বুধবার, ২ মার্চ, ২০১১

ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা

[“ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা” শিরোনামে ২০ জুন ২০০৩ সালে ইউপিডিএফ-এর মুখপত্র স্বাধিকার বুলেটিনে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে এবং এত বছরেও দুই পার্টির মধ্যে কেন ঐক্য সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি তা বোঝার সুবিধার্থে নোট আকারে উক্ত নিবন্ধটির মূল অংশগুলো হুবহু প্রকাশ করা হলো।]

 ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা
 দেশে বিদেশে অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষ ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যেকার বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসার উদ্যোগ নিয়েছেন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার একগুঁয়েমির কারণে তাদের মহত্‍ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়৷ নিম্নে সংক্ষেপে তৃতীয় পরে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা তুলে ধরা হলো-
 ১. ১৯৯৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল পানছড়ির লতিবানে সন্তু লারমার লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা প্রদীপ লাল ও কুসুম প্রিয় চাকমাকে প্রকাশ্য দিবালোকে মধ্যযুগীয় কায়দায় খুন করে৷ এ ঘটনায় খাগড়াছড়ি বাসী মর্মাহত ও বিমূঢ় হয়ে যান৷ ১০ এপ্রিল খাগড়াছড়ির গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মহাজন পাড়াস্থ সূর্যশিখা কাবে এক সভার আয়োজন করেন৷ সেখানে উক্ত খুনের তীব্র নিন্দা জানানো হয়৷ তারা এ ধরনের সহিংসতা বন্ধে কি করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা করেন৷ আলোচনা শেষে উপেন্দ্র লাল চাকমাকে আহবায়ক করে একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয় ও এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, পাহাড়িদের তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (তখনো ইউপিডিএফ গঠন হয়নি) ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির ল্যে এই কমিটি শীঘ্রই উদ্যোগ গ্রহণ করবে৷ মিটিঙে দুই পরে মধ্যে মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব উপেন্দ্র লাল চাকমাকে দেয়া হয়৷ এরপর সমঝোতা প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উপেন্দ্র লাল সন্তু লারমার সাথে সাক্ষাত করেন এবং তিন সংগঠনের সাথে আলোচনায় বসার জন্য তাকে অনুরোধ করেন৷ কিন্তু সন্তু লারমা সরাসরি আলোচনার প্রস্তাব নাখোশ করে দেন৷ ফলে দুই পরে মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার প্রথম প্রচেষ্টা শুরুতেই ব্যর্থ হয়ে যায়৷
 ২. এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে UNPO (Unrepresented Nations and Peoples Organisation) এর একজন সম্মানীত প্রতিনিধি ঢাকায় আসেন৷ তিনি দুই পার্টির মধ্যে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেন৷ তিন সংগঠন তার এই উদ্যোগকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায় এবং তাকে জানিয়ে দেয় যে, তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ যে কোন সময় জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসতে রাজী আছেন৷ তিনি একই প্রস্তাব সেই সময় ঢাকায় অবস্থানরত জেএসএস-এর দুই শীর্ষ স্থানীয় নেতার কাছেও পেশ করেন৷ জেএসএস নেতৃবৃন্দ তাকে জানান যে, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ও আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়ার আগে তাদেরকে তাদের নেতা সন্তু লারমার সাথে আলোচনা করতে হবে৷
