারিত
আলোচনার অবকাশ এখানে নেই৷ তবে আমি এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা তাকে এবং পাঠকদের স্মরণ
করিয়ে দিতে চাই৷ আর তা হলো, চুক্তির আগে সন্তু লারমা যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে সশস্ত্র
সংগ্রামে রত ছিলেন, তখন বর্তমান ইউপিডিএফ নেতারাই সন্তু লারমা ও জেএসএস-কে
নানাভাবে সমর্থন করেছিলেন৷ অপরদিকে হরি কিশোর দা, সে সময় জেএসএস-এর তীব্র বিরোধিতা
এবং সেনা-সৃষ্ট তখনকার গণধিকৃত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ানের পক্ষ হয়ে কাজ
করেছিলেন৷ এ সম্পর্কে আরও অনেক বলার ছিল৷ কলেবর বৃদ্ধি হবে বলে তা ভবিষ্যতের জন্য
জমা রাখলাম৷
যাই হোক,
আমি হরি কিশোরদার উপরোক্ত লেখার প্রেক্ষিতে যে কয়টি কথা বলতে চাই তার প্রথমটি হলো
এই, ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) এর মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব বিরোধ মীমাংসায় তিনি
নিজেকে এক বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছেন৷ তিনি অবশ্যই সমাধানের জন্য সুপারিশ
করতে পারেন৷ সে অধিকার তার রয়েছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কেমন বিচারকের ভূমিকা
নিয়েছেন? তিনি কি আদৌ নিরপেক্ষ? তিনি কি উভয় পক্ষের সকল যুক্তি, তথ্য, নীতি,
কৌশল ও কার্যকলাপ সামগ্রিকভাবে ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে তার রায়
প্রদান করেছেন? দুঃখিত, অন্ততঃ তার লেখা পড়ে আমার তা মনে হয়নি৷ কারণ তিনি
ইউপিডিএফ-এর চুক্তির যৌক্তিক সমালোচনা ও বিরোধিতাকে গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা
হিসেবে না দেখে বরং তাকে "অপরাধ" হিসেবে দেখেছেন ও তার জন্য ক্ষমা চাইতে
বলেছেন৷ অপরদিকে সন্তু লারমার অনুগতরা সারেন্ডারের পর পরই একের পর এক যে খুনের উত্সবে
মেতে উঠেছিল তার জন্য সন্তু লারমাকে ক্ষমা চাইতে বলা দূরের কথা, তিনি সে সব জঘন্য
হত্যাকাণ্ডের কথা বেমালুম চেপে গেছেন৷ তাছাড়া, পর পর তিন বার সমঝোতা হওয়ার পরও
সন্তু গ্রুপ যে সে সব সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করেছিলেন তার জন্যও তিনি ক্ষমা চাওয়ার
কথা বলেননি৷ এটা কি ন্যায় বিচার? এটা কোন ধরনের নিরপেক্ষতা ও সাধুতা?
ভুলের
জন্য দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাইতে ইউপিডিএফ-এর পক্ষ থেকে আপত্তি থাকার কথা নয়৷
জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করা ও ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি ইউপিডিএফ চর্চা করে থাকে৷
কিন্তু যে ভুল ইউপিডিএফ করেনি সেই ভুলের জন্য তাকে দায়ী বা অপরাধী সাব্যস্ত করে
ক্ষমা চাইতে বলার মানে কী? কার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এসবের অবতারণা?
হরি
কিশোরদা আরো লিখেছেন: "সে সময়ের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে ইউপিডিএফের চুক্তি
বাস্তবায়ন চাওয়া আর ঐক্যের ডাক দেওয়াকে অনেকে রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টির চেষ্টা বলতে
মনে করলে তাকে কি দোষ দেওয়া যাবে৷" ইউপিডিএফ-এর "চুক্তি বাস্তবায়ন চাওয়া
ও ঐক্যের ডাক দেওয়াকে" তিনি কেন বাঁকা চোখে দেখছেন তা বোঝা মুশকিল৷ চুক্তি
বাস্তবায়ন ইউপিডিএফ-এর নিজস্ব কর্মসূচী নয়৷ একমাত্র হানাহানি ও রক্তপাত বন্ধের
উদ্দেশ্যেই ইউপিডিএফ এত বড় ছাড় দিয়েছে৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, দুনিয়ায় আর কয়টা পার্টি
উদারভাবে এ ধরনের ছাড় দিতে পারে? ইউপিডিএফ-এর এই ছাড়ের প্রেক্ষিতে জেএসএস কি আজ
পর্যন্ত কোন ছাড় দিয়েছে? উত্তর হলো: A BIG NO.
