মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১২

ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক ও সমঝোতা প্রসঙ্গে

ইদানিং সন্তু লারমার অনুসারীরা ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সন্তু গ্রুপ) এর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক ও সমঝোতা সম্পর্কে মনগড়া, অসত্য ও অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে লোকজনকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। তারা এমনভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে যেন জেএসএস-ই (সন্তু গ্রুপ) সমঝোতার উদ্যোক্তা, আসল শান্তিবাদী এবং অপরদিকে ইউপিডিএফ সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘনকারী। ঐক্য-সমঝোতার জন্য সাধারণ জনগণসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে সন্তু গ্রুপের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি হওয়ায় সন্তু গ্রুপ আলোচনা-ঐক্য-সমঝোতা ঠেকিয়ে রাখার জন্য এই জঘন্য মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দুই পার্টির মধ্যে বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত বৈঠক ও গৃহীত সমঝোতা সম্পর্কে সঠিক, বস্তুনিষ্ট ও বিস্তারিত তথ্য জানানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অবশ্য ইতিপূর্বে গত বছর ইন্টারনেটে সন্তু গ্রুপ ও ইউপিডিএফ সমর্থকদের মধ্যে এ সম্পর্কে যে বিতর্ক হয়েছিল তাতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে যে, জেএসএস সন্তু গ্রুপের প্রধান সন্তু লারমাই চলমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের জন্মদাতা, তিনিই আলোচনা-সমঝোতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক, তিনিই সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘনকারী এবং তার কারণেই এখনো ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত চলছে।

উক্ত ইন্টরনেট বিতর্কে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার পর সন্তু গ্রুপের সমর্থকরা এতদিন বেশ চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু কিছু দিন আগে রাঙামাটি হামলার পর তারা অনাকাঙ্খিতভাবে দুই পার্টির মধ্যে বৈঠক-সমঝোতা সম্পর্কে নতুন মিথ্যা তথ্য যোগ করে ইন্টারনেটে হাজির হয়। এর উদ্দেশ্য হলো রাঙামাটি হামলার প্রেক্ষিতে জেএসএস সন্তু গ্রুপের কাছে ইউপিডিএফের দেয়া ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচীর প্রস্তাব ভণ্ডুল করে দেয়া। ইন্টারনেটে চলমান ঐক্য আলোচনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জুম্ম জাতির ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় ঐক্যের সকল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়া। তবে তাদের এই ঘৃন্য অপচেষ্টার জন্য তারা সকল মহলের কাছে হাস্যষ্পাত্র, নিন্দিত ও তিরস্কৃত হয়েছে। অবশ্য পরে তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐক্যের আকাঙ্খা প্রবল দেখে ইন্টারনেটে দ্রুত তাদের সুর পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।

ইউপিডিএফ ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণের প্রচেষ্টাকে প্রাধান্য দিয়ে শত উস্কানি সত্বেও ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক ও সমঝোতা প্রশ্নে বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ার ঘোষণা দিয়েছিল। যেহেতু, ইউপিডিএফের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্বেও সন্তু গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণে রাজী করানো সম্ভব হয়নি, তাই এখন সন্তু গ্রুপের সমর্থকদের মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগের জবাব দিয়ে সকলের কাছে প্রকৃত সত্যকে তুলে করা দরকার।

১। আলোচনায় জেএসএস-এর অনীহা:
কখন কিভাবে সংঘাতের সৃষ্টি সে বিষয়ে না গিয়ে এখানে বলা দরকার, ১৯৯৮ সাল থেকেই ইউপিডিএফ (পার্টি গঠনের আগে তিন সংগঠন পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন) আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে মত পার্থক্য ও পরে সংঘাত নিরসনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। তিন সংগঠন বা ইউপিডিএফ প্রচারপত্র, নিজস্ব বুলেটিন ও তিন জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মারফত জেএসএস-এর কাছে এই আহ্বান জানায়। ১৯৯৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল পানছড়িতে প্রদীপ লাল চাকমা ও কুসুম প্রিয় চাকমার নৃশংস হত্যার পর প্রয়াত উপেন্দ্র লাল চাকমা, হংসধ্বজ চাকমা ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউএনপিও (Unrepresented Nations and Peoples Organizations)সহ দেশী বিদেশী অনেক শুভাকাঙ্খী সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু জেএসএস এতে ইতিবাচক সাড়া না দেয়ায় তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জেএসএস ইউপিডিএফকে স্বীকৃতি দিতে পর্যন্ত নারাজ ছিল। এমনকি ১৯৯৮ সালে জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা ‘এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারবে না’ অর্থা জেএসএস ছাড়া আর কোন দল থাকতে পারবে না বলে ঘোষণা দেন। ইউপিডিএফ যেমন শুরু থেকেই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও সংঘাত নিরসনের পক্ষপাতি ছিল, তেমনি তার বিপরীতে সন্তু লারমা তথা জেএসএস উগ্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দুই পার্টির মধ্যে এই রাজনৈতিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন এবং এখনো চাচ্ছেন। ফলে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক ইউপিডিএফ নেতাকর্মীর ওপর সশস্ত্র হামলা চলতে থাকে। এসব হামলায় ইউপিডিএফের অনেক নেতাকর্মী খুন, আহত ও পঙ্গু হন। অপরদিকে ইউপিডিএফের অগণিত কর্মী সমর্থকও স্থানীয়ভাবে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হন। এ সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত বলার কোন অবকাশ নেই।

প্রথমদিকে অনীহা ও বিরোধীতা সত্ত্বেও সংঘাতের বিভিন্ন পর্যায়ে জনগণের চাপ ও আভ্যন্তরীণ দলীয় সংকটসহ নানা কারণে জেএসএস নেতত্ব ইউপিডিএফের সাথে আলোচনার টেবিলে বসতে ও সমঝোতায় উপনীত হতে বাধ্য হয়েছে, যদিও সেই সমঝোতা তারা পরে লঙ্ঘন করেছে। নিচে ১৯৯৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর মধ্যে যে সব সমঝোতা বৈঠক হয়েছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।

২। প্রথম বৈঠক: ১৯৯৯ সালের দীঘিনালা চুক্তি:
দীঘিনালায় ইউপিডিএফের সাথে জেএসএসএর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে এক চুক্তি হয়। আসলে জেএসএস এই চুক্তি করতে ইউপিডিএফের স্থানীয় নেতাদের বাধ্য করেছিল তাদের ওপর একের পর এক হামলার মাধ্যমে, যে হামলায় ইউপিডএফ নেতা অনিমেষ চাকমা (যিনি পরে ২০১০ সালের ২১ মে রাঙামাটির শুভলঙে সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র হামলায় শহীদ হন) ও ধর্মজ্যোতি চাকমা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। দীঘিনালার উক্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ মে বাবুছড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান পরিতোষ চাকমাসহ অন্যান্য মুরুব্বীদের মধ্যস্থতায়। এতে ইউপিডিএফের প্রতিনিধিত্ব করেন অনিমেষ চাকমা ও ধর্মজ্যোতি চাকমা। জেএসএসএর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বর বাবু, মিত্রবাবু ও বিভাষ বাবু্। মুরুব্বীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পূর্ণ কুমার মাস্টার, বাবুছড়ার সাবেক ইউপি মেম্বার কালেন্দ্র চাকমা, একই ইউনিয়নের প্রাক্তন মেম্বার ও অনিমেষ চাকমার বাবা অনন্ত বিকাশ চাকমা, নুনছড়ি মৌজার হেডম্যান উদয় শংকর চাকমা ও বাবুছড়া বাজার চৌধুরী জিতেন্দ্রিয় চাকমা।

সমঝোতার শর্ত ছিল: ১. একে অপরের ওপর হামলা বন্ধ করা, ২. উভয় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী বৈঠক ঠিক করা এবং ৩. ছয় মাস পর্যন্ত ইউপিডিএফ দীঘিনালায় কোন সাংগঠনিক কাজ চালাতে পারবে না।
বিশ্লেষণ: অযৌক্তিক, অন্যায্য ও অসম হলেও কেন্দ্রীয় নির্দেশে ইউপিডিএফ দীঘিনালা ইউনিট এই শর্ত অক্ষরে অক্ষেরে পালন করেছিল। ইউপিডিএফ শর্ত মোতাবেক ছয় মাস পর ডিসেম্বর-জানুয়ারীর দিকে দীঘিনালায় তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে। অপরদিকে জেএসএস উক্ত সমঝোতা শর্ত লঙ্ঘন করে। বৈঠকের কয়েক দিন পর তারা ইউপিডিএফ সদস্য শান্তি প্রিয় চাকমা ওরফে চোখ্যাকে (বাড়ি বাবুছড়া নুয়্য বাজার) খাগড়াছড়ি থেকে ফেরার পথে দীঘিনালা থেকে অপহরণ করে। পরে স্থানীয় মুরুব্বীদের মধ্যস্থতায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর ২০০০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী তারা বাবুছড়ায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে দেবোত্তম চাকমাকে খুন করে।