 ইউএনপিও প্রতিনিধি আগষ্ট মাসে আবার ঢাকায় আসেন এবং রাঙ্গামাটি গিয়ে সরাসরি সন্তু লারমার সাথে দেখা করেন৷ তিনি সে সময় সন্তু লারমার কাছ থেকে ইতিপূর্বে দেয়া তার প্রস্তাবের জবাব জানতে চান৷ ইউএনপিও প্রতিনিধি সন্তু লারমার সাথে তার কি আলাপ হয়েছে সে সম্পর্কে তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে অবগত করেন৷ তিনি জানান জেএসএস নেতৃবৃন্দ তিন সংগঠনের সাথে আলোচনায় বসতে রাজী হয়েছেন৷ এমনকি তাদের আলোচনায় এটাও ঠিক হয় যে, জেএসএস এর পক্ষে গৌতম কুমার চাকমা দুই সপ্তাহের মধ্যে তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করবেন৷ ইউএনপিও প্রতিনিধি তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে আরো জানান, এমনকি জেএসএস নেতৃবৃন্দ এটাও প্রস্তাব করেন যে জেএসএস এর পক্ষে অনুষ্ঠিতব্য আলোচনায় অংশ নেবেন গৌতম কুমার চাকমা এবং তারা দাবি করেন তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে যেন রবিশংকর চাকমা প্রতিনিধিত্ব করেন৷
 তিন সংগঠন জনসংহতি সমিতির উক্ত প্রস্তাবে রাজী রয়েছে বলে ইউএনপিও প্রতিনিধিকে জানিয়ে দেয়া হয়৷ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জেএসএস নেতৃবৃন্দ তাদের কথার বরখেলাপ করেন এবং শেষ পর্যন্ত গৌতম কুমার চাকমা কিংবা জেএসএস-এর পক্ষে অন্য কেউ তিন সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন৷
 এরপর ১৯৯৯ সালের মে মাসে ইউএনপিও-র উক্ত প্রতিনিধি তৃতীয় বার ঢাকা সফরে আসেন৷ তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাকে জেএসএস-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ না হওয়ার কথা অবগত করেন এবং এ ব্যাপারে তার পরামর্শ কামনা করেন৷ জেএসএস নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার পর তিনি তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে জানান, যোগাযোগ না করার কারণ হিসেবে জেএসএস নেতৃবৃন্দ তাকে বলেছেন যে ১০ই নভেম্বর মাইসছড়িতে জেএসএস সদস্যদের ওপর হামলা হওয়ার কারণে তারা তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেননি৷ জেএসএস এর ঐ সদস্যরা লারমার মৃত্যুবার্ষিকী পালন শেষে খাগড়াছড়ি থেকে ফিরছিল৷
 জনসংহতি সমিতির উক্ত বক্তব্য মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়৷ ঐ দিন কি ঘটেছে বা এর জন্য কারা দায়ি সে প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, তিন সংগঠনের সাথে আলোচনা শুরু করার জন্য গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক যোগাযোগ না করার কারণ হিসেবে ঐ ঘটনা অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক৷ কারণ উক্ত ইউএনপিও প্রতিনিধি ও জেএসএস নেতা সন্তু লারমার মধ্যে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সে অনুসারে ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তিন সংগঠনের সাথে তাদের যোগাযোগ করার কথা ছিল৷ অন্যদিকে, ঐ ঘটনাটি ঘটেছে ১৯৯৮ সালের ১০ই নভেম্বর৷ সুতরাং তিন সংগঠনের সাথে যোগাযোগ না করার কারণ হিসেবে জেএসএস নেতৃবৃন্দ যা বলেছেন তা এক জলন্ত মিথ্যাচার৷ এটা জেএসএস নেতৃবৃন্দের জঘন্য কপটতা ও শঠতাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়৷
 ৩. ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হংসধ্বজ চাকমা ও অনন্ত বিহারী খীসা ঢাকায় আসেন "অধিকার" কর্তৃক আয়োজিত একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য৷ তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই সুযোগকে কাজে লাগান এবং তাদের সাথে জেএসএস-তিন সংগঠনের দ্বন্দ্ব ও সম্ভাব্য আলোচনা সম্পর্কে আলোচনা করেন৷ এ সময় একজন প্রতিষ্ঠিত জুম্ম ব্যবসায়ীও উপস্থিত ছিলেন৷ তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন ও জেএসএস-এর সাথে যে কোন সময় আলোচনায় বসতে রাজী আছেন বলে জানিয়ে দেন৷ তারদর সাথে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে,  হংসধ্বজ চাকমা ঢাকা থেকে ফিরে সন্তু লারমার সাথে দেখা করবেন এবং তিন সংগঠনের সাথে বৈঠকে বসতে সন্তু লারমাকে রাজী করাতে চেষ্টা চালাবেন৷ তাছাড়া এটাও সিদ্ধান্ত হয় যে তিনি সন্তু লারমার সাথে তার কি আলোচনা হয়েছে তা অনন্ত বিহারী খীসার মাধ্যমে তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করবেন৷ কিন্তু সন্তু লারমার সাথে তার কি আলোচনা হয়েছে সে সম্পর্কে তিন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আজ পর্যন্ত কিছুই জানতে পারেনি৷
 ৪. ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়িতে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে জেলা পর্যায়ে ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ এই মিটিঙের কিছুদিন আগে ৭ ফেব্রুয়ারী জেএসএস-এর সশস্ত্র সদস্যরা দিঘীনালায় ইউপিডিএফ-এর একজন সম্ভাবনাময় কর্মি দেবোত্তম চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে৷ তা সত্ত্বেও জুম্ম জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে ইউপিডিএফ জেলা পর্যায়ে হলেও জেএসএস-এর সাথে আলোচনায় বসতে রাজী হয়৷ এই বৈঠকে হানাহানি বন্ধে তিন দফা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়৷
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো যদিও উক্ত বৈঠকটি ছিল আনুষ্ঠানিক ও দুই পার্টির পক্ষ হয়ে বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধগণ কর্তৃক চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়, তথাপি জেএসএস-এর সশস্ত্র সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় খোলাখুলিভাবে ঘোষণা দেয় যে তারা এই চুক্তি মানবে না৷ এমনকি কলকাতা থেকে ফিরে এসে সন্তু লারমাও জানিয়ে দেন যে তিনি এই চুক্তি মানবেন না৷ এভাবে জেএসএস নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বাক্ষরিত চুক্তিকে প্রথম থেকে অস্বীকার করে বসেন ও চুক্তির প্রতি কোনরূপ শ্রদ্ধা দেখাতে ব্যর্থ হন৷ শেষ পর্যন্ত জেএসএস-এর সশস্ত্র সদস্যরা ইউপিডিএফ-এর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে উক্ত চুক্তিকে পদদলিত করে৷ তারা ২০০০ সালের ৮ মার্চ পানছড়িতে তারা কুমার চাকমা ও সুইমং মারমাকে গুলি করে হত্যা করে৷ এভাবে জেলা পর্যায়ে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দুই পার্টির মধ্যে যে শান্তি ও ঐক্যের প্রক্রিয়া শুরু হয় তা জেএসএস-এর সশস্ত্র সদস্যরা বন্দুকের নল দিয়ে নস্যাত করে দেয়।
 ৫. ২০০০ সালের আগষ্ট মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ খাগড়াছড়ি থেকে উপেন্দ্র লাল চাকমা, অনন্ত বিহারী খীসা, নবীন কুমার ত্রিপুরা ও মংক্যসিং চৌধুরী; রাঙ্গামাটি থেকে গৌতম দেওয়ান, মথুরা লাল চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা ও হিমাংশু চাকমা এবং বান্দরবান থেকে জুমলিয়ান বম ও ক্য চ প্রু মারমা সহ আরো অনেকে এই মিটিঙে উপস্থিত ছিলেন৷ ইউপিডিএফ-এর পক্ষ থেকে তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং ইউপিডিএফ জেএসএস-এর সাথে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে রাজী রয়েছে বলে তাদেরকে জানান৷ তিনি তাদের মাধ্যমে জেএসএস-এর প্রতি নতুন করে আলোচনার প্রস্তাব দেন।
 তিন জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ বলেন তারা জেএসএস নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করবেন এবং তারা ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন।
৬. ২০০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তৃতীয় পরে মধ্যস্থতায় দুই পার্টির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ মধ্যস্থতাকারীদের অনেক চেষ্টার পরও জনগণের চাপের ফলে জেএসএস নেতৃবৃন্দ ইউপিডিএফ এর সাথে এই বৈঠকে বসতে বাধ্য হন৷ তবে আলোচনায় তাদেরকে আন্তরিক দেখা যায়নি৷ জেএসএস প্রতিনিধরা জানান আলোচনার পর দুই পার্টির মধ্যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তারা লিখিতভাবে কোন চুক্তি করতে পারবেন না৷ অন্যদিকে ইউপিডিএফ-এর প্রতিনিধিরা চুক্তি লিখিত হতে হবে বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন৷ বৈঠকে উপস্থিত মধ্যস্থতাকারীগনও ইউপিডিএফ-এর সাথে এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন এবং বলেন সরকারের সাথে জেএসএস-এর যে মৌখিক চুক্তি হয়েছে তার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনগণকে খেসারত দিতে হচ্ছে৷ তাছাড়া চুক্তি লিখিত না হয়ে মৌখিক হলে পরে তা নানাভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে এবং এর ফলে দুই পার্টির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি ও নতুনভাবে দুরত্ব তৈরি হতে পারে৷ বৈঠকে ইউপিডিএফ দুই পার্টির মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতার ল্যে লিখিতভাবে তিন দফা প্রস্তাব দেয়৷ এগুলো হলো :
১.অচিরেই ইউপিডিএফ এবং জনগণের ওপর আক্রমণ বন্ধ করা
২. সরকারের বিরুদ্ধে নু্যনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা
৩. ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের লক্ষ্যে ইউপিডিএফ ও জেএসএস-সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের সমন্বয়ে 'জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট' গড়ে তোলা।
 জেএসএস নেতৃবৃন্দ এখনো পর্যন্ত ইউপিডিএফ এর উক্ত প্রস্তাব সম্পর্কে তাদের মতামত জানায়নি৷ দুই পার্টির মধ্যে কি ধরনের ঐক্য হবে সে ব্যাপারেও উক্ত বৈঠকে আলোচনা হয়৷ ইউপিডিএফ এর পক্ষ থেকে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়৷ এক. দুই পার্টি  কর্তৃক যৌথ কর্মসূচী গ্রহণ  এবং তা বাস্তবায়নের জন্য যৌথ তত্‍পরতা৷ দুই. একে অপরের কর্মসূচীতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে যুগপত্‍ কর্মসূচী গ্রহণ৷ তিন. চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে জেএসএস নিজে কর্মসূচী গ্রহণ করবে এবং ইউপিডিএফ সে কর্মসূচীতে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে৷ এই শর্তে যে, জেএসএস ইউপিডিএফ এর ওপর তাদের আক্রমণ বন্ধ করবে।
 এই তিন বিকল্প প্রস্তাবের যে কোন একটি জেএসএস তাদের সুবিধা অনুসারে গ্রহণ করতে পারবে বলে ইউপিডিএফ এর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়৷ কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো এতেও জেএসএস কোন ইতিবাচক সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়৷ এখানে বলে রাখা দরকার, ইউপিডিএফ চুক্তিতে জনগণের মৌলিক দাবিগুলোর কোনটি পূরণ করা হয়নি বলে সমালোচনা করে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণের মধ্যে ঐক্য ও আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে ইউপিডিএফ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জেএসএস কে সহযোগিতা দিতে সম্মত হয়৷ কারণ ইউপিডিএফ দুই পক্ষের মধ্যে হানাহানি ও সংঘাত হোক তা অতীতেও যেমন চায়নি, এখনও চায় না৷ ঐক্য ও সমঝোতার স্বার্থে এটা ইউপিডিএফ এর পক্ষ থেকে একটি বড় ধরনের ছাড়।
