বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১১

হরি কিশোর চাকমার “রাজনৈতিক হিপোক্রেসি, ঐক্য ও আমার কিছু কথার” জবাবে

আমি হরি কিশোরদার লেখা “রাজনৈতিক হিপোক্রেসি, ঐক্য ও আমার কিছু কথা” শীর্ষক ফেসবুক নোটটি পড়েছি৷ তার প্রতি সম্মান রেখে বলতে চাই, তিনি মহা হিপোক্র্যাট দীপায়ন খীসার সাথে যেভাবে তাল, লয় ও সুর মিলিয়েছেন তাতে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক৷ এটা বলা কি অত্যুক্তি হবে যে, ফ্যাসিস্ট সন্তু লারমার পক্ষে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে সক্ষম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো হরি কিশোরদার মতো মানুষদের মধ্যে তার (সন্তু লারমার) সাপোর্ট বেস থাকা? স্বৈরাচারী এরশাদ ৯ বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন, কারণ শাহ মোয়াজ্জেম ও কাজী জাফরদের মতো ভ্রষ্টরা ছাড়াও বহু বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক ও টিভি উপস্থাপক (যেমন রেজাউর রহমান) তাকে নানা সুবিধার বিনিময়ে সমর্থন যুগিয়েছিল৷

হরি কিশোরদা হয়তো তার "প্রিয় নেতা" সন্তু লারমাকে ফ্যাসিস্ট বললে মনোকষ্ট পেতে পারেন, কিন্তু তাতে আমার কিছু করার নেই৷ আমি তার ফ্যাসিস্ট নীতি ও আচরণের পক্ষে অকাট্য তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো৷ তাই বলে আমি বা ইউপিডিএফ সন্তু লারমাকে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অবজ্ঞা করছি মনে করা ভুল হবে৷ আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে তার ইতিবাচক ভূমিকার কথা অকপটে স্বীকার করি, কিন্তু সাথে সাথে এটাও আমরা বলতে দ্বিধা করি না যে, তার বহু গুরুতর রাজনৈতিক ভুল রয়েছে, যার মাসুল অতীতে জুম্ম জনগণকে দিতে হয়েছে এবং এখনো দিতে হচ্ছে৷ সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই৷ তবে আমি এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা তাকে এবং পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই৷ আর তা হলো, চুক্তির আগে সন্তু লারমা যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে সশস্ত্র সংগ্রামে রত ছিলেন, তখন বর্তমান ইউপিডিএফ নেতারাই সন্তু লারমা ও জেএসএস-কে নানাভাবে সমর্থন করেছিলেন৷ অপরদিকে হরি কিশোর দা, সে সময় জেএসএস-এর তীব্র বিরোধিতা এবং সেনা-সৃষ্ট তখনকার গণধিকৃত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ানের পক্ষ হয়ে কাজ করেছিলেন৷ এ সম্পর্কে আরও অনেক বলার ছিল৷ কলেবর বৃদ্ধি হবে বলে তা ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখলাম৷

যাই হোক, আমি হরি কিশোরদার উপরোক্ত লেখার প্রেক্ষিতে যে কয়টি কথা বলতে চাই তার প্রথমটি হলো এই, ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) এর মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব বিরোধ মীমাংসায় তিনি নিজেকে এক বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছেন৷ তিনি অবশ্যই সমাধানের জন্য সুপারিশ করতে পারেন৷ সে অধিকার তার রয়েছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কেমন বিচারকের ভূমিকা নিয়েছেন? তিনি কি আদৌ নিরপেক্ষ? তিনি কি উভয় পক্ষের সকল যুক্তি, তথ্য, নীতি, কৌশল ও কার্যকলাপ সামগ্রিকভাবে ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে তার রায় প্রদান করেছেন? দুঃখিত, অন্ততঃ তার লেখা পড়ে আমার তা মনে হয়নি৷ কারণ তিনি ইউপিডিএফ-এর চুক্তির যৌক্তিক সমালোচনা ও বিরোধিতাকে গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা হিসেবে না দেখে বরং তাকে "অপরাধ" হিসেবে দেখেছেন ও তার জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছেন৷ অপরদিকে সন্তু লারমার অনুগতরা সারেন্ডারের পর পরই একের পর এক যে খুনের উত্‍সবে মেতে উঠেছিল তার জন্য সন্তু লারমাকে ক্ষমা চাইতে বলা দূরের কথা, তিনি সে সব জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা বেমালুম চেপে গেছেন৷ তাছাড়া, পর পর তিন বার সমঝোতা হওয়ার পরও সন্তু গ্রুপ যে সে সব সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করেছিলেন তার জন্যও তিনি ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেননি৷ এটা কি ন্যায় বিচার? এটা কোন ধরনের নিরপেক্ষতা ও সাধুতা?

ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাইতে ইউপিডিএফ-এর পক্ষ থেকে আপত্তি থাকার কথা নয়৷ জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করা ও ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি ইউপিডিএফ চর্চা করে থাকে৷ কিন্তু যে ভুল ইউপিডিএফ করেনি সেই ভুলের জন্য তাকে দায়ী বা অপরাধী সাব্যস্ত করে ক্ষমা চাইতে বলার মানে কী? কার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এসবের অবতারণা?

হরি কিশোরদা আরো লিখেছেন: "সে সময়ের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে ইউপিডিএফের চুক্তি বাস্তবায়ন চাওয়া আর ঐক্যের ডাক দেওয়াকে অনেকে রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টির চেষ্টা বলতে মনে করলে তাকে কি দোষ দেওয়া যাবে৷" ইউপিডিএফ-এর "চুক্তি বাস্তবায়ন চাওয়া ও ঐক্যের ডাক দেওয়াকে" তিনি কেন বাঁকা চোখে দেখছেন তা বোঝা মুশকিল৷ চুক্তি বাস্তবায়ন ইউপিডিএফ-এর নিজস্ব কর্মসূচী নয়৷ একমাত্র হানাহানি ও রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যেই ইউপিডিএফ এত বড় ছাড় দিয়েছে৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, দুনিয়ায় আর কয়টা পার্টি উদারভাবে এ ধরনের ছাড় দিতে পারে? ইউপিডিএফ-এর এই ছাড়ের প্রেক্ষিতে জেএসএস কি আজ পর্যন্ত কোন ছাড় দিয়েছে? উত্তর হলো: A BIG NO. অথচ তারপরও ইউপিডিএফ হরি কিশোরদার কাছে ভালো হতে পারলো না৷ জেএসএস সন্তু গ্রুপের কাছে তো নয়ই৷ জাতীয় স্বার্থে ইউপিডিএফ-এর এই যে ছাড় -- তার জন্য ইউপিডিএফ-কে ধন্যবাদ দেয়ার পরিবর্তে তিনি বিভ্রান্তি সৃষ্টিরই চেষ্টা করছেন৷ তা না হলে তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করতে পারতেন না৷

আর রাজনৈতিক ইস্যু বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন তাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়৷ "চুক্তি বাস্তবায়ন চাওয়া ও ঐক্যের ডাক দেওয়া" অবশ্যই একটি রাজনৈতিক ইস্যু৷ এটা কোন অরাজনৈতিক, পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত ইস্যু নয়৷ তিনি কি "রাজনৈতিক ইস্যু" বলতে political gimmick বা stunt বোঝাতে চেয়েছেন? সেটা যদি হয়, তাহলে বলবো এটা হবে তার একটা মনগড়া ধারণা৷ স্ট্যান্টবাজি কিনা আপনি পরখ না করে বলতে পারবেন না৷ আর পরখ করার একটাই মাত্র উপায়, আর তা হলো সংঘাত বন্ধ করা ও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনে যাওয়া, যা একমাত্র সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস-ই করতে পারে৷

