- নিরন চাকমা
আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্ণ করেছে বাঙলাদেশ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই পার্বত্য চট্টগ্রাম নতুন করে নিপীড়নের শিকলে বন্দি হয়। পাকিস্তানিদের কবল থেকে এদেশের জনগণ মুক্তি লাভ করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ নতুন সংকটে পতিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে পাহাড়িসহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোকে অস্বীকার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া, শেখ মুজিবুর রহমানের পাহাড়িদেরকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার নির্দেশনা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েনের ফলে পাহাড়ি জনগণকে এক নিপীড়নের যাঁতাকলের মুখে ফেলে দেওয়া হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠির এই বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক আচরণের ফলে পাহাড়িরা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদে দাঁড়িয়ে পাহাড়িসহ এদেশের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের স্বার্থে কথাবার্তা বললেও তার কথা অগ্রাহ্য করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা দেয় আন্দোলন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং এ দলটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সশস্ত্র সংগ্রাম।
এর ফলে সংকট আরো বেশি ঘনীভূত হয়। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠি সামরিকভাবে আন্দোলন দমনের পথ বেছে নেয়। পাহাড়ে ব্যাপক সামরিকায়ন করা হয়। পুনর্বাসন করা হয় চার লক্ষাধিক বাঙালিকে। পাহাড়িদের ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের কায়দায় চালানো হয় অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতন।
স্বাধীনতার পরবর্তী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় আকারের ডজনের অধিক গণহত্যা চালানো হয়েছে। সংঘটিত করা হয়েছে বহু সংখ্যক সাম্প্রদায়িক হামলা। দেশে ক্ষমতার নানা পালাবদল ঘটলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠির দমননীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। ফলে সেখানে এখনো নিপীড়ন-নির্যাতন চলমান রয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে চুক্তিকে মুলা হিসেবে ঝুলিয়ে রেখে পাহাড়িদের মধ্যে ‘ভাগ করে শাসন কর’ কূটকৌশল প্রয়োগ করে শাসকগোষ্ঠি দমন-পীড়ন জারি রেখেছে।
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার টানা সাড়ে পনেরো বছরের শাসনের পতন ও নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসননীতির কোন বদল হয়নি। ড. ইউনূস সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দেড় মাস অতিক্রম না হতেই ২০২৪ সালের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন স্থানে (দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটি) সংঘটিত করা হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা। এতে চার পাহাড়িকে হত্যাসহ পাহাড়িদের অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। এরপর চলতি বছর গত ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদর ও ২৮ সেপ্টেম্বর গুইমারায় রামেসু বাজারে চালানো হয় আরো এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা। গুইমারায় সেনাবাহিনী নির্বিচার গুলি চালিয়ে হত্যা করে তিন পাহাড়ি যুবককে। সেনাদের গুলি ও সেটলারদের হামলায় গুরুতর জখম হয় নারীসহ আরো অনেকে। অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পাহাড়িদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি।
বর্তমানে সেনা অভিযানের নামে প্রতিনিয়ত চালানো হচ্ছে নিপীড়ন-নির্যাতন, হয়রানি। রাত-বিরাতে সেনা সদস্যরা সাধারণ পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে তল্লাশি-হয়রানি, লুটপাট, অন্যায় ধরপাকড়, নির্যাতন চালাচ্ছে। এতে পাহাড়ি জনগণ চরম এক অনিরাপদ অবস্থায় দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫৪ বছর ধরে চলা এই নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য প্রয়োজন শাসকগোষ্ঠির মানসিকতার পরিবর্তন। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন জারি রেখে দমন-পীড়ন চালিয়ে বাংলাদেশ কখনো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমানে বাংলাদেশে যে সংকট চলছে তা থেকে এটা আরো বেশি স্পষ্ট হয়েছে।
কাজেই, সংকট উত্তরণের জন্য আগামীতে বাংলাদেশে যে দল ক্ষমতায় আসবে সে দলসহ দেশের শাসকগোষ্ঠিভুক্ত সকল দলকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
১৬.১২.২০২৫
.jpg)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন