বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা নতুন জীবনের স্বপ্ন

মানুষ মরণশীল এটা চিরন্তন সত্য। সময় হলে যে কাউকে সে পথে ধাবিত হতেই হবে। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু অনাকাঙ্খিত ও অস্বাভাবিক। এই মৃত্যু নামক জিনিসটিকে কেউ সহজে মেনে নিতে চায় না। তবুও তাকে আঁকড়ে ধরেই জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

আমি এই মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছিলাম। যদিও মৃত্যুদূতটি আমার খুব কাছ দিয়েই চলে গিয়েছিল। সেই মুত্যুদূতটি আর কেউ নয়, সন্তু লারমারই লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনীর দল।

২০০৪ সালের ২৬ মার্চ। রাঙামাটি সদর উপজেলার কুদুকছড়ি হেডম্যান পাড়ার একটি বাড়িতে সহযোদ্ধা বন্ধুদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৫টা। হঠা গুলির আওয়াজ হলো। আমরা পালানোর চেষ্টা করলাম। পিছনে পিছনে গুন্ডার দলটি  গুলি করতে করতে আমাদেরকে ধাওয়া করলো।  এ সময় গুন্ডাদের ছোঁড়া একটা গুলি আমার বাম পায়ের ‘রানে” বিদ্ধ হয়। এরপর আমি কোন রকমে একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে সক্ষম হই। দু’তিন মিনিট পরই ২/৩জন গুন্ডাকে আমার একেবারে পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখলাম।  এ সময় তারা বলাবলি করছিলো এদিকেতো একজন চলে গেছে। সে কোথায় গেল...। আমি যত পারি চুপচাপ হয়ে রইলাম। যদি তারা টের পেতো তাহলে নিশ্চিত তারা আমাকে মেরে ফেলতো। ভাগ্যিস তারা আমি যে লুকিয়ে আছি সেটা টের পায়নি। আস্তে আস্তে রাত নেমে এলো।  লোকজনের কোন সাড়া শব্দ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর গুন্ডার দলটি চলে গেছে বলে মনে হলো। তারপরও ভয় হচ্ছিল যদি তারা লুকিয়ে থাকে। এদিকে যতই সময় যাচ্ছে ততই আমার পা ভারী হয়ে উঠছে, যন্ত্রনা করছে, পানির পিপাসা বেড়ে গেছে।  আমাকে সহযোগিতা করবে এমনতো আর কেউ পাশে নেই।  কোন উপায়ন্তর না দেখে  সাহস করে ‘ও মানুষ, ও মানুষ’ করে বড়বড় করে দু’একটি চিকার দিলাম। আমার চিকার শুনে গ্রামের লোকজন সাড়া দিলো। পরে তাঁরা এসে আমাকে ঐ ঝোঁপের ভেতর থেকে উদ্ধার করে প্রথমে একটি বাড়িতে নিয়ে গেলো।  তাঁদের কাছ থেকে আমি পানি খুঁজলে তাঁরা আমাকে পানি খেতে বারণ করলো। পানির পরিবর্তে তাঁরা আমাকে লেবু কেটে রস খেতে দিলো। এরপর তাঁরা আমাকে কুদুকছড়ি বাজারে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিসার ব্যবস্থা করলো। এদিন গুন্ডাদের হামলায় আমি ছাড়াও আরো দু’জন আহত হন। যদিও তাদের আঘাত আমার মতো মারাত্মক ছিল না। এর মধ্যে একজন হলেন সহযোদ্ধা সম্রাট ও অপরজন পলাশ নামে স্থানীয় এক যুবক। পরে সহযোদ্ধারা আমাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানোর  ব্যবস্থা করলেন।

মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৩

পার্টি ও আন্দোলনের সাথে আমি একিভূত

-- নিরন চাকমা 
[ এ লেখাটি ইউপিডিএফ-এর এক যুগপূর্তি সংকলন ‘নব জাগরণ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। অনলাইন পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য এটি এখানে প্রকাশ করলাম।]
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে জনসংহতি সমিতি সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃত্ব শূণ্যতা দেখা দেয়। চারিদিকে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সমাজে ভাঙন দেখা দেয় । এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় নয়া যুগের নয়া পার্টি ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটি ফ্রন্টর্( ইউপিডিএফ)। হাল ধরে সমাজ বিনির্মাণের কাজে এবং কাঁধে তুলে নেয় জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব। এই পার্টি বর্তমানে এক যুগ অতিক্রম করেছে। এই এক যুগ সময় পেরিয়ে আসতে এই পার্টিকে অনেক চড়াই-উরাই পার হতে হয়েছে। অনেক সহযাত্রীকে হারাতে হয়েছে। তারপরও এই পার্টি সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমি এই পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে অধিকারহারা জাতিসত্তাসমূহের মুক্তির সনদ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে শরীক হতে পেরে নিজেকে নিয়ে খুবই গর্ববোধ করি।

পার্টি এবং আন্দোলন কোন সহজ বিষয় নয়। একটা পার্টি তার লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমেই সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ইউপিডিএফ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সফলতার সঙ্গে এক যুগ পার করতে সক্ষম হয়েছে। পার্টির এই এক যুগের সময়ে আমার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে এবং অর্জিত হয়েছে নানা অভিজ্ঞতা।

সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

শিল্প-সাহিত্যে বিশ্বায়নের মুনাফা

[লেখক হরিপদ দত্তের এই লেখাটি ২০০৫ সালের ১১ নভেম্বর  দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়। লেখাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সকলের পড়ার সুবিধার্থে কম্পোজ করে এটি এখানে হুবহু প্রকাশ করলাম।]
গ্লোবালাইজেশন বা ভুবনিকরণ অর্থা বিশ্বায়ন হচ্ছে বিশ্বমানবের সামনে নতুন এক অভিজ্ঞান। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের ভেতর দিয়ে এর চাকায় দুর্বার দানবীয় বেগ সংযুক্ত হয়। এই শক্তি জাতি-রাষ্ট্রের সীমানার অস্তিত্ব যেমনি অস্বীকার করে, তেমনি তার প্রাকৃতিক, মানব এবং মনন সম্পদকেও আপন আগ্রাসী থাবায় লণ্ডভণ্ড করে দেয়। পরিবর্তে চাপিয়ে দেয় সে নতুন নতুন তত্ত্ব। তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বভ্রমণ হচ্ছে এর সহায়ক। তাই আজকের বিশ্বে কেবল অর্থনীতি আর রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে না এই বিশ্বায়ন, সংস্কৃতি তথা শিল্প-সাহিত্যের অভিভাবকত্বও নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের পরিভ্রমণ এবং টিভি, ইন্টারনেট, সাইবার প্রযুক্তির অপ্রতিরুদ্ধ প্রভাব মানবসভ্যতাকে চরম সঙ্কটে ফেলেছে। অবিশ্বাস্য এক জাদুকরী মোহাচ্ছন্নতায় পতিত হয়েছে মানবজাতি। অর্থনীতি এবং রাজনীতির পাশাপাশি সারা বিশ্বের দরিদ্র-অনুন্নত দেশগুলো আজ বিশ্বায়নের নামে পুঁজিবাদের একচেটিয়া প্রায় প্রতিরোধহীন আক্রমণ আর আগ্রাসনে পতিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তাই দরিদ্র-অনুন্নত দেশগুলোর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বলতে গেলে সেই শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে আজ।
বাংলাদেশসহ তৃতীয় দুনিয়ায় অপরাপর দেশে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা আজ আর মনন চর্চার উচ্চস্তরে দাঁড়িয়ে নেই। মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী পুঁজির উপকরণে পরিণত হয়েছে সাহিত্য। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং অভিভাবকত্ব স্বাধীন শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে হাজির হয়েছে। সাহিত্য বা অপরাপর মননচর্চার মাধ্যম শিল্পগুলো পরিণত হয়েছে ব্যবসায়ী পণ্যে। এটা অবিশ্বাস্য বা আশ্চর্য্যরে বিষয় নয় যে, বুদ্ধিবৃত্তি তথা মননশীল চর্চা আজ স্বাধীন থাকতে পেরেছে। ঐতিহাসিক কারণেই ব্যবসায়ী পণ্যে পরিণত হয়েছে সেসব সৃষ্টিশীল কর্মপ্রচেষ্টা।
সাহিত্য সৃষ্টি আর প্রসারের নামে আসে বৈদেশিক অনুদান। থাকে রাষ্ট্রীয় অনুদান। মহ উদ্দেশ্যের আড়ালে এসব অনুদান হচ্ছে মুনাফা সৃষ্টির সহায়ক পুঁজি। এই মুনাফা সৃষ্টি করা হয় বিশেষ শ্রেণীর জন্য। তারা বই প্রকাশ আর বিতরণের নামে চালায় ব্যাপক লুণ্ঠন। জাতির জ্ঞান বৃদ্ধির নামে আজ নানা জাতীয় বইয়ের ¯তূপ জমা হচ্ছে সারা দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গুদাম ঘরে। এসব বইয়ের বিপুল অংশই কার্যত অপাঠ্য রচনা, যা শিক্ষার্থী-পাঠকের কোন কাজেই আসে না। যা কিছু কাজে আসে তা আসলে মগজধোলাই। মনে রাখতে হবে এসব বই পাঠকশ্রেণী পযসা খরচা করে কিনতে বাধ্য নয় বলেই রাষ্ট্রীয় অনুদানের নামে জনগণের অর্থ এভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে। অর্থা পরোক্ষভাবে জনগণকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। পুঁজির পরিভ্রমণই হচ্ছে মুনাফার উদ্দেশ্য। যেখানে মুনাফা সেখানেই পুঁজির আগ্রাসন। অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এমন পণ্যই উপাদন করে যার রয়েছে মুনাফা সংগ্রহের শক্তি।
তাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সর্বদাই মুনাফা অর্জনে সক্ষম পণ্যের পৃষ্টপোষকতা দান করে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের মুনাফা অর্জনকারী বাজার পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশ বড়। তাই বাংলাদেশী মুনাফার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-পণ্য সর্বদা লালায়িত। যে ধরনের সাহিত্যের চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক সে ধরনের সাহিত্য-পণ্যই উপাদিত হয়ে এখানে আসে। মনে রাখতে হবে পণ্য উপাদন, বাজারজাতকরণ, প্রচার এবং ভোক্তার সহায়ক থাকে রাষ্ট্র। তাই একটি ধনবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাহিত্য-পণ্যের সহায়তা দান করা রাষ্ট্রের আদর্শ-কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কিংবা বেসরকারি মিডিয়াগুলো সর্বদা তৈরি থাকে বাজার সৃষ্টির জন্য। লুণ্ঠনের টাকায় তৈরি এসব যন্ত্র পাঠক-ক্রেতার সামনে নানা কৌশলে বাজার সাহিত্যকে তুলে ধরে। পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া যথাযথভাবে এসব দায়িত্ব পালন করে। এভাবে তারা দেশের ভেতর বিরাট ভোক্তাশ্রেণী তৈরি করে। বাণিজ্য মেলার মতো বই মেলার আয়োজন করে তারা মুনাফার জন্য, যদিও স্লোগান দেয়া হয় জাতীয় মহ স্বার্থের, জ্ঞান বিকাশের। বিষয়টা একেবারেই হাস্যকর।
আজকের এই সর্বগ্রাসী বাজার অর্থনীতির বিশ্বব্যবস্থা বিশ্বসাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। করপোরেট বাণিজ্যের মতো সাহিত্য ও মুনাফা সৃষ্টিতে সক্ষম। ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যয়বহুল বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে এবং ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে। বিস্ময়ের ঘটনা এই যে, বড় বড় দেশগুলোতে রাজনীতিবিদ, খেলোয়ার, চিত্রতারকা, বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পণ্য বিজ্ঞাপনে  ভাড়া খাটছে নানা কৌশলে। ‘বেস্ট সেলার’-এর বিভ্রান্তিকর চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। সেক্স স্ক্যান্ডাল, ক্রাইম, থ্রিল, সায়েন্স ফিকশন হচ্ছে মুনাফার পুঁজি। সেই পুঁজির কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছেন বিশ্বের সেরা মানুষেরা। তারাও মুনাফার মডেল হতে দ্বিধা করেন না। মার্কিনিদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান বিল ক্লিনটন পর্যন্ত ‘মাই লাইফ’-এর মোড়কে বই-বাণিজ্যের উপকরণে পরিণত হয়ে যান। আজগুবি কাহিনী ‘হ্যারিপটার’ কিংবা বাঙালির আত্মীয় মনিকা আলীর বা ঝুম্পা লাহিড়ি সেই একই মুনাফার পণ্য। বাঙালি যে কতটা মুর্খ, নির্লজ্জ, কাণ্ডজ্ঞানহীন জাতি তার প্রমাণ ‘ব্রিক লেন’-এর বাংলা সংস্করণের জনপ্রিয়তা। প্রভুদের উন্নত দেশে ক্রীতদাস জাতির ‘মুক্তি ও স্বাধীনতা’র মোড়কে যে যৌন স্বাধীনতা লাভ কিংবা আপন ঐতিহ্য বিসর্জনের দৃষ্টান্ত এই বই, এ কথা কয়জন বোঝে? না হলে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে, ড্রেনে-নর্দমায়, ট্রাফিক সিগন্যাল আর বাসস্ট্যান্ডে মনিকা আলীর চিকার শোনা যাবে কেন? মনিকা আলীর ইংল্যান্ড প্রবাসী বাঙালির অতৃপ্ত যৌনতা পুঁজি হয়ে যায় মুনাফার, নাজনীন আর রাজিয়া নামের মোড়কে। এত বড় গৌরব বাঙালি আর কবে অর্জন করেছে? প্রবাসে বসে নির্লজ্জ চাটুকারিতা আর কাকে বলে?
বুকার বিজয়ী অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্যা গড অব স্মল থিংক্স’-এ কি আছে? বাড়াবাড়ি রকম যৌনাচার আর কেরেলোর প্রথম কমিউনিস্ট সরকার নাম্রুদ্যিপাদের শাসনকালের মিথ্যে কুসা আছে বলেই পুঁজিবাদী বিশ্ব এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করল না কি? একদিকে মুনাফা, অন্যদিকে সাম্যবাদী রাজনীতির বিষেদাগার নয় কি? তাই তারা আছে। মনিকা আলী, অরুন্ধতী, সালমান রুশদীরা আছে দেশে দেশে। ধর্ম-বিদ্বেষের নামে হঠকারিতা করে ওরাই দেশে দেশে মৌলবাদের উত্থানকে উসাহিত করে। ওরা হচ্ছে লুটেরা পুঁজির সাহিত্যিক মুনাফার পণ্য।
আমাদের ভুললে চলবে না যে, সাহিত্য হচ্ছে মানুষের উচ্চতর মননবৃত্তির মহ সৃষ্টি, এটি ভোগের নয়, বিনোদনের নয়। এজন্যই সাহিত্যের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সভ্যতার অগ্রগামিতার একটা নিবিড়তা। পুঁজিবাদী মুনাফাহীন উদ্দেশ্যে সাহিত্যকে যেমনি নামিয়ে এনেছে রূপজীবী বেশ্যার ভূমিকায়, ঠিক তেমনি শোষকশ্রেণীর রাজনীতির হাতিয়ারেও পরিণত করেছে তাকে। এ কথা সত্য যে তরলায়িত রূপজীবী বিনোদন সাহিত্য নির্মাণ যতটা সহজ, ততটাই কঠিন শোষণের বিরোধী হাতিয়ারের মতো সাহিত্য নির্মাণ। বাংলাদেশের শোষিত জনগণের সৌভাগ্য এই যে, উন্নত বিশ্বের মতো শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য নির্মাণের মেধাবী ভাড়াটে লোক আবার এখানে নেই। অনেকে চেষ্টা করেছে, মেধাহীনতার কারণে হতে পারেনি।
বাজারি সাহিত্যকে ক্রেতা বা পাঠকরা ভোগ্যপণ্যের মতোই ব্যবহার করে। পশ্চিমের ইংরেজি কিংবা অপরাপর শক্তিশালী ভাষায় রচিত বাজারি সাহিত্যের দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়ে যায় মাত্র কয়েক সপ্তাহে। এই ভোক্তা শ্রেণীটি কারা? এই শ্রেণীটি তারাই যারা মেধার চর্চা থেকে বহুদূরে অবস্থান করে এবং স্থুল আনন্দের সন্ধানী। বাজারে ভিড় তাদেরই, তাদেরই উদ্দেশ্যে সেসব বই প্রকাশিত হয়। সাহিত্য-পণ্যের কারবারীরা মেধাবী পাঠক খোঁজে না, তারা জানে এই শ্রেণীর পাঠকরা সংখ্যায় ছোট এবং বিপজ্জনক। মুনাফা সৃষ্টির সহায়ক তো নয়ই।
বিশ্বায়নের পুঁজির বাজারে উন্নত এমনকি অনুন্নত দেশে বাজার আর মুনাফার পারিপার্শ্বিকতার কারণেই চমকে ওঠার মতো নারী লেখকের আগমন ঘটে। নারী লেখকরা নারীবাদের নামে যেভাবে নিজেদের শরীরের বর্ণনা দিচ্ছে, নিজেদের বিকৃত কাম-চেতনার প্রকাশ ঘটাচ্ছে বইয়ের পাতায় পাতায়, তাতে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়। অতীতে এই কাজটা করত পুরুষ লেখকরা এবং আপন সৃষ্ট নারী চরিত্রের সঙ্গে অবচেতনে নিজেরাই সম্ভোগে মেতে উঠত। আজ সেই জায়গাটির দখল নিয়েছে নারীরা নিজেরাই। এদের প্রভাবে মাঝে-মধ্যে বাংলা ভাষায় এমন নারীর শরীরী বর্ণনা বা যৌন আবেদনের চিত্র মেলে, মনে হবে ওসব যেন পশ্চিমী কোন সমকামী নারীর অনুভূতি। তাই এটা আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে, পুঁজিবাদ আজ কেবল নারীর শরীর থেকেই মুনাফা সৃষ্টি করে পরিতৃপ্ত নয়, নারীর মনন-মেধাকেও মুনাফার হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বর্ণবাদী ইউরোপ আমেরিকা যেমনি নারীদের নিয়ে নারীবাদ বা নারী স্বাধীনতার নামে সীমানা লঙ্ঘন করেছে, ঠিক তেমনি তাদের উস্কানিতে তৃতীয় বিশ্বেও নারীরা শরীর ও মেধার সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে বিষয়টা না-জেনে-বুঝেই।
মুনাফার ধর্মই হচ্ছে মানুষকে নীতিবিবর্জিত করা, ধর্মান্ধতার পাশাপাশি ভোগবাদী করে তোলা। সামাজিক ভোগবাদী মানুষ হিসেবে লেখকদের বেলায়ও তাই ঘটে। কি লিখলে, কেমন করে লিখলে ক্রেতা মিলবে, বাজারজাতকরণের মাধ্যমে প্রকাশক মিলবে, তাও নির্ধারণ  করে মুনাফা সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ী পুঁজি। ক্রাইম, থ্রিল, যৌনতা, সস্তা প্রেম ইত্যাদি বিষয়গুলো ভোগবাদী বিশ্বের ক্রেতাদের খুবই পছন্দের বিষয়। যেসব বইয়ে এসব আছে সেসব বইয়ের চটকদার বিজ্ঞাপনের দ্বারা ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। প্রশ্নটা মুনাফার, তাই নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই।
ভোক্তাদের জন্য বাজার হচ্ছে দুই ধরনের। একটি স্থানীয়, অন্যটি আন্তর্জাতিক। স্থানীয় বাজারে সাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক বাজারে হচ্ছে ইংরেজি। ইংরেজি না-জানা পাঠকদের জন্য সাহিত্যিক মুনাফাখোরেরা সংগ্রহ করে অনুবাদক। অনুবাদ কর্মটি যথার্থ কি না, বিক্রি বা বিপণন আইনসিদ্ধ কি না, তা দেখার প্রয়োজন পড়ে না। আজকের এই যুগে সাহিত্য-পণ্যের ক্রেতা সংগ্রহের জন্য ভোগ্যপণ্যের বিপণনরীতিকেই কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশ্ব পুঁজির মুনাফাখোরেরা সে উদ্দেশ্যে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়, বড় বড় ফাইভস্টার হোটেলে আয়োজন করে মতবিনিময় সভা, প্রদর্শনী, সমাবেশ ঘটায় সুন্দরীদের, খেলাধুলা, চলচ্চিত্র স্টারদের, খ্যাতিমান, আঞ্চলিক বুদ্ধিজীবীদের। ঠিক তেমনি সাহিত্য ব্যবসায়ীরাও করে থাকে। তাই দেখা যায় প্রতিটি দেশে প্রকাশকরা যার যার ক্ষমতানুসারে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, আমলা, শিল্পপতি, মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদদের সমাবেশ ঘটায় বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। পেছনে থাকে প্রচার যন্ত্র। সেসব দৃশ্য বা বক্তব্য তুলে ধরে পাঠক বা দর্শকের সামনে প্রিন্ট মিডিয়ায়, স্যাটেলাইটে।
এই সাহিত্যের মুনাফাখোর শ্রেণী স লেখকদের চরিত্র হনন করে। তারা বাধ্য করে লেখকদের মিডিয়ার সামনে যেতে। এভাবে লেখকরা প্রতারিত হচ্ছে, পকেট ভারী হচ্ছে প্রকাশকদের। লেখকরা অর্থ বা খ্যাতির মোহে বাধ্য হয় প্রচারের ক্ষেত্রে পা দিতে। কেননা, লেখকরা হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত। বেঁচে থাকার জন্য তাদেরও প্রয়োজন পড়ে অর্থের। একদিকে খ্যাতি, অন্যদিকে অর্থ, এই যে দ্বৈত আকর্ষণ, তাকে অতিক্রম করা খুবই কঠিন। এটা মধ্যবিত্ত লেখকদের শ্রেণীগত ধর্ম। পুঁজির এতটাই শক্তি যে, সেখানে একজন ব্যক্তি লেখক অস্তিত্বের কারণেই সে পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। যারা থাকে আদর্শের নামে অটল তারা মরে ধুঁকে ধুঁকে।
পুঁজিবাদী মুনাফা যে কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা তার সর্বগ্রাসী চরিত্র তা উন্নত ধনী রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি-অর্থনীতির পাশাপাশি মেধা-মনন সৃষ্টির দিকে তাকালেই ধরা পড়ে। মুনাফা সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রব্যবস্থা সাম্যবাদী কিংবা উচ্চতর মানবতাবাদী শিল্প-সাহিত্যকেও সহ্য করে না। সে ধরনের সৃষ্টিকে ধ্বংস করাই তার বড় কাজ। অন্যদিকে পুঁজিবাদী সর্বদাই আতঙ্কিত থাকে সৃষ্টিশীল চিন্তাকে নিয়ে। বর্তমান সমাজতন্ত্র ত্যাগকারী নব্য পুঁজিবাদী রাশিয়া এর প্রমাণ। সেখানকার বর্তমান শাসকশ্রেণী গোর্কি বা তলস্তয়ের সৃষ্টিকে ভয় পায় বলেই সেসব সাহিত্যকর্মকে নির্বাসনে পাঠাতে সচেষ্ট। প্রকৃত অর্থে আজ গোর্কি বা তলস্তয়কে রুশভাষার পরিবর্তে পৃথিবীর অপরাপর ভাষা রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে। নোবেল বিজয়ী পুঁজিবাদের ধারক বিশ্বাসঘাতক রুশ কবি সালঝেনেৎসিনের সৃষ্টি আজ হতে চায় জাতিটির বিবেক। পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র পরিত্যাগকারী রাষ্ট্র্রগুলোর মহান চিরায়ত সাহিত্য-সৃষ্টিরও আজ একই দশা।