হরি কিশোরদা সন্তু লারমার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেছেন৷ সন্তু লারমার বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমারও কোন সন্দেহ নেই৷ তার মাথায় ঘিলু না থাকলে কী তিনি এত লোককে বিভ্রান্ত করতে ও এতকাল ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখতে পারতেন? কিন্তু তারপরও আমি বুঝতে পারি না, যে নেতা "প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে এসে মুল বিষয়টা ধরে ফেলেন, সবার চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন"(যা দুইঘন্টা, তিনঘন্টা অর্ধশত থেকে শতাধিক বা তারও বেশি মানুষ আলোচনা-তর্ক করে ধরতে পারে না), তিনি কেন চুক্তির শুভঙ্করের ফাঁকি তখন ধরতে পারেন নি? কেন-ই বা অলিখিত চুক্তি করে বসেছিলেন? আর কেন-ই বা বর্তমানে জনগণের এত বড় ঐক্যের আকাঙ্ক্ষাকে "ধরতে" পারছেন না? তাইতো প্রশ্ন, গণ আকাঙ্ক্ষাকে ধরতে পারা কি কেবল বুদ্ধিমত্তার বিষয়? নাকি এর সাথে অন্য ব্যাপারও জড়িত আছে? আসলে মানুষ যখন স্বার্থান্ধ হয়ে যায় তখন তারা অনেক কিছু দেখতে পায় না বা দেখেও না দেখার ভাণ করে৷ আমার তো মনে হয়, সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদের গদি হারানোর ভয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করেন না৷ আমি চাই আমার এই অনুমান মিথ্যা হোক৷ কিন্তু যতদিন সন্তু লারমা বাগাড়ম্বর ছেড়ে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রকৃত আন্দোলনে যাচ্ছেন না, ততদিন এই অনুমান সত্য হিসেবেই ধরে নিতে হবে৷ যেভাবে নতুন তথ্য প্রমাণ হাজির না করা পর্যন্ত একটি বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত বা অনুমানকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়৷

মোট কথা, ইউপিডিএফ-এর ঐক্যের প্রস্তাব ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের আহ্বানকে হিপোক্র্যাসি বলে প্রতিপাদন করার চেষ্টা চরম অন্যায়৷ এর মাধ্যমে সন্তু লারমার ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানির যে নীতি ও কার্যক্রম তাকে প্রত্যভাবে উত্‍সাহিত করা হয়৷ আশা করি, হরি কিশোরদা বিষয়টি আরো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখবেন৷ শেষে ঐক্যের গণআকাঙ্ক্ষা বলবতী ও ফলবতী হোক সেই কামনা করছি৷

মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১১

ঐক্যের বিরোধীদের প্রতি



ইউপিডিএফ থেকে বহিষ্কৃত ও বর্তমানে সন্তু লারমার মুরীদ দীপায়ন খীসার "ঐক্যের ফেরিওয়ালাদের কাছে কিছু বিনীত নিবেদন" শিরোনামের লেখাটি পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত "দুই বিঘা জমি" কবিতাটি মনে পড়লো৷ এই কবিতার বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ হলো এই -- হতদরিদ্র উপেনের শেষ সম্বল ছিল দুই বিঘা জমি৷ তাও জমিদার ষড়যন্ত্র করে কেড়ে নেয়৷ ভিটেমাটি-হারা ছন্নছাড়া হয়ে উপেন নানা জনপদ ভ্রমণ করেন কিন্তু তার জমি হারানোর শোক ভুলতে পারেন না৷ বহু বছর পর ভূমির মায়ায় তিনি একদিন নিজ গ্রামে ফিরে আসেন৷ ইত্যবসরে তার সেই দুই বিঘা জমির আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে৷ তবে প্রাচীরের কাছে একটি আমগাছই কেবল অক্ষত আছে৷ সেটা দেখে তার বাল্যকালের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়৷ এমন সময় বাতাসে দু'টি আম তার সামনে পড়লে তিনি সেগুলো কুড়িয়ে নেন৷ আর তখনই যমদূতের মতো হাজির হয়ে মালী তাকে বন্দী করে জমিদারের কাছে নিয়ে যায়৷ জমিদার ক্রোধে ফেটে পড়েন:

শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন'৷
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ৷
আমি কহিলাম, 'শুধু দু'টি আম ভিখ মাগি মহাশয়৷'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।

সত্যি আজ কবিতার জমিদার বাবুর মতো যারা জনগণের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে তারাই সাধু, নীতিভ্রষ্ট আদর্শচু্যত দীপায়নরাই আজ 'প্রকৃত দেশপ্রেমিক', আর আমরা যারা উপেনের মতো কেবল ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের "ভিখ মাগছি" তারাই হয়ে গেলাম 'হিপোক্র্যাট'৷ ভূমিদস্যু জমিদার ক্রোধে ফেটে পড়েছেন কেবল দুটি আমের জন্য৷ আর দীপায়ন বাবু "শান্তিবাদী"দের ওপর ক্রোধে ফেটে পড়ছেন সংঘাত বন্ধের দাবি করায়৷ জমিদার নিজে ভুমি দস্যু হয়েও উপেনকে চোর বলে গালি দেয়, আর হিপোক্রেসির পরাকাষ্ঠা দীপায়ন বাবু অডং, অমিত হিল ও ইউপিডিএফসহ যারা শান্তির পক্ষে তাদের বলেন হিপোক্র্যাট৷ কবি শামসুর রাহমানের কবিতার প্যারোডি করে বলতে ইচ্ছে করে, এক অদ্ভুত গাধার পিঠে চলছে জেএসএস!

দীপায়ন বাবুর লেখায় স্পষ্ট হয়েছে, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ না হওয়ার জন্য কেবল সন্তু লারমা নয়, তার আশেপাশে যে সব চামচা চাটুকার রয়েছেন, তারাও কম দায়ী নন৷ 'বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ৷' দেখা যাচ্ছে সন্তু লারমা একবার ইউপিডিএফ নির্মূলের কথা বললে তার "পরিষদ-দল" অর্থাত্‍ দীপায়ন বাবুর মতো চাটুকার-চামচারা তার শতগুণ বলছেন৷ তাই পাহাড়ে রক্ত ঝরছে অবিরাম, মায়ের কোল খালি হচ্ছে একের পর এক আর বিধবা হচ্ছেন অসংখ্য জুম্ম নারী৷ ইতিহাস কি এই চাটুকারদের ক্ষমা করবে?

আমি বলবো যারা ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছেন, যারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন, তাদের কটাক্ষ ও হেয় প্রতিপন্ন করে দীপায়ন বাবু যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, তা যেমন ক্ষমার অযোগ্য, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এক অশনি শঙ্কেত৷ সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয়, নিজে আদর্শচ্যুত হয়ে, রাজনৈতিক দিগবাজী খেয়ে তিনি অন্যকে হিপোক্র্যাট না হওয়ার উপদেশ বর্ষণ করছেন৷ এর থেকে চরম ভণ্ডামী আর কী হতে পারে! নিজে চোর হয়ে সাধুদের চুরি না করার পরামর্শ দিচ্ছেন৷ সবার মনে রাখা উচিত দীপায়ন বাবুর মতো রাজনৈতিক ভণ্ড ও দিগবাজী বিশারদরা আন্দোলনের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক৷ এদের ব্যাপারে সচেতন থাকাই জাতি ও জনগণের জন্য মঙ্গল৷ এদেরকে ইউপিডিএফ থেকে বিতাড়িত করা গেছে বলেই ইউপিডিএফ এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে৷ এরা যতদিন পার্টিতে ছিল, ততদিন পার্টিকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে৷ পার্টি একই জায়গায় ঘুরপাক খেয়েছে৷

মাছিরা যেমন মরা প্রাণীর দেহে গিয়ে ভিড় করে, দলচ্ছুট সুবিদাবাদী দীপায়ন বাবুরাও নীতি আদর্শহীন মরা পার্টিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ যেখানে মাছি ভন্ ভন্ করে, মনে করতে হবে সেখানে কোন মরা প্রাণী আছে৷ ঠিক তেমনি দীপায়নরা যে পার্টিতে ভিড় করে, মনে করতে হবে সে পার্টি রাজনৈতিকভাবে মরে গেছে বা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে৷ মাছিরা যেমন জীবন্ত মানুষের গায়ে পড়া মাত্র তাড়া খেয়ে অন্যত্র উড়ে যেতে বাধ্য হয়, দীপায়নরাও ইউপিডিএফ-এর মতো একটি আদর্শবাদী পার্টি থেকে বহিস্কৃত হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়৷

দীপায়ন বাবুর লেখার জবাব ইতিমধ্যে অডং চাকমা ও অমিত হিল চমত্‍কারভাবে দিয়েছেন৷ তার এই লেখার জবাব নতুন করে আর দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না৷ তবুও যেহেতু অডং চাকমা ইউপিডিএফ-এর দিক থেকে মন্তব্য আশা করছেন, সেজন্য দু' একটা কথা না বলে পারছি না৷

প্রথমত, দীপায়ন বাবুর লেখা পড়ে মনে হয়েছে ঐক্যের পক্ষে কথা বলা, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের দাবি করা তার কাছে যেন অপরাধ৷ অডং চাকমা ও অন্যান্যরা যেন সেই অপরাধ করেছেন৷ আমি বলবো, ঐক্যের পক্ষে কথা বলা যদি অপরাধ হয়, তাহলে সেই অপরাধ বার বার করা উচিত৷

দ্বিতীয়ত, ফেইসবুক ও ইন্টারনেটের অন্যান্য সোসাল মিডিয়ায় ঐক্য সম্পর্কে যে আলোচনা হচ্ছে, তা বৃথা যাচ্ছে না৷ দীপায়ন যে জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) এর পক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হয়েছেন, এটা তারই প্রমাণ৷ সেজন্য আমাদের সবার উচিত হবে এই আলোচনাকে গভীরতর এবং আরো প্রসারিত করা৷ একে একটি আন্দোলনের রূপ দেয়া৷ এটা আজ প্রমাণিত সত্য যে, চরম গণবিরোধী ফ্যাসিস্টরা প্রথম দিকে গণদাবি উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখালেও শেষ পর্যন্ত ব্যাপক আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়৷

তৃতীয়ত, দীপায়নের মতে, ইউপিডিএফ ঐক্যের প্রস্তাব দিয়ে, চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে সাবালকত্ব নয়, নাবালকত্বেরই প্রমাণ দিয়েছে৷ মেনে নেয়া গেল, ইউপিডিএফ নাবালক, কিন্তু আমাদের সন্তু গ্রুপ তার সাবালকত্ব কীভাবে প্রদর্শন করেছে? সন্তু গ্রুপ ঐক্যের প্রস্তাব ও চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাসের জবাব দিয়েছে ইউপিডিএফ নেতা কর্মীদের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে; ইউপিডিএফ-এর বাড়িয়ে দেয়া বন্ধত্বের হাতে হাত মিলিয়ে নয়৷

আসলে ইউপিডিএফ তো সেই সত্যবাদী সরল শিশুটির মতো, যে ন্যাংটো রাজাকে ন্যাংটো বলেছিল৷ যেখানে সকল চাটুকার রাজার রোষের ভয়ে সত্য কথাটা বলার সাহস করেনি, সেখানে একটি ছোট্ট বালকই সত্য উচ্চারণ করেছে এবং রাজার রোষানলে পড়েছে৷ ইউপিডিএফ নেতা প্রসিত খীসারা সাহসের সাথে জেএসএস ও সন্তু লারমার ভুল ও ভয়ঙ্কর রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছেন বলেই আজ সন্তু লারমা ও তার ভক্ত মুরীদদের উগ্র রোষের শিকার হয়েছেন৷ গৌতম, উষাতন ও দীপায়ন বাবুদের মতো চাটুকার হলে তাদের পুরস্কারই জুটতো৷ তবে তখন সত্যের বিনাশ ঘটতো৷

চতুর্থত, মহা হিপোক্র্যাট দীপায়ন বাবু "বৈরী ও শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশ" এর কথা বলেছেন৷ চুক্তি স্বাক্ষরের বহু আগেই সন্তু লারমা এই বৈরী ও শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন৷ কেবল মাত্র (১৯৯৬ সালের) জাতীয় নির্বাচনের কৌশল নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করায় ও জেএসএস-এ ভর্তির আগে গঠনতন্ত্র পড়তে চাওয়ায় সন্তু লারমা জেএসএস-এর সকল ইউনিটে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন প্রসিত খীসাসহ ৫ জনকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে "গ্রেফতার" করার জন্য৷ তিনি শরণার্থী শিবিরসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রসিত খীসাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারও শুরু করে দিয়েছিলেন৷ অপরদিকে প্রসিত খীসারা সে সময় কী করেছিলেন তার বিবরণ দীপায়ন বাবুর মুখ থেকেই শোনা যাক৷ সৌম্য চাকমা নামে "লারমার কলমবাজ-সন্ত্রাসীরা যে কথা বলেননি" শিরোনামে স্বাধিকারের ১৭ নং বুলেটিনে (১ জানুয়ারী ২০০১) তিনি লেখেন:

