![]() |
মাইকেল চাকমা |
ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমাকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় বাহিনী/সংস্থাগুলোর টার্গেট
করার কারণ কি জানেন? ওই যে হাসিনার আমলে গুম, খুনের চলমান বিচার। কারণ, মাইকেল চাকমা
গুমের শিকার হয়ে ৫ বছর ৪ মাস “আয়নাঘর” নামক কুখ্যাত গোপন বন্দিশালায় আটক ছিলেন। চব্বিশের
গণঅভ্যুত্থানের পর তাকে সেই বন্দিশালা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তির পর এ গু/মের ঘটনায়
মাইকেল চাকমা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন।
এই গুম, খুনে কারা জড়িত ইতোমধ্যে তা মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক
অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে।
মাইকেল চাকমা গুম-খুনে জড়িতদের বিচার ও শাস্তি চান এবং দেশ থেকে এই গুমের সংস্কৃতি পুরোপুরি বন্ধ করতে চান। সে লক্ষ্যে তিনি দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় তার দাবি-দাওয়া তুলে ধরে আসছেন। সেজন্য তারা মাইকেল চাকমার কণ্ঠরোধ করে রাখতে চাচ্ছেন এবং বহু পুরোনো মামলায় চুপিসারে বাদী ও সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে আদালতের মাধ্যমে তাকে ৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এই গুম, খুনের বিচারকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে সম্প্রতি গুইমারায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও তাদের পোষ্য সেটলার কর্তৃক পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ করে বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হযেছে। কিন্তু এ ঘটনাকে তারা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করছে। নিজেদের দোষ আড়াল করতে তারা ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করছে, বিচ্ছিন্নতাবাদের তকমা দেওয়া হচ্ছে। আর সে ঘটনাকে কেন্দ্র করেও প্রধান টার্গেটে পরিণত করা হয়েছে মাইকেল চাকমাকে।
অথচ ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী সবাই বলছেন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটলাররা হামলাটি সংঘটিত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোও তার সাক্ষী।
মূলত রাষ্ট্র এবং তার বাহিনী-সংস্থাগুলো নানা চক্রান্ত করে পাহাড়ের পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে এবং পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ২০১৫ সাল থেকে অগণতান্ত্রিক ১১ দফা নির্দেশনা জারির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশীদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। সরকারের অনুমতি ছাড়া বিদেশী নাগরিকরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে পারেন না। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলেও তারা সেখানকার নাগরিকদের সাথে স্বাচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন না, তাদেরকে সবসময় সরকাারি সংস্থার লোকজন নজরদারিতে রাখে। অথচ উল্টো পাহাড়িদেরকে দোষারোপ করা হয় তারা নাকি বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে।
সত্যি বলতে কী, পাহাড়িরা কখনো বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি এবং বিচ্ছিন্ন হতেও চায় না। তারা চায় বাংলাদেশের সংবিধানে জাতিগত পরিচয় ও অধিকারের স্বীকৃতি। তারা বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরবর্তী থেকে বার বার বাংলাদেশের সংবিধানে তাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে।
গত আওয়ামী সরকার ২০১১ সালে জুন মাসে যখন পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করে তখনও পাহাড়িরা জাতিগত পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অধিকারের দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে দাবি দাওয়া পেশ করেছিল।
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের নিকটও ইউপিডিএফ তার সুনির্দিষ্ট দাবিদাওয়া তুলে ধরেছে এবং এই দাবিনামার ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ইউপিডিএফের সাথে বৈঠকও করেছে। বৈঠকে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে মাইকেল চাকমা প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
কিন্তু পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা ও উগ্রবাদীদের চাপের মুখে ভয়ে সরকার তাও বাতিল করে দিয়েছে। এরপর পাহাড় থেকে আর কোন প্রতিনিধিকে তাতে রাখা হয়নি।
তাহলে দোষ কেন পাহাড়িদের বা ইউপিডিএফের ওপর বর্তাবে? জাতিগত পরিচয় ও অধিকারের কথা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবি করা কীভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদ হয়?
সম্প্রতি তৃতীয় মাত্রা নামক একটি অনুষ্ঠান নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবিরও একই প্রশ্ন তুলেছেন।
মোট কথা, রাষ্ট্র ও তার বাহিনী-সংস্থাগুলো চায় না পাহাড়িরা নিজেদের আত্মপরিচয় ও অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক। যার কারণে তারা পাহাড়িদের ওপর নিপীড়ন জরি রাখে, মাইকেল চাকমার মতো পাহাড়ি নেতাদের গুম করে, খুন করে, মিথ্যা মামলা দিয়ে বছরের পর বছর কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে, প্রহসনমূলক বিচার করে কারাদণ্ড দেয়, পাহাড়িদের জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয় না, নিজ ভূমি থেকে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করতে চায়।
রাষ্ট্রের এই পাহাড়ি বিদ্বেষী নীতি যতক্ষণ পরিবর্তন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত এই রাষ্ট্র দেশের জাতিসত্তার জনগণকে স্বীকৃতি দেবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত পাহাড়ি জনগণের ওপর নিপীড়নের স্টিম রোলার থামানো হবে না, ততক্ষণ বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটি কখনো একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারবে না। বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতিই এই সত্যটি বলে দিচ্ছে।
মাইকেল চাকমার কন্ঠ রুদ্ধ করে দিতে ও তার ওপর নতুন করে নিপীড়ন-নির্যাতন চালাতে যেভাবে আদালতকে চাপ প্রয়োগ করে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। তার ওপর যদি নতুন করে আর কোন অন্যায় করা হয় তাহলে এর জন্য সকল দায়-দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে।
নিরন চাকমা
১০.১০.২০২৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন