সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতের নির্বাচনী ইতিহাস ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে করণীয়

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মধ্যে আ’লীগ-বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক পড়ে যায়। দশম জাতীয় সংসদকে সামনে রেখে এবারও তার কোন ব্যতিক্রম চোখে পড়ছে না। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে তথাকথিত জাতীয় দলে ভিড়তে হুমড়ি খেয়ে পড়তে শুরু করেছে। সুবিধা লাভের আশায় অনেকে নিজের জাতীয় অস্তিত্বকে বিকিয়ে দিতেও লজ্জাবোধ করছে না। যা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা ছাড়া আর কিছুই নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৫৪ সাল থেকে ’৯১ সালের আগ পর্যন্ত জুম্ম জনগণ আওয়ামী লীগ-বিএনপি কোন দলকেই গ্রহণ করেনি। প্রতিটি নির্বাচনে শাসক দলের প্রার্থীদের পরাজিত করে জুম্মরা নিজস্ব স্বতন্ত্র প্রার্থীকে জয়যুক্ত করেছে। জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে বরাবরই এসব দল পরাজয় বরণ করেছে। যে দল পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, যে দল জোর জুলুম ও দমন-পীড়ন চালিয়েছে, জুম্ম জনগণ বরাবরই সে দলকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

এ বিজয় কাদের?

এ বিজয় পাহাড়ি জনগণের নয়, 
এ বিজয়তো তুমি কে? আমি কে? বাঙালি-বাঙালি’র

এ বিজয় কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের নয়, 
এ বিজয়তো বুর্জোয়া ধনীক শ্রেণীর

এ বিজয় নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের নয়, 
এ বিজয়তো শাসক শোষকের রক্তচক্ষুর

এ বিজয় সংখ্যালঘু জাতি ও জনগণের নয়, 
এ বিজয়তো সংখ্যাগুরু বৃহ জাতিদম্ভের

এ বিজয় দেশের সাধারণ জনগণের নয়, 
এ বিজয়তো যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তাদের

[যে দেশ শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের উপর শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন-নির্যাতন চালায়,  যে দেশ দলীয় সংর্কণীতার উর্ধ্বে উঠতে পারে না,  যে দেশ পাহাড়ের সংখ্যালঘু জাতির উপর নিপীড়ন-নির্যাতন, গণহত্যা ও নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালায় সে দেশে বিজয় দিবস পালনের স্বার্থকতা কোথায়?]

শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাকান্ড

রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসেৌধ।
 আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী দেশের বরণ্য সন্তান হাজার হাজার শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তাদের ওপর চালায় নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন তারপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। ওরা আরো মনে করেছিল যে, এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে ওরা বসবাস করতে পারবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে এদেশকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের এসব বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। বর্বর পাক বাহিনী ও রাজাকাররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক সহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে এদেশকে মেধাশূণ্য করার অপচেষ্টা চালায়। তাই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এইদিনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই এই দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)
বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে, একইদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ জুম্মদের উপরও চালানো হয় নির্যাতন ও হত্যাকান্ড। তবে এ নির্যাতন ও হত্যাকান্ড পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়নি। এদেশের মুক্তিবাহিনীই খাগড়াছড়ির কুকিছড়া-গাছবান এলাকায় এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করে। এদিন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কমপক্ষে ৮জন নিরীহ জুম্মকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি

আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ৩০টি ধারা সম্বলিত এই ঘোষণাপত্রের ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা অবমাননাকর আচরণ করা কিম্বা কাউকে নির্যাতন করা বা শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করা চলবে না’;  ৯নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘কাউকে খেয়াল খুশীমত গ্রেফতার বা আটক করা অথবা নির্বাসন দেয়া যাবে না;  ১৫ নং ধারায় বলা হয়, ‘প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে। কাউকেই যথেচ্ছভাবে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না’; ২০ নং ধারায় বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণভাবে সম্মিলিত হবার অধিকার রয়েছে’।
 
৬৫ বছর আগে এই মানবাধিকার ঘোষণাপত্র গৃহীত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে এর কোন বালাই নেই। যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে চালানো হচ্ছে নিপীড়ন-নির্যাতনের স্টিম রোলার। চালানো হয়েছে ডজনের অধিক গণহত্যা ও সাম্প্রতিক তাইন্দং হামলা সহ অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলা। যত্রতত্র ধর-পাকড়, শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনাতো বলেই শেষ করা যাবে না। আজও এসব নির্যাতন, হামলা-মামলা, ধরপাকড়ের কোন শেষ নেই। মানবাধিকার দিবসের একদিন আগে গতকাল ৯ ডিসেম্বর থেকে খাগড়াছড়ি জেলায় শুরু হয়েছে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যেীথ বাহিনীর অপারেশন। গতকাল ৯ ডিসেম্বর সোমবার রাতে দিঘীনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘরবাড়ি তল্লাশি ও ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটেছে। দিঘীনালা ও মহালছড়িতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের ৮ নেতা-কর্মী এবং মাটিরাঙ্গায় ২ জনকে আটক করা হয়েছে। অপারেশন আরো কয়েকদিন পর্যন্ত চালানো হবে এবং ধরপাকড় চলবে এমন আভাষও পাওয়া যাচ্ছে। 

রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৩

রক্তস্নাত নান্যাচর গণহত্যা স্মরণে

- নিরন চাকমা

আজ ১৭ নভেম্বর নান্যাচর গণহত্যার ২০তম বার্ষিকী। ১৯৯৩ সালের এই দিনে নান্যাচর বাজারে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা মিলিতভাবে নিরীহ জুম্ম জনসাধারণের উপর হামলা চালিয়ে ৩০ জনের অধিক জুম্মকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

ঘটনার পূর্ব ঘটনার কিছু সংক্ষিপ্তাসার:
২৭ অক্টোবর’৯৩ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নান্যাচর থানা শাখার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে। ২৮ অক্টোবর’৯৩ যাত্রী ছাউনীতে বসাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে সেনা সদস্যদের মধ্যে বাক-বিতন্ডা হয়। সেনা সদস্যরা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে অভদ্র ও আশালীন ব্যবহার করেন। এর প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ তক্ষণা প্রতিবাদ মিছিল বের করে যাত্রী ছাউনীটি জনসাধারণে জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার জোর দাবি জানায়।
২ নভেম্বর’৯৩ নান্যাচর নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করে  ৬ নভেম্বর’৯৩’র মধ্যে যাত্রী ছাউনীটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানায়। নির্বাহী অফিসার ১৬ নভেম্বর’৯৩ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পিসিপি’র নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ জানায়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ তার অনুরোধ রক্ষা করেন।
এরপর নির্বাহী অফিসার হাবিবুর রহমান নান্যাচর জোন কমান্ডার লে: কর্নেল আবু নাঈমম ওসি আমজাদ হোসেন, বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ, প্রাক্তন চেয়ারম্যান আইয়ুব হাসান, ইউনুস সওদাগর, আহমদ মিয়া ও অন্যান্য বহিরাগত বাঙালিদের সাথে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ধারণা করা হয় ঐ বৈঠকেই ১৭ নভেম্বর হত্যাকান্ডের যাবতীয় নীল নক্সা পাকাপোক্ত করা হয়েছিল।
১৫ নভেম্বর ’৯৩ নির্বাহী অফিসার হাবিবুর রহমান ও জোন কমান্ডার আবু নাঈম কর্মস্থল নান্যাচর ত্যাগ করে অন্যত্র সরে যান।

বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা নতুন জীবনের স্বপ্ন

মানুষ মরণশীল এটা চিরন্তন সত্য। সময় হলে যে কাউকে সে পথে ধাবিত হতেই হবে। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু অনাকাঙ্খিত ও অস্বাভাবিক। এই মৃত্যু নামক জিনিসটিকে কেউ সহজে মেনে নিতে চায় না। তবুও তাকে আঁকড়ে ধরেই জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

আমি এই মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছিলাম। যদিও মৃত্যুদূতটি আমার খুব কাছ দিয়েই চলে গিয়েছিল। সেই মুত্যুদূতটি আর কেউ নয়, সন্তু লারমারই লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনীর দল।

২০০৪ সালের ২৬ মার্চ। রাঙামাটি সদর উপজেলার কুদুকছড়ি হেডম্যান পাড়ার একটি বাড়িতে সহযোদ্ধা বন্ধুদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৫টা। হঠা গুলির আওয়াজ হলো। আমরা পালানোর চেষ্টা করলাম। পিছনে পিছনে গুন্ডার দলটি  গুলি করতে করতে আমাদেরকে ধাওয়া করলো।  এ সময় গুন্ডাদের ছোঁড়া একটা গুলি আমার বাম পায়ের ‘রানে” বিদ্ধ হয়। এরপর আমি কোন রকমে একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে সক্ষম হই। দু’তিন মিনিট পরই ২/৩জন গুন্ডাকে আমার একেবারে পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখলাম।  এ সময় তারা বলাবলি করছিলো এদিকেতো একজন চলে গেছে। সে কোথায় গেল...। আমি যত পারি চুপচাপ হয়ে রইলাম। যদি তারা টের পেতো তাহলে নিশ্চিত তারা আমাকে মেরে ফেলতো। ভাগ্যিস তারা আমি যে লুকিয়ে আছি সেটা টের পায়নি। আস্তে আস্তে রাত নেমে এলো।  লোকজনের কোন সাড়া শব্দ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর গুন্ডার দলটি চলে গেছে বলে মনে হলো। তারপরও ভয় হচ্ছিল যদি তারা লুকিয়ে থাকে। এদিকে যতই সময় যাচ্ছে ততই আমার পা ভারী হয়ে উঠছে, যন্ত্রনা করছে, পানির পিপাসা বেড়ে গেছে।  আমাকে সহযোগিতা করবে এমনতো আর কেউ পাশে নেই।  কোন উপায়ন্তর না দেখে  সাহস করে ‘ও মানুষ, ও মানুষ’ করে বড়বড় করে দু’একটি চিকার দিলাম। আমার চিকার শুনে গ্রামের লোকজন সাড়া দিলো। পরে তাঁরা এসে আমাকে ঐ ঝোঁপের ভেতর থেকে উদ্ধার করে প্রথমে একটি বাড়িতে নিয়ে গেলো।  তাঁদের কাছ থেকে আমি পানি খুঁজলে তাঁরা আমাকে পানি খেতে বারণ করলো। পানির পরিবর্তে তাঁরা আমাকে লেবু কেটে রস খেতে দিলো। এরপর তাঁরা আমাকে কুদুকছড়ি বাজারে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিসার ব্যবস্থা করলো। এদিন গুন্ডাদের হামলায় আমি ছাড়াও আরো দু’জন আহত হন। যদিও তাদের আঘাত আমার মতো মারাত্মক ছিল না। এর মধ্যে একজন হলেন সহযোদ্ধা সম্রাট ও অপরজন পলাশ নামে স্থানীয় এক যুবক। পরে সহযোদ্ধারা আমাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানোর  ব্যবস্থা করলেন।

মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৩

পার্টি ও আন্দোলনের সাথে আমি একিভূত

-- নিরন চাকমা 
[ এ লেখাটি ইউপিডিএফ-এর এক যুগপূর্তি সংকলন ‘নব জাগরণ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। অনলাইন পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য এটি এখানে প্রকাশ করলাম।]
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে জনসংহতি সমিতি সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃত্ব শূণ্যতা দেখা দেয়। চারিদিকে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সমাজে ভাঙন দেখা দেয় । এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় নয়া যুগের নয়া পার্টি ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটি ফ্রন্টর্( ইউপিডিএফ)। হাল ধরে সমাজ বিনির্মাণের কাজে এবং কাঁধে তুলে নেয় জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব। এই পার্টি বর্তমানে এক যুগ অতিক্রম করেছে। এই এক যুগ সময় পেরিয়ে আসতে এই পার্টিকে অনেক চড়াই-উরাই পার হতে হয়েছে। অনেক সহযাত্রীকে হারাতে হয়েছে। তারপরও এই পার্টি সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমি এই পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে অধিকারহারা জাতিসত্তাসমূহের মুক্তির সনদ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে শরীক হতে পেরে নিজেকে নিয়ে খুবই গর্ববোধ করি।

পার্টি এবং আন্দোলন কোন সহজ বিষয় নয়। একটা পার্টি তার লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমেই সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ইউপিডিএফ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সফলতার সঙ্গে এক যুগ পার করতে সক্ষম হয়েছে। পার্টির এই এক যুগের সময়ে আমার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে এবং অর্জিত হয়েছে নানা অভিজ্ঞতা।

সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

শিল্প-সাহিত্যে বিশ্বায়নের মুনাফা

[লেখক হরিপদ দত্তের এই লেখাটি ২০০৫ সালের ১১ নভেম্বর  দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়। লেখাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সকলের পড়ার সুবিধার্থে কম্পোজ করে এটি এখানে হুবহু প্রকাশ করলাম।]
গ্লোবালাইজেশন বা ভুবনিকরণ অর্থা বিশ্বায়ন হচ্ছে বিশ্বমানবের সামনে নতুন এক অভিজ্ঞান। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের ভেতর দিয়ে এর চাকায় দুর্বার দানবীয় বেগ সংযুক্ত হয়। এই শক্তি জাতি-রাষ্ট্রের সীমানার অস্তিত্ব যেমনি অস্বীকার করে, তেমনি তার প্রাকৃতিক, মানব এবং মনন সম্পদকেও আপন আগ্রাসী থাবায় লণ্ডভণ্ড করে দেয়। পরিবর্তে চাপিয়ে দেয় সে নতুন নতুন তত্ত্ব। তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বভ্রমণ হচ্ছে এর সহায়ক। তাই আজকের বিশ্বে কেবল অর্থনীতি আর রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে না এই বিশ্বায়ন, সংস্কৃতি তথা শিল্প-সাহিত্যের অভিভাবকত্বও নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের পরিভ্রমণ এবং টিভি, ইন্টারনেট, সাইবার প্রযুক্তির অপ্রতিরুদ্ধ প্রভাব মানবসভ্যতাকে চরম সঙ্কটে ফেলেছে। অবিশ্বাস্য এক জাদুকরী মোহাচ্ছন্নতায় পতিত হয়েছে মানবজাতি। অর্থনীতি এবং রাজনীতির পাশাপাশি সারা বিশ্বের দরিদ্র-অনুন্নত দেশগুলো আজ বিশ্বায়নের নামে পুঁজিবাদের একচেটিয়া প্রায় প্রতিরোধহীন আক্রমণ আর আগ্রাসনে পতিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তাই দরিদ্র-অনুন্নত দেশগুলোর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বলতে গেলে সেই শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে আজ।
বাংলাদেশসহ তৃতীয় দুনিয়ায় অপরাপর দেশে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা আজ আর মনন চর্চার উচ্চস্তরে দাঁড়িয়ে নেই। মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী পুঁজির উপকরণে পরিণত হয়েছে সাহিত্য। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং অভিভাবকত্ব স্বাধীন শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে হাজির হয়েছে। সাহিত্য বা অপরাপর মননচর্চার মাধ্যম শিল্পগুলো পরিণত হয়েছে ব্যবসায়ী পণ্যে। এটা অবিশ্বাস্য বা আশ্চর্য্যরে বিষয় নয় যে, বুদ্ধিবৃত্তি তথা মননশীল চর্চা আজ স্বাধীন থাকতে পেরেছে। ঐতিহাসিক কারণেই ব্যবসায়ী পণ্যে পরিণত হয়েছে সেসব সৃষ্টিশীল কর্মপ্রচেষ্টা।
সাহিত্য সৃষ্টি আর প্রসারের নামে আসে বৈদেশিক অনুদান। থাকে রাষ্ট্রীয় অনুদান। মহ উদ্দেশ্যের আড়ালে এসব অনুদান হচ্ছে মুনাফা সৃষ্টির সহায়ক পুঁজি। এই মুনাফা সৃষ্টি করা হয় বিশেষ শ্রেণীর জন্য। তারা বই প্রকাশ আর বিতরণের নামে চালায় ব্যাপক লুণ্ঠন। জাতির জ্ঞান বৃদ্ধির নামে আজ নানা জাতীয় বইয়ের ¯তূপ জমা হচ্ছে সারা দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গুদাম ঘরে। এসব বইয়ের বিপুল অংশই কার্যত অপাঠ্য রচনা, যা শিক্ষার্থী-পাঠকের কোন কাজেই আসে না। যা কিছু কাজে আসে তা আসলে মগজধোলাই। মনে রাখতে হবে এসব বই পাঠকশ্রেণী পযসা খরচা করে কিনতে বাধ্য নয় বলেই রাষ্ট্রীয় অনুদানের নামে জনগণের অর্থ এভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে। অর্থা পরোক্ষভাবে জনগণকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। পুঁজির পরিভ্রমণই হচ্ছে মুনাফার উদ্দেশ্য। যেখানে মুনাফা সেখানেই পুঁজির আগ্রাসন। অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এমন পণ্যই উপাদন করে যার রয়েছে মুনাফা সংগ্রহের শক্তি।
তাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সর্বদাই মুনাফা অর্জনে সক্ষম পণ্যের পৃষ্টপোষকতা দান করে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের মুনাফা অর্জনকারী বাজার পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশ বড়। তাই বাংলাদেশী মুনাফার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-পণ্য সর্বদা লালায়িত। যে ধরনের সাহিত্যের চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক সে ধরনের সাহিত্য-পণ্যই উপাদিত হয়ে এখানে আসে। মনে রাখতে হবে পণ্য উপাদন, বাজারজাতকরণ, প্রচার এবং ভোক্তার সহায়ক থাকে রাষ্ট্র। তাই একটি ধনবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাহিত্য-পণ্যের সহায়তা দান করা রাষ্ট্রের আদর্শ-কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কিংবা বেসরকারি মিডিয়াগুলো সর্বদা তৈরি থাকে বাজার সৃষ্টির জন্য। লুণ্ঠনের টাকায় তৈরি এসব যন্ত্র পাঠক-ক্রেতার সামনে নানা কৌশলে বাজার সাহিত্যকে তুলে ধরে। পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া যথাযথভাবে এসব দায়িত্ব পালন করে। এভাবে তারা দেশের ভেতর বিরাট ভোক্তাশ্রেণী তৈরি করে। বাণিজ্য মেলার মতো বই মেলার আয়োজন করে তারা মুনাফার জন্য, যদিও স্লোগান দেয়া হয় জাতীয় মহ স্বার্থের, জ্ঞান বিকাশের। বিষয়টা একেবারেই হাস্যকর।
আজকের এই সর্বগ্রাসী বাজার অর্থনীতির বিশ্বব্যবস্থা বিশ্বসাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। করপোরেট বাণিজ্যের মতো সাহিত্য ও মুনাফা সৃষ্টিতে সক্ষম। ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যয়বহুল বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে এবং ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে। বিস্ময়ের ঘটনা এই যে, বড় বড় দেশগুলোতে রাজনীতিবিদ, খেলোয়ার, চিত্রতারকা, বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পণ্য বিজ্ঞাপনে  ভাড়া খাটছে নানা কৌশলে। ‘বেস্ট সেলার’-এর বিভ্রান্তিকর চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। সেক্স স্ক্যান্ডাল, ক্রাইম, থ্রিল, সায়েন্স ফিকশন হচ্ছে মুনাফার পুঁজি। সেই পুঁজির কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছেন বিশ্বের সেরা মানুষেরা। তারাও মুনাফার মডেল হতে দ্বিধা করেন না। মার্কিনিদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান বিল ক্লিনটন পর্যন্ত ‘মাই লাইফ’-এর মোড়কে বই-বাণিজ্যের উপকরণে পরিণত হয়ে যান। আজগুবি কাহিনী ‘হ্যারিপটার’ কিংবা বাঙালির আত্মীয় মনিকা আলীর বা ঝুম্পা লাহিড়ি সেই একই মুনাফার পণ্য। বাঙালি যে কতটা মুর্খ, নির্লজ্জ, কাণ্ডজ্ঞানহীন জাতি তার প্রমাণ ‘ব্রিক লেন’-এর বাংলা সংস্করণের জনপ্রিয়তা। প্রভুদের উন্নত দেশে ক্রীতদাস জাতির ‘মুক্তি ও স্বাধীনতা’র মোড়কে যে যৌন স্বাধীনতা লাভ কিংবা আপন ঐতিহ্য বিসর্জনের দৃষ্টান্ত এই বই, এ কথা কয়জন বোঝে? না হলে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে, ড্রেনে-নর্দমায়, ট্রাফিক সিগন্যাল আর বাসস্ট্যান্ডে মনিকা আলীর চিকার শোনা যাবে কেন? মনিকা আলীর ইংল্যান্ড প্রবাসী বাঙালির অতৃপ্ত যৌনতা পুঁজি হয়ে যায় মুনাফার, নাজনীন আর রাজিয়া নামের মোড়কে। এত বড় গৌরব বাঙালি আর কবে অর্জন করেছে? প্রবাসে বসে নির্লজ্জ চাটুকারিতা আর কাকে বলে?
বুকার বিজয়ী অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্যা গড অব স্মল থিংক্স’-এ কি আছে? বাড়াবাড়ি রকম যৌনাচার আর কেরেলোর প্রথম কমিউনিস্ট সরকার নাম্রুদ্যিপাদের শাসনকালের মিথ্যে কুসা আছে বলেই পুঁজিবাদী বিশ্ব এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করল না কি? একদিকে মুনাফা, অন্যদিকে সাম্যবাদী রাজনীতির বিষেদাগার নয় কি? তাই তারা আছে। মনিকা আলী, অরুন্ধতী, সালমান রুশদীরা আছে দেশে দেশে। ধর্ম-বিদ্বেষের নামে হঠকারিতা করে ওরাই দেশে দেশে মৌলবাদের উত্থানকে উসাহিত করে। ওরা হচ্ছে লুটেরা পুঁজির সাহিত্যিক মুনাফার পণ্য।
আমাদের ভুললে চলবে না যে, সাহিত্য হচ্ছে মানুষের উচ্চতর মননবৃত্তির মহ সৃষ্টি, এটি ভোগের নয়, বিনোদনের নয়। এজন্যই সাহিত্যের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সভ্যতার অগ্রগামিতার একটা নিবিড়তা। পুঁজিবাদী মুনাফাহীন উদ্দেশ্যে সাহিত্যকে যেমনি নামিয়ে এনেছে রূপজীবী বেশ্যার ভূমিকায়, ঠিক তেমনি শোষকশ্রেণীর রাজনীতির হাতিয়ারেও পরিণত করেছে তাকে। এ কথা সত্য যে তরলায়িত রূপজীবী বিনোদন সাহিত্য নির্মাণ যতটা সহজ, ততটাই কঠিন শোষণের বিরোধী হাতিয়ারের মতো সাহিত্য নির্মাণ। বাংলাদেশের শোষিত জনগণের সৌভাগ্য এই যে, উন্নত বিশ্বের মতো শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য নির্মাণের মেধাবী ভাড়াটে লোক আবার এখানে নেই। অনেকে চেষ্টা করেছে, মেধাহীনতার কারণে হতে পারেনি।
বাজারি সাহিত্যকে ক্রেতা বা পাঠকরা ভোগ্যপণ্যের মতোই ব্যবহার করে। পশ্চিমের ইংরেজি কিংবা অপরাপর শক্তিশালী ভাষায় রচিত বাজারি সাহিত্যের দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়ে যায় মাত্র কয়েক সপ্তাহে। এই ভোক্তা শ্রেণীটি কারা? এই শ্রেণীটি তারাই যারা মেধার চর্চা থেকে বহুদূরে অবস্থান করে এবং স্থুল আনন্দের সন্ধানী। বাজারে ভিড় তাদেরই, তাদেরই উদ্দেশ্যে সেসব বই প্রকাশিত হয়। সাহিত্য-পণ্যের কারবারীরা মেধাবী পাঠক খোঁজে না, তারা জানে এই শ্রেণীর পাঠকরা সংখ্যায় ছোট এবং বিপজ্জনক। মুনাফা সৃষ্টির সহায়ক তো নয়ই।
বিশ্বায়নের পুঁজির বাজারে উন্নত এমনকি অনুন্নত দেশে বাজার আর মুনাফার পারিপার্শ্বিকতার কারণেই চমকে ওঠার মতো নারী লেখকের আগমন ঘটে। নারী লেখকরা নারীবাদের নামে যেভাবে নিজেদের শরীরের বর্ণনা দিচ্ছে, নিজেদের বিকৃত কাম-চেতনার প্রকাশ ঘটাচ্ছে বইয়ের পাতায় পাতায়, তাতে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়। অতীতে এই কাজটা করত পুরুষ লেখকরা এবং আপন সৃষ্ট নারী চরিত্রের সঙ্গে অবচেতনে নিজেরাই সম্ভোগে মেতে উঠত। আজ সেই জায়গাটির দখল নিয়েছে নারীরা নিজেরাই। এদের প্রভাবে মাঝে-মধ্যে বাংলা ভাষায় এমন নারীর শরীরী বর্ণনা বা যৌন আবেদনের চিত্র মেলে, মনে হবে ওসব যেন পশ্চিমী কোন সমকামী নারীর অনুভূতি। তাই এটা আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে, পুঁজিবাদ আজ কেবল নারীর শরীর থেকেই মুনাফা সৃষ্টি করে পরিতৃপ্ত নয়, নারীর মনন-মেধাকেও মুনাফার হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বর্ণবাদী ইউরোপ আমেরিকা যেমনি নারীদের নিয়ে নারীবাদ বা নারী স্বাধীনতার নামে সীমানা লঙ্ঘন করেছে, ঠিক তেমনি তাদের উস্কানিতে তৃতীয় বিশ্বেও নারীরা শরীর ও মেধার সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে বিষয়টা না-জেনে-বুঝেই।
মুনাফার ধর্মই হচ্ছে মানুষকে নীতিবিবর্জিত করা, ধর্মান্ধতার পাশাপাশি ভোগবাদী করে তোলা। সামাজিক ভোগবাদী মানুষ হিসেবে লেখকদের বেলায়ও তাই ঘটে। কি লিখলে, কেমন করে লিখলে ক্রেতা মিলবে, বাজারজাতকরণের মাধ্যমে প্রকাশক মিলবে, তাও নির্ধারণ  করে মুনাফা সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ী পুঁজি। ক্রাইম, থ্রিল, যৌনতা, সস্তা প্রেম ইত্যাদি বিষয়গুলো ভোগবাদী বিশ্বের ক্রেতাদের খুবই পছন্দের বিষয়। যেসব বইয়ে এসব আছে সেসব বইয়ের চটকদার বিজ্ঞাপনের দ্বারা ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। প্রশ্নটা মুনাফার, তাই নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই।
ভোক্তাদের জন্য বাজার হচ্ছে দুই ধরনের। একটি স্থানীয়, অন্যটি আন্তর্জাতিক। স্থানীয় বাজারে সাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক বাজারে হচ্ছে ইংরেজি। ইংরেজি না-জানা পাঠকদের জন্য সাহিত্যিক মুনাফাখোরেরা সংগ্রহ করে অনুবাদক। অনুবাদ কর্মটি যথার্থ কি না, বিক্রি বা বিপণন আইনসিদ্ধ কি না, তা দেখার প্রয়োজন পড়ে না। আজকের এই যুগে সাহিত্য-পণ্যের ক্রেতা সংগ্রহের জন্য ভোগ্যপণ্যের বিপণনরীতিকেই কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশ্ব পুঁজির মুনাফাখোরেরা সে উদ্দেশ্যে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়, বড় বড় ফাইভস্টার হোটেলে আয়োজন করে মতবিনিময় সভা, প্রদর্শনী, সমাবেশ ঘটায় সুন্দরীদের, খেলাধুলা, চলচ্চিত্র স্টারদের, খ্যাতিমান, আঞ্চলিক বুদ্ধিজীবীদের। ঠিক তেমনি সাহিত্য ব্যবসায়ীরাও করে থাকে। তাই দেখা যায় প্রতিটি দেশে প্রকাশকরা যার যার ক্ষমতানুসারে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, আমলা, শিল্পপতি, মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদদের সমাবেশ ঘটায় বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। পেছনে থাকে প্রচার যন্ত্র। সেসব দৃশ্য বা বক্তব্য তুলে ধরে পাঠক বা দর্শকের সামনে প্রিন্ট মিডিয়ায়, স্যাটেলাইটে।
এই সাহিত্যের মুনাফাখোর শ্রেণী স লেখকদের চরিত্র হনন করে। তারা বাধ্য করে লেখকদের মিডিয়ার সামনে যেতে। এভাবে লেখকরা প্রতারিত হচ্ছে, পকেট ভারী হচ্ছে প্রকাশকদের। লেখকরা অর্থ বা খ্যাতির মোহে বাধ্য হয় প্রচারের ক্ষেত্রে পা দিতে। কেননা, লেখকরা হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত। বেঁচে থাকার জন্য তাদেরও প্রয়োজন পড়ে অর্থের। একদিকে খ্যাতি, অন্যদিকে অর্থ, এই যে দ্বৈত আকর্ষণ, তাকে অতিক্রম করা খুবই কঠিন। এটা মধ্যবিত্ত লেখকদের শ্রেণীগত ধর্ম। পুঁজির এতটাই শক্তি যে, সেখানে একজন ব্যক্তি লেখক অস্তিত্বের কারণেই সে পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। যারা থাকে আদর্শের নামে অটল তারা মরে ধুঁকে ধুঁকে।
পুঁজিবাদী মুনাফা যে কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা তার সর্বগ্রাসী চরিত্র তা উন্নত ধনী রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি-অর্থনীতির পাশাপাশি মেধা-মনন সৃষ্টির দিকে তাকালেই ধরা পড়ে। মুনাফা সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রব্যবস্থা সাম্যবাদী কিংবা উচ্চতর মানবতাবাদী শিল্প-সাহিত্যকেও সহ্য করে না। সে ধরনের সৃষ্টিকে ধ্বংস করাই তার বড় কাজ। অন্যদিকে পুঁজিবাদী সর্বদাই আতঙ্কিত থাকে সৃষ্টিশীল চিন্তাকে নিয়ে। বর্তমান সমাজতন্ত্র ত্যাগকারী নব্য পুঁজিবাদী রাশিয়া এর প্রমাণ। সেখানকার বর্তমান শাসকশ্রেণী গোর্কি বা তলস্তয়ের সৃষ্টিকে ভয় পায় বলেই সেসব সাহিত্যকর্মকে নির্বাসনে পাঠাতে সচেষ্ট। প্রকৃত অর্থে আজ গোর্কি বা তলস্তয়কে রুশভাষার পরিবর্তে পৃথিবীর অপরাপর ভাষা রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে। নোবেল বিজয়ী পুঁজিবাদের ধারক বিশ্বাসঘাতক রুশ কবি সালঝেনেৎসিনের সৃষ্টি আজ হতে চায় জাতিটির বিবেক। পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র পরিত্যাগকারী রাষ্ট্র্রগুলোর মহান চিরায়ত সাহিত্য-সৃষ্টিরও আজ একই দশা।
মুনাফার রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া আজকের যুগ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর। তবু এই কষ্ট আর নির্লোভ আত্মত্যাগই সভ্যতা এবং মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ আদর্শ। একজন স লেখক চরম দারিদ্র্য বরণ করে এবং অস সমাজের হাত থেকে প্রাপ্তিকে ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে কঠিন জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মানবসভ্যতার জন্য সৃষ্টি করে যান। অনাগত ইতিহাস তার শিল্পকে রক্ষা করবে, আর সব মিশে যাবে পথের ধুলায়। মুনাফা সৃষ্টিকারী পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রগতির পক্ষের এবং প্রতিক্রিয়ার বিপক্ষের বৈরী শিল্পীর প্রতিপক্ষ অবশ্যই। ঘোর শত্র“ও বটে। নানা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে সাহিত্যের জগ থেকে তাদের উখাতের চেষ্টাও চলে। উপমহাদেশ তথা পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ আছে। অন্য যে কোন পণ্য তৈরির উদ্দেশ্যে যে মুনাফা তা সহজেই ধরা যায়। ওসব পণ্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে না। কিন্তু সাহিত্যের ভেতর এমন ছদ্মবেশী সৃষ্টি থাকে যে, মুনাফা এবং রাজনীতিটাও এতটাই জটিল প্রায় অদৃশ্য অবয়বে অবস্থান করে, সাধারণ পাঠক তা ধরতেই পারে না। অনেকটা সংস্কার করা মার্কসবাদের মতো। মনে হবে সাচ্চা মার্কসবাদ, আসলে তা নকল। তো, সেসব ছদ্মবেশী শিল্প ও মুনাফা সৃষ্টিকারী উপকরণ মুনাফা সৃষ্টি করুক, তাতে কারও কারও হয়তো আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু সেসব সাহিত্য যখন শোষিত-বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের সাহিত্য হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে, তখনই তা হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। কবিতা, নাটক, গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে এমন সৃষ্টি পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যে সর্বদাই চোখে পড়ে। হঠা মনে হবে ওসব জনগণের সাহিত্য। ওসব যে জনগণের তথা প্রগতির সাহিত্য নয়, এটা পাঠক তখনই শনাক্ত করতে পারবে, যখন দেখতে পাবে ওসবের ভেতর তাদের জীবনের বাস্তবতা ফুটে উঠেছে কিন্তু মুক্তির পথনির্দেশ নেই। বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রতিক্রিয়াশী বলে চিহ্নিত অনেক কবি-লেখকের কোন কোন রচনা প্রচণ্ড প্রগতিশীল বলে পাঠক বারবার ভুল করে ওই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিটা নেই বলেই। তাই কোনটি প্রগতি আর কোনটি প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য তা বুঝতে গেলে অবশ্যই প্রগতির রাজনীতিটা বুঝতে হবে আগে। মুশকিল হল সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের সহজেই চেনা যায়, যায় না কেবল ছদ্মবেশী তথাকথিত প্রগতিবাদীদের। এই ছদ্মবেশীরাও সাহিত্যের মুনাফা সৃষ্টির অন্যতম সহায়ক। ওরা মিশে থাকে উদারবাদী বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের ভেতর কিংবা নকল কমিউনিস্ট পার্টিতে।
কাজেই এটা মনে করার কারণ নেই যে, সাহিত্যের মুনাফা সরাসরি বিপণন-বাজার থেকে সৃষ্টি হয়। মুনাফার সাহিত্যের প্রকৃত মুনাফাটা পুঁজিপতিরা প্রথম সংগ্রহ করে ভাড়াটে কবি-লেখকদের মগজ থেকে। তারপরই প্রশ্ন  আসে বাজারের। এখানে লেখকের মগজ হচ্ছে মুনাফা সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান। সেই উপাদানকে বই পণ্যে রূপান্তরের  জন্য যে পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীরা, তা মুনাফায় রূপান্তরিত হয় বাজারে এসে। তো সাহিত্য-পণ্যের বাজারের বৃহ ক্রেতাগোষ্ঠী হচ্ছে অল্প বা মধ্যম আয়ের মানুষ তথা মধ্যবিত্তরা। বিত্তবানদের বই পড়ার সময় নেই যেমনি, তেমনি নেই জ্ঞানচর্চার। বিনোদনকে তারা সংগ্রহ করে ব্যয়বহুল ভ্রমণ, ক্লাব, নারী, ক্যাসেনো, জুয়া এবং অকল্পনীয় ব্যয়বহুল খাদ্য গ্রহণ করে।
দুর্লভ উপাদেয় খাদ্যও তাদের বিনোদনের অংশ। ওই ক্ষুধাটা যতটা উদরের, তার চেয়ে মনের।
কিন্তু মধ্যবিত্ত? ওই শ্রেণীর হাতে তো পয়সা নেই। তাই সস্তা বিনোদনের জন্য তারা যায় বইয়ের কাছে, সিনেমার কাছে, টিভির কাছে। মধ্যবিত্ত মানবজাতির সবচেয়ে জটিল প্রজাতি। শ্রেণী হিসেবে তারা অলীক অর্থা মিথ্যে স্বপ্নচারী, অসুখী, কল্পনাবিলাসী, দুঃখবিলাসী এবং অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা বহনকারী। মনোবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, সাহিত্যের ভেতর এই মধ্যবিত্ত খুঁজে ফেরে এমন এক কাল্পনিক অবাস্তব সুখ ও শান্তির জগ, যার আড়ালে রয়েছে নিজেরাই। তাই অসুখী, অস্থিরচিত্ত এই শ্রেণীটি হালকা-চটুল-চিন্তা আর মেধাশূন্য সহজপাঠ্য সাহিত্যের ভেতর আনন্দ খোঁজে। বাস্তব জীবনে যাকে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, এমন এক কল্পনার জগতের সন্ধান করে তারা আধুনিক রূপকথা সেই সায়েন্স ফিকশনের ভেতর। সাহিত্যের চিন্তাশীল জটিল নান্দনিকতাকে ভয় পায় ওরা এ কারণেই যে, তাদের সামনে আশা শূন্য, কেবলই হতাশা, মন ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত।
মুনাফার রক্তপিপাসু দানব পুঁজিবাদ মধ্যবিত্তের এই গোপন অসুস্থ মনের খবর রাখে। ওরা আরও জানে মধ্যবিত্তের জীবনে স্বাধীন, নিরুদ্বেগ, প্রশান্তির, পরম পরিতৃপ্তির শৈল্পিক অপার সুন্দর যৌন-জীবনেও নেই। তাই বিকৃত যৌন সাহিত্যকে বাজারজাত করে ওরা মুনাফা সৃষ্টি করে সহজে। এই অন্ধ-বধির-মগজশূন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেরাও জানে না, বোঝে না সাহিত্যের নামে কীভাবে প্রতারিত হচ্ছে তারা। টেরও পায় না কেমন করে পুঁজির মুনাফার যোগানদার সেজে আছে ওরা। জানে না বলেই বিশ্বায়নের এই যুুগে শ্রেণী হিসেবে মধ্যবিত্ত সবচেয়ে সঙ্কটকালে পতিত হয়েছে। তাদের মননশীলতার সমস্ত পথ আজ রুদ্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের প্রচণ্ড ঢেউ বিচূর্ণ করে দিয়েছে তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনকে, চিন্তা-চেতনাকে। শত শত টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট, সাইবার ক্যাফে, পর্নগ্রাফি, পর্ন পত্রপত্রিকা, পর্ন-সাহিত্য দানবের মতো গ্রাস করেছে তাদের। এত যে আয়োজন, এত যে বিচিত্র জীবন তাদের সামনে দুলে উঠত প্রতি মুহুর্তে, তার সবকিছুর আড়ালে রয়েছে মুনাফা, পুঁজির মুনাফা। জন্মান্ধ মধ্যবিত্ত তা দেখাতে পায় না।
বিশ্বায়ন যে কেবল সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের উপাদিত শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক তথা ভাবজগ তৃতীয় বিশ্বে বাজারজাত করছে তা নয়, স্থানীয়ভাবেও এ ধরনের সাহিত্য-সংস্কৃতি উপাদনকে অনুদানে-দানে উসাহিত করছে। বুকার, ম্যাগসেসে পুরস্কার-পরিতোষিক দানের উদ্দেশ্যটা হচ্ছে সে বাজার রক্ষা ও সম্প্রসারণ। পুরস্কারের সঙ্গে জনগণের জ্ঞাতার্থে যে প্রজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তা পাঠ করলে স্তম্ভিত হতে হয়। কাজেই তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি এবং অগ্রগতি সম্ভব তখনই যখন বিশ্বায়নের আগ্রাসনকে প্রতিহত করা যাবে। অন্যদিকে স্বাধীন শিল্প ও সাহিত্য তথা সংস্কৃতি চর্চাও প্রতিরোধের মধ্যেই টিকে থাকবে। সেই প্রতিরোধটা অন্য কিছু নয়, প্রগতিবাদী লেখকদের নির্মোহ থেকে লিখে যাওয়া, ক্রমাগত নব নব সৃষ্টি করা।

লেখক: হরিপদ দত্ত

সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর : ১১ নভেম্বর ২০০৫

রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৩

স্মরণ: আজ শহীদ ভরদাস মুনির ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী

আজ ১৩ই অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরদাস মুনি চাকমার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯২ সালের এই দিনে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলার থানা বাজার এলাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আয়োজিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যোগ দিতে এসে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিদের যৌথ হামলায় তিনি শহীদ হন।

সেদিন যা ঘটেছিল (একজন  প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে সংক্ষেপিত): 
“ সমাবেশের দিন (১৩ অক্টোবর) সকাল থেকে স্থানীয় কিছু বাঙালি বেতনভুক নেতা থানা বাজারে দোকানপাট বন্ধ করার চেষ্টা করে। তারা ক্ষেত খামারে যে বাঙালিরা কাজে নেমেছিল তাদেরও কাজ বন্ধ করে লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যেতে বাধ্য করে। থানা বাজার সেদিন হাটের দিন। স্বাভাবিকভাবে যেসব লোকজন বাজার অভিমুখে আসছিল তারা যাতে আসতে না পারে তার জন্য ফেরীঘাট বন্ধ সহ রাস্তার মোড়ে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথ রোধ করে রেখেছিল বাঙালিরা।
ইতিমধ্যে হাজার হাজার বাঙালি দা, খন্তা, বল্লম, লাঠি, সাইকেলের চেইনসহ আরো বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ভাঙা বিল্ডিং নামক আর্মি চেকপোষ্ট কাছে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঙালিরা আরো বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং উস্কানিমুলক শ্লোগান দিতে থাকে। এমন সময় সমাবেশে যোগ দিতে আসা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একটি মিছিল মাইনী ব্রিজ অতিক্রম করলে সাথে সাথে আর্মি চেক পোষ্ট থেকে রাস্তা ব্লক করা হয়। এ সময় স্থানীয় বিএনপি নেতা মাসুদ রানা, ইলিয়াস, তরুণ বিশ্বাস সহ আরো কিছু বাঙালি পাহাড়িদের দিকে এগুতে থাকলে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে। এ সময় দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলো লে: ফরিদ।
বাঙালিরা যখন পাহাড়িদের লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোড়া শুরু করলো ঠিক তখনই আর্মি চেকপোষ্ট থেকে একটি হুইসেল বেজে উঠে।  সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বাঙালি পাহাড়িদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম দিকে পাহাড়িরা আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। অবস্থা নাজুক আকার নিলে টিএনও পুলিশকে ফাঁকা গুলি করার নির্দেশ দেন। গুলির শব্দ হওয়ায় সাথে সাথে পাহাড়িরা দৌঁড়ে পালাতে থাকে। এ সুযোগে বাঙালিরা আরো বেশি পাহাড়িদের উপর আক্রমণ চালায়। এতে ভরদাস মুনি মারা যায় এবং আরো অনেকে আহত হয়।”(চোখে দেখা ও কানে শোনা, রক্তাক্ত দিঘীনালা- সুপ্রিয়, জুম্মকণ্ঠ, ২০ নভেম্বর ১৯৯২)