"১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির চতুর্থ বৈঠকের প্রাক্কালে পাহাড়ী গণ পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা ও যুক্ত ফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ঐক্যের প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন কেন জেএসএস তা প্রত্যাখ্যান করলো? কেন জনসংহতি সমিতি তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সমিতিকে দাঁড় না করিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নাম ভাঙিয়ে আরেকটি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ করলো? এর উত্তর কি জেএসএস দিতে পারবে? কেনই বা বার বার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তাব দেয়া সত্বেও জেএসএস তা প্রত্যাখ্যান করে চলেছে এ বিষয়গুলো সন্তু বাবুদের লেখায় কখনো পাওয়া যাবে না৷ যারা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে চায় তাদের মিথ্যাচারই হচ্ছে একমাত্র পুঁজি৷ তাদের সুমতির উদয় হোক এ কামনা করি৷"

দীপায়ন বাবুটির পুঁজি এখন মিথ্যাচার ও রাজনৈতিক ভণ্ডামী৷ তার লেখায় একটা যুক্তি নেই, নেই সত্য কথন৷ কেবল "শান্তিবাদীদের" বিরুদ্ধে বিষোদগার৷ তিনি আসলে রাজনৈতিক "কেরেঙা চলছেন"৷ এখন কে তার সুমতি উদয় হওয়ার কামনা করবেন?

পঞ্চমত, দীপায়ন বাবু তার ওস্তাদ সন্তু লারমার প্রতি স্তুতিবাক্য বর্ষণ করে বলেন,"জনসংহতি সমিতি এবং দলটির নেতা সন্তু লারমা দায়িত্বশীলতার সাথে জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে৷" আসলে নীতিহীন মানুষ পারে না এমন কাজ নেই৷ দীপায়ন মাটিতে থু থু ফেলে সেটাই আবার তুলে চাটছেন৷ সন্তু গ্রুপে ভিড়ার আগে এক সময় তিনি সন্তু লারমা ও জনসংহতি সমিতির চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছেড়েছিলেন৷ উপরোক্ত "লারমার কলমবাজ-সন্ত্রাসীরা যে কথা বলেননি" শীর্ষক লেখা থেকে আরো কিছু উদ্বৃতি:

"একুশ শতকের উষালগ্নে লারমার কলমবাজ-সন্ত্রাসীদের চিন্তার কুপমুন্ডকতা, দর্শনের দরিদ্রতা দেখে সত্যিই বড় করুণা হচ্ছে৷ শ্রী তাতিন্দ্র লাল, শ্রী জীবনসহ যারা কলম ধরে সন্ত্রাস করতে নেমেছেন, তাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে উপজাত ফসল হতে আসল যে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি বাদ পড়েছে, সেটি যোগ করার প্রয়াসে আমার এই লেখা৷"

"জনসংহতি সমিতির এ দু'গ্রুপের (লাম্বা-বাদি, বর্তমান লেখক) পরিণতি একই৷ উভয়েই সরকারের কাছে আত্মসমর্পন করেছে৷ এক গ্রুপ ১৯৮৫ সালে অন্য গ্রুপ ১৯৯৮ সালে৷ দু'গ্রুপই সরকারের কাছে আত্মসমর্পনের পর তারা নিজেদেরকে আত্মসমর্পনকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে নারাজ৷ প্রীতি গ্রুপের জনৈক সদস্যের সাথে সে সময় আলাপ কালে তাকে আত্মসমর্পনকারী আখ্যায়িত করায় তিনি নাখোশ হয়েছিলেন৷ সে সময়ে তার দাবি ছিলো - 'প্রীতি গ্রুপ আত্মসমর্পন করেনি৷ সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছে মাত্র৷ আন্দোলন সেখানে শেষ হয়নি ......'৷ আজ সন্তু লারমা আত্মসমর্পন করার পর সেই একই সুরে কথা বলছেন৷ কথা আছে না, 'মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন, হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয় ... আমরাও হব বরণীয়'৷ তাই সন্তু লারমারা আজও বলে বেড়াচ্ছেন আন্দোলন এখানে শেষ নয়, আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র৷ সময়ের পরিক্রমায় প্রীতি গ্রুপ হারিয়ে গেছে সেই অনেক আগে৷ আর সন্তু লারমার দলটি কয়দিন টিকবে তার হিসেব-নিকেশ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে৷ তাদের শেষ পরিণতি আর বেশী দূরে নয়৷"
.. .    ...  ...  ...

