আজ ১২ জুন
কল্পনা চাকমা অপহরণের ১৭ বছর পূর্ণ হল। ১৯৯৬ সালের এই দিনে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার
নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়িতে কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার লে. ফেরদৌস
কর্তৃক কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছিলো। কিন্তু রাষ্ট্র তথা সরকার আজো কল্পনা চাকমার
কোন হদিস দিতে পারেনি।
কল্পনা
ছিলো রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক প্রতিবাদী কন্ঠ। ভয়-ভীতি, হুমকী, প্রলোভন
দেখিয়ে নিপীড়ক সেনা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি তাকে কখনই জব্দ করতে সক্ষম হয়নি। স্বভাবতই
কল্পনা ছিলো কায়েমী স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির নিকট আতঙ্কের কারণ। তার সাথে
রাজনৈতিক যুক্তি-বিশ্লেষণ ও অন্য কোন কিছুতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে, সেনা
কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রটি এক ঘৃণ্য ন্যাক্কারজনক পন্থা অবলম্বন করে। সম্পূর্ণ
নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত অবস্থায়, কল্পনা নিজ বাড়ীতে লে. ফেরদৌসের নেতৃত্বে
নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য দ্বারা অত্যন্ত কাপুরুষোচিতভাবে অপহরণের শিকার হয়।
কল্পনা
চাকমা যখন অপহৃত হয় তখন দেশে ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জাতীয় সংসদ
নির্বাচনের মতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাত্র ৭ ঘন্টা আগেই সে অপহরণের শিকার। কল্পনা
চাকমার মতো একজন নারীকে নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
অপহৃত
কল্পনাকে উদ্ধার, তদন্ত
রিপোর্ট প্রকাশ এবং চিহ্নিত অপহরণকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার দাবিতে সে
সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ঢাকা ও
চট্টগ্রামের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে
গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। দেশের বাইরেও কল্পনা অপহরণ ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার
সৃষ্টি করে। বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে চিঠি দেয়।
অপরদিকে,
অপরাধ ধামাচাপা দিতে দেশের গোটা সেনাবাহিনী তৎপর হয়ে উঠে। সামরিক হেলিকপ্টারে রাঙ্গামাটি সহ
বেশ কিছু এলাকায় কল্পনা চাকমার সন্ধান চেয়ে লিফলেট বিলি, সন্ধান দাতার
জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা, সেনা সদরের আইএসপিআর থেকে বিবৃতি প্রকাশ, সাইনবোর্ড
সর্বস্ব একটি মানবাধিকার সংস্থাকে দিয়ে ত্রিপুরার গন্ডাছড়া গ্রামে কল্পনা চাকমার
সন্ধান লাভ এবং সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ, খোদ তৎকালীন সেনা প্রধান লেঃ জেনারেল মাহবুব কর্তৃক
ঘটনাকে “হৃদয়ঘটিত” বলে মিথ্যা বিবৃতি দান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম সদস্য প্রফেসর
ইউনুস কর্তৃক সেনা প্রধানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিবৃতিদান... ইত্যাদির মাধ্যমে
ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আজো এ চক্রটি কল্পনা চাকমাকে নিয়ে এ ধরনের
মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
তারপরও
দেশ-বিদেশের ব্যাপক জনমত ও আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার ঘটনা তদন্তে ১৯৯৬ সালের ৭
সেপ্টেম্বর বিচারপতি আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করতে
বাধ্য হয়। কিন্তু এ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজো প্রকাশ করা হয়নি।
এরপর ২০১০
সালের ২১ মে বাঘাইছড়ি থানার এস আই ফারুক আহম্মদ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।
এতে তিনি কল্পনা চাকমার সন্ধান পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে মামলাটি বাতিল করার আবেদন
জানান। এর বিরুদ্ধে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা না-রাজি আবেদন জানান।
বিচারক
সিআইডির মাধ্যমে পুনর্বার তদন্তের নির্দেশ দিলে সিআইডি কর্মকর্তা মোঃ শহীদুল্লাহ
২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করেন। কিন্তু উক্ত তদন্ত
রিপোর্টেও প্রকৃত দোষীদের নাম উল্লেখ করা হয়নি বরং উক্ত তদন্ত রিপোর্টে
বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে কল্পনা অপহরনের সাথে জড়িতদের রক্ষার চেষ্টা করা হয়।
সর্বশেষ
সিআইডির দাখিল করা এ রিপোর্টের উপর দু’দফা শুনানী শেষে এ বছর অর্থাত ২০১৩ সালের ১৬
জানুয়ারী রাঙামাটি মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত আবারো পুলিশ সুপারকে দিয়ে তদন্তের
নির্দেশ দিয়েছে। যা কোনভাবেই গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না।
হিল
উইমেন্স ফেডারেশন সহ বিভিন্ন সংগঠন আদালতের এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করে কল্পনা চাকমা
অপহরণ ঘটনার সঠিক তথ্য অনুসন্ধানের জন্য নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন ও
চিহ্নিত অপহরণকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে। কিন্তু
সরকার এখনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেনি।
কল্পনা
অপহরণের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এমনকি দেশের বাইরেও এত বিক্ষোভ
আন্দোলন, রূপনের মতো স্কুল ছাত্রের আত্মবলিদান, সমর-সুকেশ ও মনোতোষের গুম
হওয়া এবং এত লেখালেখি, এত প্রতিবাদ, নিন্দার ঝড় সত্ত্বেও রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত
কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মূলত এ
রাষ্ট্র, সরকার এবং এ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী, নিরাপত্তা ব্যবস্থা--
দেশের সংখ্যালঘু জাতি, সমাজের প্রান্তিক-দুর্বল-অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠি
এবং নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরে থাক, উল্টো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড়
হুমকী হয়ে দাঁড়ায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় সংঘটিত এ
যাবতকালের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে এর প্রমাণ মেলে।
সরকার তথা
রাষ্ট্রের অনীহার কারণেই আজ ১৭ বছরেও কল্পনা চাকমার কোন সন্ধান মিলেনি। এখন প্রশ্ন
হচ্ছে, কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে এ দেশের সরকারের এত লুকোচুরি, এত অনীহা কেন?
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ও দেশবাসীর কাছে সরকারকে এর যথাযথ জবাব দিতেই হবে।