কিন্তু যে পার্টি সরকারের সাথে চুক্তি করে আন্দোলনকে বন্ধক দিয়েছে ও সরকারের নিকৃষ্ট দালালে পরিণত হয়েছে তাদের কাছে ঐক্য ও সমঝোতা বড় কথা নয়৷ জনগণের স্বার্থ তাদের কাছে অর্থহীন৷ এমনকি চুক্তি বাস্তবায়নও আর তাদের আসল উদ্দেশ্য নয়৷ সেজন্য এত বড় রকমের ছাড় দেয়ার পরও তারা ইউপিডিএফ এর সাথে ঐক্য করতে এগিয়ে আসেনি৷ অথচ চুক্তি বাস্তবায়নে ইউপিডিএফ সহযোগিতা করবে এ কথা শুনলে জেএসএস নেতৃবৃন্দের খুশী হওয়ারই কথা। কারণ তারা হারহামেশা চুক্তি বাস্তবায়নে জনগণের সহযোগিতা কামনা করে থাকেন৷ তাই জেএসএস নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতার অভাবের কারণে মিটিং কোন চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়।
এই বৈঠকের পরপরই জেএসএস তাদের পুরোনো কর্মসূচীতে ফিরে যায়৷ অর্থাত্‍ নতুন করে ইউপিডিএফ ও জনগণের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ শুরু করে৷ এমনকি বৈঠকের একদিন আগে(২২ সেপ্টেম্বর) জেএসএস এর সশস্ত্র সদস্যরা বরকল থেকে শ্রমণ অবস্থায় ইউপিডিএফ এর দুই সদস্যকে অপহরণ করে খুন করে।
৭. সেপ্টেম্বরের ঐ মিটিঙের পর জেএসএস নেতৃবৃন্দের অসম্মতির কারণে দুই পার্টির মধ্যে নতুন করে আর বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি৷ ইউপিডিএফ জেএসএসকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায়৷ দেশ বিদেশের কিছু ব্যক্তি বিশেষও সমঝোতার উদ্যোগ নেন৷ কিন্তু জেএসএস এর আত্মম্ভরিতা ও একগুয়েমির কারণে তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়৷
ক. ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণের জন্য ইউপিডিএফ এর এক শীর্ষ নেতা জেনেভায় যান৷ সে সময় জেএসএস এর এক প্রতিনিধিও সেখানে ছিলেন৷ এ সময় জুম্ম জনগণের শুভকাঙ্খীদের উদ্যোগে ও উপস্থিতিতে ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ জুম্ম জনগণের শুভাকাঙ্খীরা অর্থবহ আলোচনার মাধ্যমে দুই পার্টিকে ঐক্য সমঝোতায় উপনীত হওয়ার আহ্বান জানান৷ ইউপিডিএফ এর প্রতিনিধি ঐ মিটিঙে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন যে ইউপিডিএফ জেএসএস এর সাথে আলোচনায় বসতে ও ঐক্য স্থাপনে সবসময় প্রস্তুত৷ তিনি এও জানিয়ে দেন যে, এমনকি " এই মুহুর্তে জেনেভাতেও জেএসএস এর সাথে সমঝোতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরে ইউপিডিএফ রাজী রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ইউপিডিএফ প্রতিনিধিকে তার পার্টির  পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷" অপরদিকে, আলোচনা ও সমঝোতা প্রশ্নে জেএসএস প্রতিনিধি সুনির্দিষ্টভাবে কোন কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন৷
ইউপিডিএফ এর উক্ত প্রতিনিধি জেনেভায় থাকাকালে একজন শুভাকাঙ্খী দুই পার্টির মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন৷ ইউপিডিএফ খুশী হয়ে তার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং তাকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানায়৷ কিন্তু দৃশ্যতঃ জেএসএস এর পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় তার ঢাকা সফর অনুষ্ঠিত হয়নি এবং তার মধ্যস্থতার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়৷