"চুক্তির এক বছরের মাথায় সন্তু বাবু রাঙামাটিতে বললেন, চুক্তির শর্তানুসারে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন না হলে আঞ্চলিক পরিষদে বসবেন না৷ প্রয়োজনে আবারো রক্ত দেবেন৷ কিন্তু বাস্তবে সে কথাটির উল্টোটাই হলো, সুবোধ বালকটির মতো সুড় সুড় করে আঞ্চলিক পরিষদের গদিতে বসলেন৷ দোহাই সন্তু বাবু, আপনাদেরকে আর রক্ত দিতে হবে না৷ কারণ আপনাদের রক্ত দূষিত হয়ে গেছে, আপনারা এখন সুবিধাবাদীতার ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত৷"
.. .    ...  ...  ...

"জানি সন্তু বাবুরা এ লেখা পড়লে আমাকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য, হাত-পা ভাঙার জন্য এবং চোখ উপড়ে ফেলার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজবেন৷ তাতেও আমার দুঃখ নেই৷ শুধু দুঃখ একটাই তার আগে সরকার সন্তু বাবুদের হাত-পা ভেঙে দিয়ে ফেলেছেন, চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন৷ হাত-পা ভাঙা ভিক্ষুকরা যেমন সারাদিন করুণ আকুতি জানিয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভিক্ষা চায়৷ সন্তু বাবুদের অবস্থাও হচ্ছে তাই৷ যতই আন্দোলনের মরা চিত্‍কার করুন না কেন যতই আন্দোলন করবেন বলে হাঁক ডাক ছাড়ুন না কেন, আপনাদের অর্জন এ একটাই আর তা হলো ব্যর্থ চুক্তি৷ আমার না হয় হাত-পা ভাঙলেন, চোখ উপড়ে ফেলে দিলেন, গলা টিপে হত্যা করলেন তা আপনারা পারবেন --এটা তো আপনাদের একটা বড় গুণ(!), বড় অভিজ্ঞতা (!)৷ কিন্তু যে শত শত, হাজার হাজার আন্দোলনকামী যোগ হচ্ছে তাদের দমন করবেন কিভাবে?"

যিনি সন্তু লারমার কলমবাজ সন্ত্রাসীদের সমালোচনার পর নিজেই তাদের দলে ভিড়ে যান, তার সম্পর্কে বেশী কিছু কি বলার থাকে? তারপরও প্রশ্ন করতে চাই, দয়া করে সন্তু গ্রুপের কেউ বলবেন কি সন্তু লারমা কী রকম "দায়িত্বশীলতার সাথে জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে" যাচ্ছেন? জনগণের ঐক্যের আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করা ও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের দাবি উপক্ষা করা কি দায়িত্বশীলতা? ভাইয়ের বুকে গুলি চালানো কি আন্দোলন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন বা না দিন, মনে রাখবেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও দাবিকে উপক্ষা করে কোন পার্টি ও নেতা কোন দেশে কোন কালে টিকতে পারেনি৷ সন্তু লারমা এবং জেএসএস-ও পারবে না৷ এটাই চরম সত্য৷

রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করেছি, রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শেষ করতে চাই৷ দুই বিঘা জমির উপেনরা কি চিরকাল বঞ্চিত শোষিত হয়ে থাকবে? জমিদার বাবুরা কি চিরদিন জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে? উপেনদের মুক্তির পথও রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন৷ "এবার ফিরাও মোরে" কবিতায় তিনি লেখেন:

'মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা-চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে৷
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে৷
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার;
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে৷'

ফ্যাসিস্টদের নিজেদের শক্তি নেই, আমরা জনগণ অসংগঠিত বলেই তারা আমাদের ওপর ছরি ঘোরায়৷ কিন্তু এক হয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেই তারা পথকুক্কুরের মতো পালিয়ে যায়৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এক হয়ে দাঁড়ালে ফ্যাসিস্ট সন্তু লারমাকেও সেভাবে পালাতে হবেই৷ এর কোন বিকল্প হতে পারে না৷ কারণ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত দীর্ঘ দিন চলতে পারে না৷ এর বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ দ্রুত পুঞ্জিভূত হয়ে চলেছে৷ যে কোন মুহূর্তে তারা ফুঁসে উঠতে পারে৷ এক নেতার কাছে পুরো জনগণ ও আন্দোলনের ভবিষ্যত জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না৷