মুনাফার রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া আজকের যুগ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর। তবু এই কষ্ট আর নির্লোভ আত্মত্যাগই সভ্যতা এবং মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ আদর্শ। একজন স লেখক চরম দারিদ্র্য বরণ করে এবং অস সমাজের হাত থেকে প্রাপ্তিকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে কঠিন জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মানবসভ্যতার জন্য সৃষ্টি করে যান। অনাগত ইতিহাস তার শিল্পকে রক্ষা করবে, আর সব মিশে যাবে পথের ধুলায়। মুনাফা সৃষ্টিকারী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রগতির পক্ষের এবং প্রতিক্রিয়ার বিপক্ষের বৈরী শিল্পীর প্রতিপক্ষ অবশ্যই। ঘোর শত্র“ও বটে। নানা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে সাহিত্যের জগ থেকে তাদের উখাতের চেষ্টাও চলে। উপমহাদেশ তথা পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ আছে। অন্য যে কোন পণ্য তৈরির উদ্দেশ্যে যে মুনাফা তা সহজেই ধরা যায়। ওসব পণ্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে না। কিন্তু সাহিত্যের ভেতর এমন ছদ্মবেশী সৃষ্টি থাকে যে, মুনাফা এবং রাজনীতিটাও এতটাই জটিল প্রায় অদৃশ্য অবয়বে অবস্থান করে, সাধারণ পাঠক তা ধরতেই পারে না। অনেকটা সংস্কার করা মার্কসবাদের মতো। মনে হবে সাচ্চা মার্কসবাদ, আসলে তা নকল। তো, সেসব ছদ্মবেশী শিল্প ও মুনাফা সৃষ্টিকারী উপকরণ মুনাফা সৃষ্টি করুক, তাতে কারও কারও হয়তো আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু সেসব সাহিত্য যখন শোষিত-বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের সাহিত্য হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে, তখনই তা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। কবিতা, নাটক, গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে এমন সৃষ্টি পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যে সর্বদাই চোখে পড়ে। হঠা মনে হবে ওসব জনগণের সাহিত্য। ওসব যে জনগণের তথা প্রগতির সাহিত্য নয়, এটা পাঠক তখনই শনাক্ত করতে পারবে, যখন দেখতে পাবে ওসবের ভেতর তাদের জীবনের বাস্তবতা ফুটে উঠেছে কিন্তু মুক্তির পথনির্দেশ নেই। বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রতিক্রিয়াশী বলে চিহ্নিত অনেক কবি-লেখকের কোন কোন রচনা প্রচণ্ড প্রগতিশীল বলে পাঠক বারবার ভুল করে ওই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিটা নেই বলেই। তাই কোনটি প্রগতি আর কোনটি প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য তা বুঝতে গেলে অবশ্যই প্রগতির রাজনীতিটা বুঝতে হবে আগে। মুশকিল হল সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের সহজেই চেনা যায়, যায় না কেবল ছদ্মবেশী তথাকথিত প্রগতিবাদীদের। এই ছদ্মবেশীরাও সাহিত্যের মুনাফা সৃষ্টির অন্যতম সহায়ক। ওরা মিশে থাকে উদারবাদী বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের ভেতর কিংবা নকল কমিউনিস্ট পার্টিতে।
কাজেই এটা মনে করার কারণ নেই যে, সাহিত্যের মুনাফা সরাসরি বিপণন-বাজার থেকে সৃষ্টি হয়। মুনাফার সাহিত্যের প্রকৃত মুনাফাটা পুঁজিপতিরা প্রথম সংগ্রহ করে ভাড়াটে কবি-লেখকদের মগজ থেকে। তারপরই প্রশ্ন  আসে বাজারের। এখানে লেখকের মগজ হচ্ছে মুনাফা সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান। সেই উপাদানকে বই পণ্যে রূপান্তরের  জন্য যে পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীরা, তা মুনাফায় রূপান্তরিত হয় বাজারে এসে। তো সাহিত্য-পণ্যের বাজারের বৃহ ক্রেতাগোষ্ঠী হচ্ছে অল্প বা মধ্যম আয়ের মানুষ তথা মধ্যবিত্তরা। বিত্তবানদের বই পড়ার সময় নেই যেমনি, তেমনি নেই জ্ঞানচর্চার। বিনোদনকে তারা সংগ্রহ করে ব্যয়বহুল ভ্রমণ, ক্লাব, নারী, ক্যাসেনো, জুয়া এবং অকল্পনীয় ব্যয়বহুল খাদ্য গ্রহণ করে।