সেদিন অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষের তেজোদীপ্ত মিছিলে সামিল হয়েছিলেন বানছড়া গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধ ভরদাস মুনি। প্রৌঢ়ত্ব তাকে অন্ধকার ঘরের কোণে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। দাসত্ব ও নিপীড়ন নির্যাতনের শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে এসেছেন এবং অধিকারহারা মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উসর্গ করেছেন। তাঁর এই আত্মবলিদান কিছুতেই বৃথা যাবে না।

 শহীদ ভরদাস মুনি তোমায় লাল সালাম।!


বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৩

স্মরণ: শহীদ রুইখই মারমা

আজ ২ অক্টোবর ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ রুইখই মারমার ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে লক্ষীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়নের বটতলী নামক স্থানে সেনা-সন্তু মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তদের সশস্ত্র হামলায় রুইখই মারমা শহীদ হন।

রুইখই মারমা একজন আগাগোড়া সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের নাম্। তিনি ভাগ্য বিড়ম্বিত, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত ও অধিকারহারা জনগণের অধিকার ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। জনগণের ওপর সেনা নির্যাতন, ভূমি বেদখল প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সে সময় লক্ষ্মীছড়ি, মানিকছড়ি ও রামগড়ে সেনা-উস্কানিতে ভূমি বেদখলের মহোসব শুরু হলে তার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার সুদক্ষ নেতৃত্বের  কারণেই সেনাবাহিনী ও তাদের চর-এজেন্টর একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এক কথায় রুইখই মারমা অপরিসীম দায়িত্বশীলতার সাথে এলাকার জনগণের স্বার্থের পাহারা দিয়েছিলেন। যার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়।

রুইখই মারমাকে শারিরীকভাবে হত্যা করা গেলেও নিপীড়িত জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন তিনি দেখে গেছেন সেই স্বপ্নের কোন মৃত্যু নেই। যে আকাঙ্খা বুকে ধারণ করে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, সে আকাঙ্খা চিরঞ্জীব- - শত সহস্র মানুষের মিলিত সংগ্রামী চেতনার প্রতিধ্বনি।

শহীদ রুইখই মারমা তোমায় লাল সালাম!


সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সহযোদ্ধা শুক্ল’র না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ও আমার অনুভূতি

দুরারোগ্য ব্ল্যাড ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে সহযোদ্ধা শুক্ল বিকাশ চাকমা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তার এভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু তারপরও মেনে নেয়া ছাড়া কি-ই বা করার আছে?

শুক্ল চাকমা দীর্ঘদিন ধরে ব্ল্যাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন। সে দীর্ঘ কয়েক মাস যাব ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিসাধীন থাকার পরও শারিরীক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে খাগড়াছড়িতে নিয়ে আসা হয়। সে প্রাণপন চেষ্টা করেছিলো ক্যান্সরের বিরদ্ধে জয়ী হওয়ার। কিন্তু জয়ী হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হেরে গেলো। গতকাল শনিবার(২৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে সে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে।

মৃত্যুর দু’দিন আগে তাকে দেখতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন সে ক্যান্সরের যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো। সে কথা বলতে ও লোকজনকে চিনতে পারছিলো না। যার কারণে সেদিন তার সাথে আর কোন কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার রোগ যন্ত্রণা উপশমের আশায় সেদিন বাড়িতে ভিক্ষু ডেকে পরিত্রাণ সূত্র শ্রবণ করা হয়েছিল।

আজ রবিবার সকালেও শেষবারের মতো তাকে দেখতে গিয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখি তার বাবা অসহায়ভাবে বাড়ির বাইরে এক কোণায় বসে রয়েছে। তাকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কোন কিছুই ছিল না।

শুক্ল বিকাশ চাকমা আত্মীয়তার সম্পর্কে আমার ভাতিজা হয়। সে আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোট। আমরা একই এলাকার বলতে গেলে একই গ্রামের লোক।  ইউপিডিএফে যোগ দেয়ার আগে সে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলো। পরে সরাসরি ইউপিডিএফে যোগ দিয়ে একনিষ্টভাবে সংগঠন গড়ার কাজ করেছিলো। সে যখন পার্টিতে যোগ দেয় তখন আমি ঢাকায় অবস্থান করছিলাম। তার ইউপিডিএফের যোগদানের খবর পেয়ে আমি যে কি পরিমাণ খুশী হয়েছিলাম তা বলার মতো নয়।

শুক্ল চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে একজন যোগ্য কর্মী হয়ে গড়ে উঠার অবস্থায় ছিলো। সে বেঁচে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভাগা জুম্মদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিশ্চয় কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারতো। তার অকাল মৃত্যুতে পার্টি ও জনগণ একজন একনিষ্ট সংগ্র্রামী সহযোদ্ধাকে হারালো। এ ক্ষতি কিছুতেই পূরণ হবার নয়। তবে, সে যে আদর্শে বলীয়ান হয়ে লড়াই-সংগ্রামে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলো সে আদর্শের কোন মৃত্যু নেই।


শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

শহীদ রূপক চাকমার স্মরণে

আজ ২১ সেপ্টেম্বর শহীদ রূপক চাকমার ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০১ সালের এই দিনে ইউপিডিএফ’র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় পানছড়ির মধুমঙ্গল পাড়ায় সন্তু লারমার লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মৃত্যুর ১২তম বার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করেই আজ এই সংক্ষিপ্ত লেখা।

আমার অনুসরণীয় ব্যক্তিদের মধ্যে রূপক চাকমা ছিলেন একজন। তার সাথে কাজ করার তেমন বেশি সুযোগ না হলেও যে ক’বার তার সাথে সফরসঙ্গী হয়েছি তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা ও চালচলনে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি।

মনে পড়ছে ১৯৯৯ সালের কথা। রূপক দা সহ পিসিপি’র কেন্দ্রীয় একটি সফর দল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি সফর করে। এ সফর দলে আমিও যোগ দিই। সফর দলে আরো অনেকে ছিলেন, যারা আর এখন পার্টি বা সংগঠনের সাথে যুক্ত নেই। খাগড়াছড়ির মাইসছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে কমিটি গঠনের পর সফর দলটি রাঙামাটির নান্যাচর উপজেলার ঘিলাছড়িতে যায়। সেখানে গিয়ে চৈ ছড়ি নামক একটি গ্রামে আমরা রূপক দা সহ একটি বাড়িতে রাতযাপন করি। যতদূর মনে পড়ে ২১ জানুয়ারি ঘিলাছড়ি ইউপি কমিটি গঠনের পর বিকেলে আমরা রওনা দিই লক্ষীছড়ির উদ্দেশ্যে। ঘিলাছড়ি মৌন পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে আমরা লক্ষীছড়ির পেক্কো আদামে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে রাতযাপন করা হয়। পরদিন আমরা রওনা দিই লক্ষীছড়ি উপজেলা সদরের উদ্দেশ্যে। বিকেলের দিকে আমরা মরাচেঙের বাদী পাড়া নামক এলাকায় গিয়ে পৌঁছি।

২৪ জানুয়ারি লক্ষীছড়ি থানা শাখার সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এ সম্মেলন বানচাল করার জন্য প্রশাসন চক্রান্ত করে ১৪৪ ধারা জারি করে। এদিন রূপক দা সহ অন্যান্য নেতারা ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সহিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হন। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সেদিন আমাদের সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

