রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৩

প্রসিত দা’র যে চিঠি আমাকে উজ্জ্বীবিত করে

২০০৪ সালের ২৫ মে। প্রায় দুই মাস চিকিসা শেষে সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। তখন মানসিক ও শারিরীকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কারণ আমার যে একটি পা কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। তখনও এক পায়ে ভর দিয়ে ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারি না। সহযোদ্ধা বন্ধুদের সাহায্য নিয়েই সব কাজ ছাড়তে হতো। ঠিক এই সময়েই প্রসিত দা’র চিঠি হাতে পেলাম। যে চিঠি আমাকে অনেক উজ্জ্বীবিত করে। সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়। জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিজেকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে উসাহিত করে।

প্রসিত দা’র লেখা সেই চিঠির মূল অংশটি এখানে তুলে ধরছি:

...পার্টি ও আন্দোলনে অবদান রাখার মতো তোমার যে একাগ্রতা, উদ্যম আর গুণাবলী আছে, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। পার্টির সম্ভাবনাময়ী তরুণ নেতৃত্বের সাড়িতে তুমিও একজন বলে আমরা বিবেচনা করি। নতুন যুগের লড়াই সংগ্রামের সাথে তুমি এখন আরো বেশী ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গেছো।

মনে রাখবে, মানুষের সাহস, উদ্যম, একাগ্রতা আর কঠিন সংকল্পের কাছে কোন বাধাই বাধা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের’এর কথা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে। একজন সেক্টর কমান্ডার হয়েও তিনি নিজে সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমে সৈনিকদের পরিচালনা করেছেন। যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের বোমার আঘাতে তার ডান পা উড়ে গেছে। ডান পা হারিয়েও কর্ণেল তাহের ছিলেন অদম্য মনোবলের অধিকারী। সৈনিকদের মাঝে ছিলেন একজন প্রিয় কমান্ডার। মুক্তি বাহিনীতে এবং পরবর্তী কালে দেশ স্বাধীন হলে, সেনাবাহিনী পুর্ণগঠনের ক্ষেত্রে তার অনেক অবদান রয়েছে। কমান্ডার হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। অফিসে বসেই সৈনিকদের পরিচালনা করেছেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট উন্নত করার পেছনে তার অবদান রয়েছে। ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব তিনিই সংঘটিত করেছেন। এক জন সুদক্ষ কমান্ডার হিসেবে কর্ণেল তাহের'এর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও সাধারণ মানুষের মতো সুস্থ ছিলেন না। ছোটবেলায় তার পোলিও হয়েছিলো। সে কারণে তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। রোগা হয়েও তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সৈনিকদের উজ্জীবিত করার জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে তাকে হুইল চেয়ারে করে নৌ বাহিনীর জাহাজে নেয়া হয়েছিলো।

মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ সেনাপতি তৈমুর লঙ'এর পাও ছিলো খোঁড়া। তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। অথচ এই তৈমুর লঙ গোটা মধ্য এশিয়া দাবড়ে বেড়িয়েছেন। তার নাম শুনলে সে যুগে প্রতিপক্ষ সৈন্যদের বুক কাঁপতো।

প্যালেষ্টাইনের হিজবুলস্নাদের নেতা মোহাম্মদ ইয়াসিনও একজন পঙ্গু। তিনি উঠতে বসতে অক্ষম। হুইল চেয়ারে করে তাকে চলতে ফিরতে হয়। অথচ এই ইয়াসিন প্যালেষ্টাইনে এক জঙ্গী আন্দোলনের নেতা।

পৃথিবীতে এ ধরনের আরো বহু জ্ঞানী-গুণী বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন, যারা শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়েও দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা সংঘটিত করেছেন। আসলে মানুষের প্রতিভা থাকলে তার বিকাশ ঘটবেই।...

প্রসিত দা’র এই চিঠি থেকেই আমি ফিরে পেয়েছি জীবনের সঞ্জীবনী শক্তি। তাঁর এই চিঠি আমার নতুন জীবনের (এক পায়ে চলা জীবন) চলার পথে পাথেয় হয়েই থাকবে।




সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৩

সরকারের চাপিয়ে দেয়া বাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন

আজ ৩০ জুন সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাসের ২ বছর। ২০১১ সালের এ দিন আওয়ামী লীগ সরকার গায়ের জোরে জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের সকল সংখ্যালঘু জাতিসমূহের উপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়। উক্ত সংশোধনীতে ৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” অর্থা এদেশে বাঙালি ছাড়া আর কোন জাতির অস্তিত্ব নেই বলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে ঘোষণা করা হয়।

আজকের এ দিনটি ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং উজ্জ্বলতম দিনও। আজ “সান্তাল হুল” দিবস। যা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামে অধিক পরিচিত।  ১৮৫৫ সালের এদিন  সান্তাল সম্প্রদায়ের চার ভাই সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরোর নেতৃত্বে সান্তাল জনগোষ্ঠি সহ স্থানীয় জনতা এক গণসমাবেশ থেকে সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অস ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সান্তাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।

সান্তালরা ইংরেজ বাহিনীর বন্দুক ও কামানের বিপরীতে তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। এ যুদ্ধে সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরো সহ অনেক সান্তাল যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বৃটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

যেদিন জাতীয় সংসদে এই বিতর্কিত পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী আইন পাস করা হচ্ছিলো সেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ভোটে নির্বাচিত তিন এমপি কোন প্রতিবাদ না করে বিলের পক্ষে (বাঙালি জাতীয়তার পক্ষে) টেবিল চাপড়িয়ে ভোট প্রদান করে পাহাড়ি জনগণের সাথে চরমভাবে বেঈমানী করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণকে অতীতেও বাঙালি বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর ক্ষমতার দম্ভে মদমত্ত শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশকে একক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাহাড়ি জনগণকে বাঙালি হয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সংবিধানে তাদেরকে বাঙালি বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু সেদিনও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ শেখ মুজিব ও উগ্রবাঙালি জাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া বাঙালি জাতীয়তা মেনে নেয়নি।

ক্ষমতার জোরে, বলপ্রয়োগ করে অনেক কিছু করা যায়; কিন্তু এক জাতিকে অন্য একটি ভিন্ন জাতিতে রূপান্তরিত করা যায় না। পার্বত্য  চট্টগ্রামে সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খিয়াং, চাক, খুমী, লুসাই, পাংখো, সাঁওতাল, গুর্খা-অহোমী জাতির জনগণ কখনো নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেবে না। আওয়ামী সরকারের বাঙালি বানানোর এই ঘৃণ্য অপচেষ্টাকে রুখতেই হবে।

ইউপিডিএফ এই বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাসের পরপরই বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।  পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। জেলা ও থানা সদরে বিক্ষোভ সহ তিন পার্বত্য জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে। গত বছর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।

এই সরকারের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু সরকার এখনো এই বিতর্কিত সংশোধনী প্রত্যাহার না করে সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তা বহাল রেখেছে।  তাই এই সংশোধনী বাতিল করে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের নিজ নিজ জাতীয় পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে আমাদের তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে আমাদের সরকারের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে হবে।

তাই আসুন সরকারের চাপিয়ে দেয়া বাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলি:

সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল কর, করতে হবে
আমরা বাঙালি নই, আমাদের নিজস্ব জাতীয়তার স্বীকৃতি দাও, দিতে হবে
পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা কর, করতে হবে
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা-সেটলার প্রত্যাহার কর, করতে হবে
পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি আইনের স্বীকৃতি দাও, দিতে হবে