৩। দ্বিতীয় বৈঠক: ২০০০ সালের নারাঙহিয়া চুক্তি:
দীঘিনালা চুক্তির কয়েক মাস পর অপ্রত্যাশিতভাবে খাগড়াছড়ির স্থানীয় জেএসএস নেতারা ইউপিডিএফ-এর সাথে বৈঠকে বসতে রাজী হন। ফলে ২০০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী নারাঙহিয়ায় উক্ত বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। জেএসএস এর পক্ষে বৈঠক উপস্থিত ছিলেন তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলে এবং ইউপিডিএফের পক্ষে দীপ্তি শংকর চাকমা। বৈঠকে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বৈঠকটি সন্তু লারমার অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তিনি ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। বৈঠক ও সমঝোতার খবর শোনা মাত্রই তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি ওই বৈঠক ও সমঝোতা মানেন না।

অপরদিকে, বৈঠকটি সম্পর্কে ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও অবহিত ছিল না। সমঝোতা হওয়ার একদিন পরই তারা তা জানতে পারেন। মূলত তাড়াহুড়ো করেই উক্ত বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল, বৈঠক আয়োজনে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে উভয় পক্ষের বহু দুর্বলতা ছিল। কিন্তু তারপরও ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উক্ত সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু দুখের বিষয় জেএসএস-এর উচ্চ নেতৃত্ব এই সমঝোতা কার্যকর হতে দেয়নি।

এটা সত্য সমঝোতা সাক্ষরিত হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে কমলছড়িতে জেএসএস এক কর্মী মারা গিয়েছিল। এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছিল যোগাযোগের অভাবের কারণে। যে সময় চুক্তি হয়েছিল সে সময় এখনকার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। লোক পাঠিয়ে খবর দিতে হতো এবং খবর সংগ্রহ করতে হতো। বৈঠকের ফলাফল মাঠ পর্যায়ে পৌঁছার আগেই ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

বিশ্লেষণ: একটি চুক্তি কার্যকর হতে সময় লাগে। স্বাক্ষর হওয়া মাত্রই যে তা কার্যকর হবে তা সব সময় আশা করা যায় না। কিন্তু জেএএসএস যার নেতৃবৃন্দ বহু বছরের সংগ্রামে পোড়খাওয়া দাবীদার তারা এক্ষেত্রে সহনশীলতা, ধৈর্য্য ও আন্তরিকতা দেখাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা ইউপিডিএফের কাছে মধ্যস্থতাকারীদের মারফত বা সভ্য সমাজে প্রচলিত অন্য কোন পন্থায় তাদের কর্মী নিহত হওয়ার দুখজনক ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে পারতেন, ঘটনার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি করতে পারতেন ইউপিডিএফের কাছে। কিন্তু সেটা না করে সন্তু লারমা গোটা সমঝোতা প্রক্রিয়াটিকেই নাকচ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তার সশস্ত্র কর্মীরা উক্ত সমঝোতা স্বাক্ষরের ১৬ দিন পর ৮ মার্চ পানছড়িতে তারা কুমার চাকমাকে ও পরে ২৮ এপ্রিল মহালছড়িতে সদয় সিন্ধু চাকমা ও সুই মং মারমাকে খুন করে। যদি সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন কাকে বলে আলোচনা করা হয় তাহলে প্রকৃত অর্থে এটাকেই সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন বলে অভিহিত করতে হবে। কারণ জেএসএসএর উক্ত হামলা ছিল Intentional ও চুক্তির খবর জানার পর। অপরদিকে, কমলছড়ির জেএসএস কর্মী নিহত হওয়াটার ঘটনাটা ছিল ইউপিডিএফের দিক থেকে Unintentional and accidental এবং সমঝোতার খবর জানার আগে। জেএসএস (সন্তু লারমা) যদি প্রতিহিংসা পরায়ণ না হয়ে ধৈর্য্য, সংযম, সহনশীলতা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিতেন তাহলে নারাঙহিয়ার সমঝোতা অবশ্যই বাস্তবায়িত হতো।