মৃত্যুর কিছুদিন আগেও রূপক দা লক্ষীছড়ি সফর করেন। সে সময়ও তার সাথে থাকা-খাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। সেখানে অবস্থানকালে তিনি প্রচণ্ড ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন। ঔষধ সেবনের পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও তখন পর্যন্ত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ অবস্থায় পানছড়ি এলাকায় ইউপিডিফ’র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য তার উপর দায়িত্ব পড়ে। তিনি কোন কার্পণ্য না করে লক্ষীছড়ি থেকে খাগড়াছড়িতে যান নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। কিছুদিন পরই তার মৃত্যুর খবর শুনতে পাই।

রূপক দা আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার যে চেতনা, তার যে আদর্শ সেটা কোনদিন মুছে যাবে না। জুম্ম জাতির আদর্শের প্রতীক হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন।

রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৩

প্রসিত দা’র যে চিঠি আমাকে উজ্জ্বীবিত করে

২০০৪ সালের ২৫ মে। প্রায় দুই মাস চিকিসা শেষে সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। তখন মানসিক ও শারিরীকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কারণ আমার যে একটি পা কেটে বাদ দেয়া হয়েছে। তখনও এক পায়ে ভর দিয়ে ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারি না। সহযোদ্ধা বন্ধুদের সাহায্য নিয়েই সব কাজ ছাড়তে হতো। ঠিক এই সময়েই প্রসিত দা’র চিঠি হাতে পেলাম। যে চিঠি আমাকে অনেক উজ্জ্বীবিত করে। সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়। জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিজেকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে উসাহিত করে।

প্রসিত দা’র লেখা সেই চিঠির মূল অংশটি এখানে তুলে ধরছি:

...পার্টি ও আন্দোলনে অবদান রাখার মতো তোমার যে একাগ্রতা, উদ্যম আর গুণাবলী আছে, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। পার্টির সম্ভাবনাময়ী তরুণ নেতৃত্বের সাড়িতে তুমিও একজন বলে আমরা বিবেচনা করি। নতুন যুগের লড়াই সংগ্রামের সাথে তুমি এখন আরো বেশী ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গেছো।

মনে রাখবে, মানুষের সাহস, উদ্যম, একাগ্রতা আর কঠিন সংকল্পের কাছে কোন বাধাই বাধা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের’এর কথা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে। একজন সেক্টর কমান্ডার হয়েও তিনি নিজে সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমে সৈনিকদের পরিচালনা করেছেন। যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের বোমার আঘাতে তার ডান পা উড়ে গেছে। ডান পা হারিয়েও কর্ণেল তাহের ছিলেন অদম্য মনোবলের অধিকারী। সৈনিকদের মাঝে ছিলেন একজন প্রিয় কমান্ডার। মুক্তি বাহিনীতে এবং পরবর্তী কালে দেশ স্বাধীন হলে, সেনাবাহিনী পুর্ণগঠনের ক্ষেত্রে তার অনেক অবদান রয়েছে। কমান্ডার হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। অফিসে বসেই সৈনিকদের পরিচালনা করেছেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট উন্নত করার পেছনে তার অবদান রয়েছে। ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব তিনিই সংঘটিত করেছেন। এক জন সুদক্ষ কমান্ডার হিসেবে কর্ণেল তাহের'এর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও সাধারণ মানুষের মতো সুস্থ ছিলেন না। ছোটবেলায় তার পোলিও হয়েছিলো। সে কারণে তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। রোগা হয়েও তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সৈনিকদের উজ্জীবিত করার জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে তাকে হুইল চেয়ারে করে নৌ বাহিনীর জাহাজে নেয়া হয়েছিলো।

মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ সেনাপতি তৈমুর লঙ'এর পাও ছিলো খোঁড়া। তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। অথচ এই তৈমুর লঙ গোটা মধ্য এশিয়া দাবড়ে বেড়িয়েছেন। তার নাম শুনলে সে যুগে প্রতিপক্ষ সৈন্যদের বুক কাঁপতো।

প্যালেষ্টাইনের হিজবুলস্নাদের নেতা মোহাম্মদ ইয়াসিনও একজন পঙ্গু। তিনি উঠতে বসতে অক্ষম। হুইল চেয়ারে করে তাকে চলতে ফিরতে হয়। অথচ এই ইয়াসিন প্যালেষ্টাইনে এক জঙ্গী আন্দোলনের নেতা।

পৃথিবীতে এ ধরনের আরো বহু জ্ঞানী-গুণী বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন, যারা শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়েও দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা সংঘটিত করেছেন। আসলে মানুষের প্রতিভা থাকলে তার বিকাশ ঘটবেই।...

প্রসিত দা’র এই চিঠি থেকেই আমি ফিরে পেয়েছি জীবনের সঞ্জীবনী শক্তি। তাঁর এই চিঠি আমার নতুন জীবনের (এক পায়ে চলা জীবন) চলার পথে পাথেয় হয়েই থাকবে।




সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৩

সরকারের চাপিয়ে দেয়া বাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন

আজ ৩০ জুন সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাসের ২ বছর। ২০১১ সালের এ দিন আওয়ামী লীগ সরকার গায়ের জোরে জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের সকল সংখ্যালঘু জাতিসমূহের উপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়। উক্ত সংশোধনীতে ৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” অর্থা এদেশে বাঙালি ছাড়া আর কোন জাতির অস্তিত্ব নেই বলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে ঘোষণা করা হয়।

আজকের এ দিনটি ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং উজ্জ্বলতম দিনও। আজ “সান্তাল হুল” দিবস। যা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামে অধিক পরিচিত।  ১৮৫৫ সালের এদিন  সান্তাল সম্প্রদায়ের চার ভাই সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরোর নেতৃত্বে সান্তাল জনগোষ্ঠি সহ স্থানীয় জনতা এক গণসমাবেশ থেকে সর্বাত্বক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অস ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সান্তাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।

সান্তালরা ইংরেজ বাহিনীর বন্দুক ও কামানের বিপরীতে তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। এ যুদ্ধে সিদ-কানহু-চান্দ ও ভাইরো সহ অনেক সান্তাল যোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বৃটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

যেদিন জাতীয় সংসদে এই বিতর্কিত পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী আইন পাস করা হচ্ছিলো সেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ভোটে নির্বাচিত তিন এমপি কোন প্রতিবাদ না করে বিলের পক্ষে (বাঙালি জাতীয়তার পক্ষে) টেবিল চাপড়িয়ে ভোট প্রদান করে পাহাড়ি জনগণের সাথে চরমভাবে বেঈমানী করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণকে অতীতেও বাঙালি বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর ক্ষমতার দম্ভে মদমত্ত শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশকে একক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাহাড়ি জনগণকে বাঙালি হয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সংবিধানে তাদেরকে বাঙালি বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু সেদিনও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ শেখ মুজিব ও উগ্রবাঙালি জাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া বাঙালি জাতীয়তা মেনে নেয়নি।

ক্ষমতার জোরে, বলপ্রয়োগ করে অনেক কিছু করা যায়; কিন্তু এক জাতিকে অন্য একটি ভিন্ন জাতিতে রূপান্তরিত করা যায় না। পার্বত্য  চট্টগ্রামে সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খিয়াং, চাক, খুমী, লুসাই, পাংখো, সাঁওতাল, গুর্খা-অহোমী জাতির জনগণ কখনো নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেবে না। আওয়ামী সরকারের বাঙালি বানানোর এই ঘৃণ্য অপচেষ্টাকে রুখতেই হবে।

ইউপিডিএফ এই বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাসের পরপরই বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।  পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। জেলা ও থানা সদরে বিক্ষোভ সহ তিন পার্বত্য জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে। গত বছর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।

এই সরকারের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু সরকার এখনো এই বিতর্কিত সংশোধনী প্রত্যাহার না করে সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তা বহাল রেখেছে।  তাই এই সংশোধনী বাতিল করে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের নিজ নিজ জাতীয় পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে আমাদের তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে আমাদের সরকারের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে হবে।

তাই আসুন সরকারের চাপিয়ে দেয়া বাঙালি জাতীয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলি:

সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল কর, করতে হবে
আমরা বাঙালি নই, আমাদের নিজস্ব জাতীয়তার স্বীকৃতি দাও, দিতে হবে
পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা কর, করতে হবে
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা-সেটলার প্রত্যাহার কর, করতে হবে
পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি আইনের স্বীকৃতি দাও, দিতে হবে



বুধবার, ১২ জুন, ২০১৩

কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে সরকারের এত অনীহা কেন?