অথচ তারপরও ইউপিডিএফ হরি কিশোরদার কাছে ভালো হতে পারলো না৷ জেএসএস সন্তু গ্রুপের
কাছে তো নয়ই৷ জাতীয় স্বার্থে ইউপিডিএফ-এর এই যে ছাড় -- তার জন্য ইউপিডিএফ-কে
ধন্যবাদ দেয়ার পরিবর্তে তিনি বিভ্রান্তি সৃষ্টিরই চেষ্টা করছেন৷ তা না হলে তিনি
উপরোক্ত মন্তব্য করতে পারতেন না৷
আর
রাজনৈতিক ইস্যু বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন তাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়৷
"চুক্তি বাস্তবায়ন চাওয়া ও ঐক্যের ডাক দেওয়া" অবশ্যই একটি রাজনৈতিক
ইস্যু৷ এটা কোন অরাজনৈতিক, পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত ইস্যু নয়৷ তিনি কি
"রাজনৈতিক ইস্যু" বলতে political gimmick বা stunt বোঝাতে চেয়েছেন? সেটা যদি হয়, তাহলে বলবো এটা
হবে তার একটা মনগড়া ধারণা৷ স্ট্যান্টবাজি কিনা আপনি পরখ না করে বলতে পারবেন না৷ আর
পরখ করার একটাই মাত্র উপায়, আর তা হলো সংঘাত বন্ধ করা ও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য
আন্দোলনে যাওয়া, যা একমাত্র সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস-ই করতে পারে৷
হরি
কিশোরদা সন্তু লারমার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেছেন৷ সন্তু লারমার বুদ্ধিমত্তা
সম্পর্কে আমারও কোন সন্দেহ নেই৷ তার মাথায় ঘিলু না থাকলে কী তিনি এত লোককে
বিভ্রান্ত করতে ও এতকাল ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে পারতেন? কিন্তু তারপরও আমি
বুঝতে পারি না, যে নেতা "প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে এসে মুল বিষয়টা ধরে
ফেলেন, সবার চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন"(যা দুইঘন্টা, তিনঘন্টা অর্ধশত
থেকে শতাধিক বা তারও বেশি মানুষ আলোচনা-তর্ক করে ধরতে পারে না), তিনি কেন চুক্তির
শুভঙ্করের ফাঁকি তখন ধরতে পারেন নি? কেন-ই বা অলিখিত চুক্তি করে বসেছিলেন? আর
কেন-ই বা বর্তমানে জনগণের এত বড় ঐক্যের আকাঙ্ক্ষাকে "ধরতে" পারছেন না?
তাইতো প্রশ্ন, গণ আকাঙ্ক্ষাকে ধরতে পারা কি কেবল বুদ্ধিমত্তার বিষয়? নাকি এর সাথে
অন্য ব্যাপারও জড়িত আছে? আসলে মানুষ যখন স্বার্থান্ধ হয়ে যায় তখন তারা অনেক কিছু
দেখতে পায় না বা দেখেও না দেখার ভাণ করে৷ আমার তো মনে হয়, সন্তু লারমা আঞ্চলিক
পরিষদের গদি হারানোর ভয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করেন না৷ আমি চাই আমার এই
অনুমান মিথ্যা হোক৷ কিন্তু যতদিন সন্তু লারমা বাগাড়ম্বর ছেড়ে চুক্তি বাস্তবায়নের
জন্য প্রকৃত আন্দোলনে যাচ্ছেন না, ততদিন এই অনুমান সত্য হিসেবেই ধরে নিতে হবে৷
যেভাবে নতুন তথ্য প্রমাণ হাজির না করা পর্যন্ত একটি বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত বা
অনুমানকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়৷
মোট কথা,
ইউপিডিএফ-এর ঐক্যের প্রস্তাব ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের
আহ্বানকে হিপোক্র্যাসি বলে প্রতিপাদন করার চেষ্টা চরম অন্যায়৷ এর মাধ্যমে সন্তু
লারমার ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানির যে নীতি ও কার্যক্রম তাকে প্রত্যভাবে উত্সাহিত করা
হয়৷ আশা করি, হরি কিশোরদা বিষয়টি আরো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখবেন৷ শেষে ঐক্যের
গণআকাঙ্ক্ষা বলবতী ও ফলবতী হোক সেই কামনা করছি৷