৪। তৃতীয় বৈঠক: ২০০০ সালে উপেন্দ্র লাল চাকমার বাড়ি, মহাজন পাড়া, ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাব:
এরপর ২০০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও খাগড়াছড়ি সরকারী বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক নবীন কুমার ত্রিপুরাসহ অন্যান্যদের মধ্যস্থতায় খাগড়াছড়ির মহাজন পাড়ায় উপেন্দ্র লাল চাকমার বাড়িতে দুই পার্টির মধ্যে এক সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে অংশ নেন ইউপিডিএফের পক্ষে সঞ্চয় চাকমা, অনিমেষ চাকমা ও অভিলাষ চাকমা। অপরদিকে জেএসএসের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন লক্ষীপ্রসাদ চাকমা ও সত্যবীর দেওয়ান। বৈঠকে ইউপিডিএফ লিখিতভাবে তিন দফা ঐক্য প্রস্তাব তুলে ধরে। দফাগুলো হলো, ১. অচিরেই ইউপিডিএফ ও জনগণের ওপর আক্রমণ বন্ধ করা, ২. সরকারের বিরুদ্ধে ন্যুনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা, এবং ৩. ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের লক্ষ্যে ইউপিডিএফ ও জেএসএস সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গড়ে তোলা’। ন্যুনতম কর্মসূচী বলতে যদি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন বোঝায় তাতেও ইউপিডিএফ রাজী বলে বৈঠকে জেএসএস নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়। স্বাধিকারের ২০০৩ সালের ২০ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত “ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা” শিরোনামের এক নিবন্ধে জানা যায়, ‘দুই পার্টির মধ্যে কি ধরনের ঐক্য হবে সে ব্যাপারেও উক্ত বৈঠকে আলোচনা হয়৷ ইউপিডিএফ এর পক্ষ থেকে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়৷ এক. দুই পার্টি  কর্তৃক যৌথ কর্মসূচী গ্রহণ  এবং তা বাস্তবায়নের জন্য যৌথ তত্‍পরতা৷ দুই. একে অপরের কর্মসূচীতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে যুগপত্‍ কর্মসূচী গ্রহণ৷ তিন. চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে জেএসএস নিজে কর্মসূচী গ্রহণ করবে এবং ইউপিডিএফ সে কর্মসূচীতে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে৷ এই শর্তে যে, জেএসএস ইউপিডিএফ এর ওপর তাদের আক্রমণ বন্ধ করবে৷ এই তিন বিকল্প প্রস্তাবের যে কোন একটি জেএসএস তাদের সুবিধা অনুসারে গ্রহণ করতে পারবে বলে ইউপিডিএফ এর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়৷’

কিন্তু জেএসএস ইউপিডিএফের উক্ত প্রস্তাবে রাজী হয়নি, এমনকি বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও কার্যবিবরণী লিখিত করতেও অসম্মতি জানায়। ফলে নবীন কুমার ত্রিপুরাসহ বিশিষ্ট জুম্মদের দ্বিতীয় বারের ঐক্যপ্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। উক্ত বৈঠকে জেএসেএস প্রতিনিধিবৃন্দ ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নারাঙহিয়ায় গৃহীত সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘনের কোন অভিযোগ উত্থাপন করেননি, যদিও এখন সন্তু গ্রুপের কেউ কেউ মিথ্যা অভিযোগ তুলছে।

এই বৈঠকের প্রায় দুই মাস পর ১৩ নভেম্বর ২০০০ সন্তু লারমা যুগান্তরের সাথে এক সাক্ষাতকারে তার কর্মী বাহিনীকে ইউপিডিএফ সদস্যদের ওপর আক্রমণের প্রকাশ্য নির্দেশ দেন। ইউপিডিএফকে কিভাবে মোকাবিলা করবেন তখনকার যুগান্তরের রিপোর্টার সাগর সারোয়ারের (বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের সাগর সারোয়ার) এই প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেছিলেন, ‘পলিটিক্যালি নয়। এদের গলা টিপে হত্যা করতে হবে। যাতে কিছু না করতে পারে। হাত ভেঙে দিতে হবে, যাতে লিখতে না পারে। ঠ্যাং ভেঙে দিতে হবে, যাতে হাঁটতে না পারে। চোখ অন্ধ করে দিতে হবে, যাতে দেখতে না পারে। যারা চুক্তির পক্ষে জনগণের অধিকারের পক্ষে তারাই এ কাজ করবে’। ইউপিডিএফ ও সমঝোতা সম্পর্কে সন্তু লারমার দৃষ্টিভঙ্গি সন্তু লারমার এই একটি মাত্র উক্তি থেকে বোঝা সম্ভব। এরপর আর আসলে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না।

বিশ্লেষণ: মূলত বিভিন্ন মহলের চাপে পড়ে সন্তু লারমা তৃতীয় বৈঠকটি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বৈঠকে জেএসএস প্রতিনিধিদের কোন আন্তরিকতা ছিল না। ইউপিডিএফের ঐক্য প্রস্তাব তারা ভালো করে পড়ে দেখেননি, তার জবাব দেয়া তো দূরের কথা।