খ. অন্য একটি মধ্যস্থতার প্রস্তাব আসে মিজোরাম সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী ও মিজোরাম বিধান সভার Congress Legislature Party এর ডেপুটি লিডার নিরুপম চাকমার কাছ থেকে৷ তিনি ২০০১ সালের ২৭ জুন ইউপিডিএফ ও জেএসএস প্রধানের কাছে এক লিখিত চিঠিতে এই প্রস্তাব দেন৷ ইউপিডিএফ ৪ জুলাই ২০০১ তার এই প্রস্তাব গ্রহণ করে উত্তর দেয়৷ তিনি জেএসএস এর কাছ থেকে কি ধরনের উত্তর পেয়েছেন বা আদৌ পেয়েছেন কিনা তা ইউপিডিএফ জানতে পারেনি৷ তবে তার এই প্রচেষ্টাও আর এগোয়নি৷
গ. ২০০১ সালের ১লা নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সামাজিক উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটি নামে খাগড়াছড়ির একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার করা হয়৷ কমিটি ইউপিডিএফ ও জেএসএস এই দুই পার্টিকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা ও সমঝোতায় উপনীত হতে আহ্বান জানায়৷ ইউপিডিএফ এক চিঠির মাধ্যমে তাদের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায় এবং জানায় যে ইউপিডিএফ আলোচনার মাধ্যমে জেএসএস এর সাথে একটি আপোষ নিষ্পত্তিতে উপনীত হতে রাজী রয়েছে৷
ঘ. এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্মীয় গুরুরাও বিভিন্ন সময় দুই পার্টির মধ্যে সংঘাত বন্ধ করে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন।
শেষ কথা : পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ চায় দুই পার্টির মধ্যে সংঘাত ও হানাহানি বন্ধ হোক ও তাদের মধ্যে ঐক্য-সমঝোতা হোক। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত পবিত্র। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার একগুঁয়েমী ও ফ্যাসিবাদী মানসিকতার কারণে আজ পর্যন্ত জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে দুই পার্টির মধ্যে হানাহানি ও সংঘাত বন্ধ করা যায়নি। এই সত্য আজ দিবালোকের মতো সবার কাছে পরিষ্কার। জনগণের মনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে: চুক্তি বাস্তবায়ন যদি জেএসএস এর কর্মসূচী হয় এবং সন্তু লারমা যদি আন্তরিকভাবে তার নিজের স্বাক্ষর করা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আন্তরিক হন, তাহলে সেই চুক্তি বাস্তবায়নে ইউপিডিএফ এর সহযোগিতার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন কি কারণে এবং কেন উল্টো তিনি ইউপিডিএফ-কে নির্মুলের জন্য কংগ্রসে কর্মসূচী গ্রহণ করেন ও তা বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে ওঠেন? জেএসএস এর এই গণআকাঙ্ক্ষা-বিরোধী কর্মকান্ডের কি কারণ থাকতে পারে এবং জেএসএস এর পক্ষ থেকে এর যুক্তি ও ব্যাখ্যা কি?
আসল কথা হলো ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যেকার এই দ্বন্দ্ব হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন ও পুরাতনের মদ্যে দ্বন্দ্ব, প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব। আদর্শবাদীতা ও আদর্শহীনতার মধ্যে দ্বন্দ্ব। জনগণের পক্ষের শক্তি ও জনগণের বিপক্ষ শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব। আন্দোলনের পক্ষের শক্তি ও আন্দোলন বিরোধী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব। ইউপিডিএফ এই দ্বন্দ্বের প্রথমোক্তটির প্রতিনিধিত্ব করে। অপরদিকে জেএসএস প্রতিনিধিত্ব করে শেষোক্তটির।

সূত্র : স্বাধিকার,  বুলেটিন নং-২৪, প্রকাশকাল :জুন ২০০৩।