দুর্লভ উপাদেয় খাদ্যও তাদের বিনোদনের অংশ। ওই ক্ষুধাটা যতটা উদরের, তার চেয়ে মনের।
কিন্তু মধ্যবিত্ত? ওই শ্রেণীর হাতে তো পয়সা নেই। তাই সস্তা বিনোদনের জন্য তারা যায় বইয়ের কাছে, সিনেমার কাছে, টিভির কাছে। মধ্যবিত্ত মানবজাতির সবচেয়ে জটিল প্রজাতি। শ্রেণী হিসেবে তারা অলীক অর্থা মিথ্যে স্বপ্নচারী, অসুখী, কল্পনাবিলাসী, দুঃখবিলাসী এবং অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা বহনকারী। মনোবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, সাহিত্যের ভেতর এই মধ্যবিত্ত খুঁজে ফেরে এমন এক কাল্পনিক অবাস্তব সুখ ও শান্তির জগ, যার আড়ালে রয়েছে নিজেরাই। তাই অসুখী, অস্থিরচিত্ত এই শ্রেণীটি হালকা-চটুল-চিন্তা আর মেধাশূন্য সহজপাঠ্য সাহিত্যের ভেতর আনন্দ খোঁজে। বাস্তব জীবনে যাকে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, এমন এক কল্পনার জগতের সন্ধান করে তারা আধুনিক রূপকথা সেই সায়েন্স ফিকশনের ভেতর। সাহিত্যের চিন্তাশীল জটিল নান্দনিকতাকে ভয় পায় ওরা এ কারণেই যে, তাদের সামনে আশা শূন্য, কেবলই হতাশা, মন ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত।
মুনাফার রক্তপিপাসু দানব পুঁজিবাদ মধ্যবিত্তের এই গোপন অসুস্থ মনের খবর রাখে। ওরা আরও জানে মধ্যবিত্তের জীবনে স্বাধীন, নিরুদ্বেগ, প্রশান্তির, পরম পরিতৃপ্তির শৈল্পিক অপার সুন্দর যৌন-জীবনেও নেই। তাই বিকৃত যৌন সাহিত্যকে বাজারজাত করে ওরা মুনাফা সৃষ্টি করে সহজে। এই অন্ধ-বধির-মগজশূন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেরাও জানে না, বোঝে না সাহিত্যের নামে কীভাবে প্রতারিত হচ্ছে তারা। টেরও পায় না কেমন করে পুঁজির মুনাফার যোগানদার সেজে আছে ওরা। জানে না বলেই বিশ্বায়নের এই যুুগে শ্রেণী হিসেবে মধ্যবিত্ত সবচেয়ে সঙ্কটকালে পতিত হয়েছে। তাদের মননশীলতার সমস্ত পথ আজ রুদ্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের প্রচণ্ড ঢেউ বিচূর্ণ করে দিয়েছে তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনকে, চিন্তা-চেতনাকে। শত শত টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট, সাইবার ক্যাফে, পর্নগ্রাফি, পর্ন পত্রপত্রিকা, পর্ন-সাহিত্য দানবের মতো গ্রাস করেছে তাদের। এত যে আয়োজন, এত যে বিচিত্র জীবন তাদের সামনে দুলে উঠত প্রতি মুহুর্তে, তার সবকিছুর আড়ালে রয়েছে মুনাফা, পুঁজির মুনাফা। জন্মান্ধ মধ্যবিত্ত তা দেখাতে পায় না।
বিশ্বায়ন যে কেবল সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের উপাদিত শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক তথা ভাবজগ তৃতীয় বিশ্বে বাজারজাত করছে তা নয়, স্থানীয়ভাবেও এ ধরনের সাহিত্য-সংস্কৃতি উপাদনকে অনুদানে-দানে উসাহিত করছে। বুকার, ম্যাগসেসে পুরস্কার-পরিতোষিক দানের উদ্দেশ্যটা হচ্ছে সে বাজার রক্ষা ও সম্প্রসারণ। পুরস্কারের সঙ্গে জনগণের জ্ঞাতার্থে যে প্রজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তা পাঠ করলে স্তম্ভিত হতে হয়। কাজেই তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি এবং অগ্রগতি সম্ভব তখনই যখন বিশ্বায়নের আগ্রাসনকে প্রতিহত করা যাবে। অন্যদিকে স্বাধীন শিল্প ও সাহিত্য তথা সংস্কৃতি চর্চাও প্রতিরোধের মধ্যেই টিকে থাকবে। সেই প্রতিরোধটা অন্য কিছু নয়, প্রগতিবাদী লেখকদের নির্মোহ থেকে লিখে যাওয়া, ক্রমাগত নব নব সৃষ্টি করা।