৫। চতুর্থ বৈঠক: ২০০৬ সালের সমঝোতা, জেএসএস-এর শর্ত লঙ্ঘন:
উক্ত বৈঠকের পর ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত দুই পার্টির মধ্যে আর কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি, যদিও ইউপিডিএফ ঐক্য ও সমঝোতার আহ্বান জানাতে থাকে এবং নানাভাবে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়। অপরদিকে জেএসএস ইউপিডিএফের উপর একের পর আক্রমণ চালাতে থাকে। এই অবস্থায় ২০০৬ সালের প্রথমদিকে জেএসএস হঠাৎ আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে স্বেচ্ছায় ইউপিডিএফের কাছে হাজির হয়। ইউপিডিএফ তক্ষণা জেএসএসএর সকল শর্ত মেনে নিয়ে উক্ত প্রস্তাবে রাজী হয়। কারা মধ্যস্থতাকারী হবেন, বৈঠক কোথায় ও কখন অনুষ্ঠিত হবে, বৈঠকের সিদ্ধান্ত লিখিত নাকি অলিখিত হবে তা সবই জেএসএস-এর ইচ্ছায় ঠিক করা হয়। এমনকি ইউপিডিএফের পক্ষে কে প্রতিনিধিত্ব করবেন সেটাও জেএসএস ঠিক করে দেয়।

২০০৬ সালের ৫ জানুয়ারী প্রথম দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সৌজন্যমূলক। দ্বিতীয় দফা অনুষ্ঠিত হয় ২৩ ফেব্রুয়ারী। এই দফার বৈঠকে ইউপিডিএফ জেএসএস-এর কাছে লিখিতভাবে তিন দফা ঐক্য প্রস্তাব পেশ করে। এগুলো হলো:
১. অচিরেই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করে আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা; জনগণকে মতামত প্রকাশের (ইউপিডিএফ বা জেএসএস-এর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে) পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া এবং স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের কারণে কোন ব্যক্তি কোনভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না - এই নিশ্চয়তা প্রদান করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ন্যুনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা; এজন্য ইউপিডিএফ ও জেএসএস-সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গড়ে তোলা।
৩. একে অপরকে না জানিয়ে সরকার কিংবা তৃতীয় কোন দল বা সংগঠনের সাথে নির্বাচনী কিংবা রাজনৈতিক সমঝোতা না করা।

ইন্টারনেটে প্রচারিত উক্ত বৈঠক সম্পর্কিত একটি মেমো (যাতে মধ্যস্থতাকারীদের স্বাক্ষর রয়েছে) থেকে জানা যায়, জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধি উক্ত প্রস্তাবের প্রথম ও দ্বিতীয় দফা সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। তবে তৃতীয় দফা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকেন এবং পরবর্তী বৈঠকে সে ব্যাপারে তার পার্টির মতামত দিতে সক্ষম হবেন বলে জানান।

ওই মেমোতে আরো জানা যায়, উভয় পক্ষ পারস্পরিক অনাক্রমণ ছাড়াও বেশ কয়েকটি বিষয়ে একমত হন। যেমন জুম্ম জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন জোরদার করতে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়ে তোলা, উভয় দলের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দুই পক্ষের মধ্যে ‘শান্তি উদ্যোগের’ ঘোষণা দেয়া, পরবর্তী বৈঠকে উভয় দলের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে লিখিত চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি কল্পে আচরণ সংযত করা, বৈঠকের পর উভয় পক্ষের মধ্যে কোন প্রকার সমস্যা বা জটিলতা সৃষ্টি হলে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তা নিরসনের উদ্যোগ নেয়া এবং পরবর্তী বৈঠক মার্চ ২০০৬ এর মধ্যে অনুষ্ঠিত করা। উক্ত মার্চের বৈঠকে রাজনৈতিক ঐক্য, যুক্ত ফ্রন্ট গঠন, যুগপ আন্দোলন, শান্তি উদ্যোগ ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে আরো বিস্তারিতবাবে আলোচনা করে লিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চালানো হবে।

উক্ত মেমোর ভাষ্য মতে, বৈঠকে ‘উভয় পক্ষ আন্তরিক পরিবেশে খোলামেলাভাবে নিজ নিজ পার্টির বক্তব্য তুলে ধরেন এবং দুই পার্টির মধ্যে চলমান সংঘাত শান্তিপূর্ণভাবে ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন’।

তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৫ - ৬ মে। ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আনুষ্ঠানিক বৈঠকের সারাংশ’ শিরোনামের অপর একটি মেমো থেকে জানা যায়: ‘বিগত দ্বিতীয় বৈঠকে উভয় পার্টির মধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তাবলী বাস্তবায়ন সম্পর্কে উভয় দলের প্রতিনিধি নিজ নিজ বক্তব্য তুলে ধরেন। উভয় পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে উক্ত সিদ্ধান্ত পালনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করলেও, কোন পক্ষই বড় ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করেনি, উভয় দল সংযত আচরণ করেছে ও ন্যুনতম কর্মসূচী বাস্তবায়নে দু’দলই কাজ করেছে বলে প্রতিনিধিরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন’।
মেমো থেকে আরো জানা যায়, উভয় দলের প্রতিনিধিগণ একে অপরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস প্রকাশ করলেও, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত নিরসন ও ঐক্য-সমঝোতার ব্যাপারে উভয় পক্ষই তাদের আন্তরিকতা পুনর্ব্যক্ত করেন। জেএসএস প্রতিনিধি বৈঠকে আলোচনার মিনিটস ও গৃহীত সিদ্ধান্ত লিখিত ও স্বাক্ষরিত করতে অনীহা প্রকাশ করেন। ইউপিডিএফ প্রতিনিধি বিগত জেএসএস এর কংগ্রেসে পাশ করা ইউপিডিএফকে নির্মূল সংক্রান্ত ১৬ দফা প্রস্তাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। কারণ একদিকে সমঝোতা বৈঠক চলছে, অপরদিকে এভাবে নির্মূলীকরণের প্রস্তাব পাশ - তা সমঝোতার ব্যাপারে জেএসএস-এর আন্তরিকতা না থাকার বিষয়টি ফুটে ওঠে। উত্তরে জেএএস প্রতিনিধি বলেন, যেহেতু চলমান বৈঠক সম্পর্কে জেএসএস-র মধ্যে সবাইকে অবহিত করা হয়নি, সেহেতু পূর্বের ধারাবাহিকতায় এ প্রস্তাবনা পাশ করা হয়’।

অর্থা এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো জেএসএস একদিকে ইউপিডিএফের সাথে সমঝোতা বৈঠক করছে, অন্যদিকে পাশাপাশি তাদের দলীয় কংগ্রেসে ইউপিডিএফকে নির্মূলের কর্মসূচী গ্রহণ করছে। জেএসএস-এর এ রকম জঘন্য মানসিকতা ও দ্বিমুখী নীতি দেখেও ইউপিডিএফ যে তাদের সাথে বৈঠক করেছে সেটাই তো এক আশ্চর্য্যের বিষয়। ইউপিডিএফ নেতৃবৃন্দের ঐক্য ও সমঝোতার জন্য পরম আন্তিরকতা না থাকলে এটা কখনোই সম্ভব ছিল না।

তৃতীয় বা শেষ দফার বৈঠকে উভয় পক্ষ আন্দোলন জোরদার করতে বৃহত্তর ঐক্যের বিকল্প নেই বলে মত প্রকাশ করে ‘উভয় দলের মধ্যে চলমান সংলাপ সকল কিছুর বিনিময়ে বজার রাখার’ সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া উভয় দলের প্রতিনিধিগণ দ্বিতীয় দফার বৈঠকে গৃহীত ৩ ও ৪ নং সিদ্ধান্তাবলী যথাযথভাবে বলব রাখতে সম্মত হন।

জেএসএস এর সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন: কিন্তু বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ এবং সকল কিছুর বিনিময়ে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করার পরও, জেএসএস তৃতীয় দফার বৈঠক থেকে উঠে যেতে না যেতেই সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করে রামগড়, গুইমার, মাটিরাঙ্গা, পানছড়ি ও কুদুকছড়িতে একের পর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ইউপিডিএফ কর্মীদের হতাহত করে। ইউপিডিএফ সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনার উল্লেখ করে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে জেএসএস কাছে ১০ জুন ও ২২ জুলাই ২০০৬ দুই দফা লিখিত প্রতিবাদ এবং বৈঠক ফিরে আসার জন্য জেএসএস নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানায়। ২২ জুলাই মধ্যস্থতাকারীদের কাছে ইউপিডিএফ লিখেছে, ‘তৃতীয় বৈঠক থেকে উঠে যেতে না যেতেই জনসংহতি সমিতি উক্ত চুক্তি লঙ্ঘন করে পার্টির সদস্য ও সমর্থকদের ওপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ শুরু করে। গত ১০ জুন আপনাদের বরাবরে লেখা এক চিঠিতে সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনা উল্লেখ করে আপনাদের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র হামলা বন্ধ করেনি। উপরন্তু সমিতি সর্বত্র তাদের সশস্ত্র তপরতা বৃদ্ধি করেছে।‌’ সন্তু গ্রুপ ইউপিডিএফের উক্ত প্রতিবাদ ও আহ্বানের কোন জবাব দেয়নি।