আজ ১২ জুন কল্পনা চাকমা অপহরণের ১৭ বছর পূর্ণ হল।  ১৯৯৬ সালের এই দিনে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়িতে কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার লে. ফেরদৌস কর্তৃক কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছিলো। কিন্তু রাষ্ট্র তথা সরকার আজো কল্পনা চাকমার কোন হদিস দিতে পারেনি।

কল্পনা ছিলো রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক প্রতিবাদী কন্ঠ। ভয়-ভীতি, হুমকী, প্রলোভন দেখিয়ে নিপীড়ক সেনা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি তাকে কখনই জব্দ করতে সক্ষম হয়নি। স্বভাবতই কল্পনা ছিলো কায়েমী স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির নিকট আতঙ্কের কারণ। তার সাথে রাজনৈতিক যুক্তি-বিশ্লেষণ ও অন্য কোন কিছুতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে, সেনা কায়েমী স্বার্থবাদী চক্রটি এক ঘৃণ্য ন্যাক্কারজনক পন্থা অবলম্বন করে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত অবস্থায়, কল্পনা নিজ বাড়ীতে লে. ফেরদৌসের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য দ্বারা অত্যন্ত কাপুরুষোচিতভাবে অপহরণের শিকার হয়।

কল্পনা চাকমা যখন অপহৃত হয় তখন দেশে ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাত্র ৭ ঘন্টা আগেই সে অপহরণের শিকার। কল্পনা চাকমার মতো একজন নারীকে নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

অপহৃত কল্পনাকে উদ্ধার, তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ এবং চিহ্নিত অপহরণকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার দাবিতে সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। দেশের বাইরেও কল্পনা অপহরণ ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে চিঠি দেয়।

অপরদিকে, অপরাধ ধামাচাপা দিতে দেশের গোটা সেনাবাহিনী তপর হয়ে উঠে। সামরিক হেলিকপ্টারে রাঙ্গামাটি সহ বেশ কিছু এলাকায় কল্পনা চাকমার সন্ধান চেয়ে লিফলেট বিলি, সন্ধান দাতার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা, সেনা সদরের আইএসপিআর থেকে বিবৃতি প্রকাশ, সাইনবোর্ড সর্বস্ব একটি মানবাধিকার সংস্থাকে দিয়ে ত্রিপুরার গন্ডাছড়া গ্রামে কল্পনা চাকমার সন্ধান লাভ এবং সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ, খোদ তকালীন সেনা প্রধান লেঃ জেনারেল মাহবুব কর্তৃক ঘটনাকে “হৃদয়ঘটিত” বলে মিথ্যা বিবৃতি দান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম সদস্য প্রফেসর ইউনুস কর্তৃক সেনা প্রধানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিবৃতিদান... ইত্যাদির মাধ্যমে ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আজো এ চক্রটি কল্পনা চাকমাকে নিয়ে এ ধরনের মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

তারপরও দেশ-বিদেশের ব্যাপক জনমত ও আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার ঘটনা তদন্তে ১৯৯৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজো প্রকাশ করা হয়নি।

এরপর ২০১০ সালের ২১ মে বাঘাইছড়ি থানার এস আই ফারুক আহম্মদ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এতে তিনি কল্পনা চাকমার সন্ধান পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে মামলাটি বাতিল করার আবেদন জানান। এর বিরুদ্ধে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা না-রাজি আবেদন জানান।

বিচারক সিআইডির মাধ্যমে পুনর্বার তদন্তের নির্দেশ দিলে সিআইডি কর্মকর্তা মোঃ শহীদুল্লাহ ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করেন। কিন্তু উক্ত তদন্ত রিপোর্টেও প্রকৃত দোষীদের নাম উল্লেখ করা হয়নি বরং উক্ত তদন্ত রিপোর্টে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে কল্পনা অপহরনের সাথে জড়িতদের রক্ষার চেষ্টা করা হয়।

সর্বশেষ সিআইডির দাখিল করা এ রিপোর্টের উপর দু’দফা শুনানী শেষে এ বছর অর্থাত ২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারী রাঙামাটি মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত আবারো পুলিশ সুপারকে দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। যা কোনভাবেই গ্রহণ যোগ্য হতে পারে না।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন সহ বিভিন্ন সংগঠন আদালতের এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার সঠিক তথ্য অনুসন্ধানের জন্য নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন ও চিহ্নিত অপহরণকারীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেনি।

কল্পনা অপহরণের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এমনকি দেশের বাইরেও এত বিক্ষোভ আন্দোলন, রূপনের মতো স্কুল ছাত্রের আত্মবলিদান, সমর-সুকেশ ও মনোতোষের গুম হওয়া এবং এত লেখালেখি, এত প্রতিবাদ, নিন্দার ঝড় সত্ত্বেও রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

মূলত এ রাষ্ট্র, সরকার এবং এ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী, নিরাপত্তা ব্যবস্থা-- দেশের সংখ্যালঘু জাতি, সমাজের প্রান্তিক-দুর্বল-অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠি এবং নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরে থাক, উল্টো নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকী হয়ে দাঁড়ায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় সংঘটিত এ যাবতকালের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে এর প্রমাণ মেলে।

সরকার তথা রাষ্ট্রের অনীহার কারণেই আজ ১৭ বছরেও কল্পনা চাকমার কোন সন্ধান মিলেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে এ দেশের সরকারের এত লুকোচুরি, এত অনীহা কেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ও দেশবাসীর কাছে সরকারকে এর যথাযথ জবাব দিতেই হবে।


রবিবার, ৫ মে, ২০১৩

আজ লংগদু গণহত্যার দুই যুগ

আজ ৪মে ২০১৩ লংগদু গণহত্যার দুইযুগ পূর্ণ হলো। ১৯৮৯ সালের এই দিনে রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় আর্মি ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর(ভিডিপি) সহায়তায় সেটলাররা পাহাড়ি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করে এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মুর্তি ধ্বংস করে। সেটলারদের এহামলায় বহু পাহাড়ি হতাহত হয়।

সময়ে এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, প্রাক্তন সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান ,প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তকালীন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এবং রাঙামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট পাহাড়ি নেতা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।

স্মারকলিপিতে তারা এ হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “উপজেলা সদরেসব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য, লংগদু ইউনিয়নপরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান  ও ৩নং লংগদু মৌজারহেডম্যান অনিল বিহারী চাকমা তার বাসভবনে হামলার শিকার হন। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচেগেলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের অনেকে(যারা হেডম্যানের বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছিল) এইনির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকারীরা দা, বল্লম ইত্যাদি সহ আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারাগুলি করে এইসব নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি। মৃতদেহগুলিবাড়ীতে ফেলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অনিল বিহারী চাকমা তার স্ত্রীর মৃতদেহবাড়ী থেকে বের করে বাড়ীর পাশ্ববর্তী জঙ্গলে সারারাত পাহারা দিয়ে রাখেন। ভোরের দিকেথানায় খবর দিতে এসে উদ্ধার করতে গেলে পরবর্তীতে মৃতদেহের কোন হদিস পাননি। পরিস্থিতিরএমন ভয়াবহতায় মৃতদেহগুলি ধর্মীয় বিধিতে পর্যন্ত সকার করা সম্ভব হয়নি। ” ((তথ্য সূত্র: রাডার, লোগাঙগণহত্যা সংখ্যা)।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি- এ বর্বর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ সে সময় বাংলাদেশের কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। 

এই  হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর পার্বত্যচট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অভ্যুদয় ঘটে।  লোমহর্ষক এ গণহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর জন্য ঢাকার রাজপথে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১৯৮৯ সালের ২১শে মে মৌন মিছিল সহকারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ এ বর্বরতমহত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে। 

কিন্তুদীর্ঘ দুই যুগ অতিক্রান্ত হলেও কোন সরকারই এ হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।   লংগদু গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাব ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হলেও কোন ঘটনারই সঠিক তদন্ত রিপোর্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি।   

আজ এইহত্যাযজ্ঞের দুই যুগের দিনে সকলের  প্রতি আহ্বানজানাই, আসুন পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবতা বিরোধী এসব হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের  আওতায় নিয়ে এসে  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চাই হই।  

শেষে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- ‘হে শৃংখলিত তারুণ্য, কোন সরু পথ খোলা নেই তোমার সম্মুখে।  বিক্ষুব্ধ জনতার ভীড়ে নিরুপায় প্রজন্মকে প্রতিবাদী হতেই হবে। জড়াগ্রস্ত নেতৃত্বের সুবিধাবাদী চরিত্রের চোয়াল ভাঙো। বিকলাঙ্গ রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার গালে প্রতিবাদের আচড় বসাতেই হবে। নচেৎ অর্থহীন এ তারুণ্য। একই সাথে বিকৃত ও ধিকৃত সেই যৌবনও।”