লেখক: হরিপদ দত্ত

সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর : ১১ নভেম্বর ২০০৫

রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৩

স্মরণ: আজ শহীদ ভরদাস মুনির ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী

আজ ১৩ই অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরদাস মুনি চাকমার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯২ সালের এই দিনে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলার থানা বাজার এলাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আয়োজিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যোগ দিতে এসে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিদের যৌথ হামলায় তিনি শহীদ হন।

সেদিন যা ঘটেছিল (একজন  প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে সংক্ষেপিত): 
“ সমাবেশের দিন (১৩ অক্টোবর) সকাল থেকে স্থানীয় কিছু বাঙালি বেতনভুক নেতা থানা বাজারে দোকানপাট বন্ধ করার চেষ্টা করে। তারা ক্ষেত খামারে যে বাঙালিরা কাজে নেমেছিল তাদেরও কাজ বন্ধ করে লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যেতে বাধ্য করে। থানা বাজার সেদিন হাটের দিন। স্বাভাবিকভাবে যেসব লোকজন বাজার অভিমুখে আসছিল তারা যাতে আসতে না পারে তার জন্য ফেরীঘাট বন্ধ সহ রাস্তার মোড়ে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথ রোধ করে রেখেছিল বাঙালিরা।
ইতিমধ্যে হাজার হাজার বাঙালি দা, খন্তা, বল্লম, লাঠি, সাইকেলের চেইনসহ আরো বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ভাঙা বিল্ডিং নামক আর্মি চেকপোষ্ট কাছে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঙালিরা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং উস্কানিমুলক শ্লোগান দিতে থাকে। এমন সময় সমাবেশে যোগ দিতে আসা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একটি মিছিল মাইনী ব্রিজ অতিক্রম করলে সাথে সাথে আর্মি চেক পোষ্ট থেকে রাস্তা ব্লক করা হয়। এ সময় স্থানীয় বিএনপি নেতা মাসুদ রানা, ইলিয়াস, তরুণ বিশ্বাস সহ আরো কিছু বাঙালি পাহাড়িদের দিকে এগুতে থাকলে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে। এ সময় দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলো লে: ফরিদ।
বাঙালিরা যখন পাহাড়িদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোড়া শুরু করলো ঠিক তখনই আর্মি চেকপোষ্ট থেকে একটি হুইসেল বেজে উঠে।  সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বাঙালি পাহাড়িদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম দিকে পাহাড়িরা আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। অবস্থা নাজুক আকার নিলে টিএনও পুলিশকে ফাঁকা গুলি করার নির্দেশ দেন। গুলির শব্দ হওয়ায় সাথে সাথে পাহাড়িরা দৌঁড়ে পালাতে থাকে। এ সুযোগে বাঙালিরা আরো বেশি পাহাড়িদের উপর আক্রমণ চালায়। এতে ভরদাস মুনি মারা যায় এবং আরো অনেকে আহত হয়।”(চোখে দেখা ও কানে শোনা, রক্তাক্ত দিঘীনালা- সুপ্রিয়, জুম্মকণ্ঠ, ২০ নভেম্বর ১৯৯২)

সেদিন অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষের তেজোদীপ্ত মিছিলে সামিল হয়েছিলেন বানছড়া গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ ভরদাস মুনি। প্রৌঢ়ত্ব তাকে অন্ধকার ঘরের কোণে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। দাসত্ব ও নিপীড়ন নির্যাতনের শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে এসেছেন এবং অধিকারহারা মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উসর্গ করেছেন। তাঁর এই আত্মবলিদান কিছুতেই বৃথা যাবে না।

 শহীদ ভরদাস মুনি তোমায় লাল সালাম।!


বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৩

স্মরণ: শহীদ রুইখই মারমা

আজ ২ অক্টোবর ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ রুইখই মারমার ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে লক্ষীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়নের বটতলী নামক স্থানে সেনা-সন্তু মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তদের সশস্ত্র হামলায় রুইখই মারমা শহীদ হন।

রুইখই মারমা একজন আগাগোড়া সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের নাম্। তিনি ভাগ্য বিড়ম্বিত, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত ও অধিকারহারা জনগণের অধিকার ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। জনগণের ওপর সেনা নির্যাতন, ভূমি বেদখল প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সে সময় লক্ষ্মীছড়ি, মানিকছড়ি ও রামগড়ে সেনা-উস্কানিতে ভূমি বেদখলের মহোসব শুরু হলে তার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার সুদক্ষ নেতৃত্বের  কারণেই সেনাবাহিনী ও তাদের চর-এজেন্টর একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এক কথায় রুইখই মারমা অপরিসীম দায়িত্বশীলতার সাথে এলাকার জনগণের স্বার্থের পাহারা দিয়েছিলেন। যার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়।

রুইখই মারমাকে শারিরীকভাবে হত্যা করা গেলেও নিপীড়িত জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন তিনি দেখে গেছেন সেই স্বপ্নের কোন মৃত্যু নেই। যে আকাঙ্খা বুকে ধারণ করে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, সে আকাঙ্খা চিরঞ্জীব- - শত সহস্র মানুষের মিলিত সংগ্রামী চেতনার প্রতিধ্বনি।

শহীদ রুইখই মারমা তোমায় লাল সালাম!