বিশ্লেষণ: সন্তু গ্রুপ কেন স্বেচ্ছায় তৃতীয় বৈঠকে এসেছিল? এটা কি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে? না, তা মোটেই নয়। আসলে ২০০৬ সালে বৈঠক চলাকালীন অনুষ্ঠিত তাদের অষ্টম কংগ্রেসের প্রাক্কালে জেএসএস এর অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ ও ভাঙন দেখা দিয়েছিল। জেএসএস-এর এই আভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতেই ইউপিডিএফ-এর সাথে সাময়িক সমঝোতার প্রয়োজন সন্তু লারমা অনুভব করেছিলেন। কারণ উভয় ফ্রন্টে লড়াই করার শক্তি তার ছিল না। অর্থা আভ্যন্তরীণ সংকটে পড়ে সন্তু লারমা স্বেচ্ছায় চতুর্থ বৈঠকের প্রস্তাব নিয়ে ইউপিডিএফের কাছে হাজির হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই বৈঠকের ব্যাপারে সন্তু লারমা জেএসএস কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোন আলোচনা করেননি। দুই একজন বাদে জেএসএস-এর কেন্দ্রীয় কোন নেতা এই বৈঠকের কথা জানতেন না। পরে যখন সবাই জেনে যায়, তখন জেএসএস এর অনেকে অবাক হয়েছিলেন, এবং এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে, এ রকম চুক্তি করলে তার শর্ত মেনে চলা জেএসএস নেতৃত্বের উচিত ছিল। তৃতীয়ত, সন্তু লারমা এই বৈঠকে জেএসএস এর প্রতিনিধিত্ব করতে তার ঘনিষ্ট এক নিকটাত্মীয়কে পাঠিয়েছিলেন।
সন্তু গ্রুপের লোকরা অন্য কয়েকটি বৈঠক সম্পর্কে মিথ্যাচার করলেও এই বৈঠকটি সম্পর্কে তারা টু শব্দ পর্যন্ত করেন না। অথচ এই বৈঠকটিই সন্তু লারমার মনের মতো শর্তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই বৈঠকেই ঐক্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।

৬. পঞ্চম বৈঠক: সাজেক সমঝোতা:
সন্তু লারমা তাদের দলীয় কংগ্রেস শেষ হওয়া পর্যন্ত চতুর্থ বৈঠকের শর্ত মেনে চলেন। এরপর সংকট কেটে গেছে ভেবে তিনি দুই পার্টির মধ্যে গৃহীত উক্ত সমঝোতা পদদলিত করেন। কিন্তু এতে ফল হয় উল্টো। জুনের মধ্যেই জেএসএস দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং দীঘিনালায় তাদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্য খুনোখুনির রূপ নেয়। সুধাসিন্ধু খীসা, রূপায়ান দেওয়ান, তাতিন্দ্র লাল চাকমা ও রক্তোপল ত্রিপুরাসহ জেএসএস এর বাঘা বাঘা নেতারা সন্তু লারমাকে নারী লোভী, অর্থ লোভী ও ক্ষমতালোভী আখ্যায়িত করে বিবৃতি দেন। এছাড়া তারা তার বিরুদ্ধে আরো বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেন। পরে এই নেতারা আলাদা কংগ্রেস করে জনসংহতি সমিতির এম এন লারমা গ্রুপ গঠন করেন।

ইউপিডিএফ জনগণকে নিয়ে জেএসএস এর নতুন হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে সন্তু গ্রুপ ২০০৭ সালের জানুয়ারী - ফেব্রুয়ারীর মধ্যে খাগড়াছড়ির পুরো এলাকা ও রাঙামাটির বিরাট একটা অঞ্চল থেকে উখাত হয়ে বাঘাইছড়ির শিজক এলাকায় আশ্রয় নেয়। এইভাবে কোণঠাসা হওয়ার পর তখন সন্তু লারমার পক্ষে তার দলীয় অস্তিত্ব বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এ রকম এক কাহিল অবস্থায় পড়ে সন্তু লারমা নতুন করে ইউপিডিএফের সাথে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে দৌঁড়াদৌড়িঁ শুরু করে দেন। ইউপিডিএফকে বৈঠকে রাজী করাতে তিনি কার হাত পা ধরবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ঢাকার অনেকের কাছেও তিনি তখন ধর্ণা দিয়েছিলেন।
মানুষ পরিবর্তণশীল। সন্তু লারমা হয়তো তার ভুল বুঝতে পেরেছেন, হয়তো নিজেকে সংশোধন করেছেন -- এই ভেবে ইউপিডিএফ সন্তু লারমাকে আরেক বার সুযোগ দিতে বৈঠকে বসতে রাজী হয়। বাঘাইছড়ির সাজেকে চার দফায় দুই পার্টির মধ্যে পঞ্চম বারের মতো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়: প্রথম দফা ২৬ এপ্রিল ২০০৭, দ্বিতীয় দফা ৮ মে ২০০৭, তৃতীয় দফা ১৬ জুন ২০০৭ এবং চতুর্থ দফা ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭। তৃতীয় দফা আলোচনায় অর্থা ১৬ জুন ২০০৭ দুই পার্টির মধ্যে স্থানীয় লেভেলে একটি নয়-দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ‘সমঝোতা ঘোষণাপত্রে’ ২০০৭ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘাত বন্ধ রাখা হয় এবং ‘স্থায়ী শান্তি’ উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। চতুর্থ দফার বৈঠকে ইউপিডিএফ পরবর্তী এক মাস শান্তি বজায় রাখার ঘোষণা দেয়। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭ ইউপিডিএফ মধ্যস্থতাকারীদের কাছে একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে দুই পার্টির মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের স্বার্থে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে জেএসএস কর্তৃক গৃহীত ইউপিডিএফকে নির্মূলের কর্মসূচী বাতিল করা এবং ‘সমঝোতা প্রক্রিয়ার খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পূর্বসূত্র অনুসরণ’ করতে মধ্যস্থতাকরীদের মাধ্যমে জেএসএসকে অনুরোধ করা হয়। ২২ জুন ২০০৭ জারীকৃত একটি আভ্যন্তরীণ সার্কুলারে ইউপিডিএফ তার সকল শাখাকে উক্ত সমঝোতা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার নির্দেশ দেয়।

সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন: কিন্তু কয়লা ধুলেও যায় না ময়লা। এত কিছুর পরও সন্তু লারমার চরিত্রেরও কোন পরিবর্তন হয়নি। ওই সমঝোতার পর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিবর্তে, ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বদলে (তখন জরুরী অবস্থা, ভূমি বেদখল চরম আকার ধারণ করেছিল), এক কথায় জনগণের স্বার্থে কাজ করার পরিবর্তে তিনি আবার নতুন করে অস্ত্র গোলাবারুদ এবং তার সশস্ত্র গ্রুপের জন্য জনবল সংগ্রহে নেমে পড়েন। অপরদিকে ইউপিডিএফ এ সময় ভূমি রক্ষার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালায়। ইউপিডিএফ সমঝোতার শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে বলে ২০০৬ সালের মধ্যভাগ থেকে ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত হানাহানি বন্ধ থাকে। কিন্তু সন্তু গ্রুপ সমঝোতাকে কাজে লাগিয়ে আবার সশস্ত্র শক্তি বৃদ্ধি করার পর ২০০৯ সালের মে থেকে আবার আঘাত হানতে শুরু করে। ৫ মে দীঘলছড়ি গ্রামের সন্ধি ওরফে সিদোল্যা চাকমাসহ ইউপিডিএফ সদস্য পরেশ চাকমাকে কয়েকজন সন্তু গ্রুপের সদস্য রাঙামাটি থেকে চিকিসা শেষে ফেরার পথে সুবলং বাজার থেকে অপহরণ করে। এর পর মধুমঙ্গল চাকমা, কমলেশ্বর চাকমা ওরফে চাদি, ডিওয়াইএফ সদস্য রাজু, প্রশান্ত চাকমা ওরফে ছন্দলালসহ ইউপিডিএফের আরো অনেক কর্মী ও সমর্থককে অপহরণ ও খুন করে এবং এর ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে ইউপিডিএফ এর দুই কেন্দ্রীয় নেতা রুই খই মারমাকে ২০০৯ সালের ২ অক্টোবর ও অনিমেষ চাকমাকে ২০১১ সালের ২১ মে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেই পর থেকে আজ অবধি সন্তু গ্রুপের আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য সন্তু লারমার প্রতি ধর্মীয় গুরুসহ বিভিন্ন মহলের আহ্বান এবং সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ ও দাবি সত্বেও তিনি এই আক্রমণ এখনো অব্যাহত রেখেছেন।

সন্তু গ্রুপ গোপনে প্রচার করে যে, ইউপিডিএফ রাঙামাটিতে সন্তু লারমার গাড়ি বহরে হামলা করে সাজেক সমঝোতা লঙ্ঘন করেছে। এটা তাদের একটা জঘন্য মিথ্যাচার। প্রথমত, সন্তু লারমার গাড়ি বহরে কোন হামলা হয়নি, সেটা ছিল গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ। দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে রাজনৈতিক প্রতিবাদ করা যাবে না সে রকম কোন শর্ত ছিল না। তৃতীয়ত, চুক্তিটি কার্যকরী ছিল ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, অপরদিকে, সন্তু লারমার গাড়ি বহরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে প্রতিবাদ জানানো হয় ২০১০ সালে।

সন্তু গ্রুপ আরো প্রচার করে যে, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে কিরণ চাকমা নামে বাঘাইছড়ির দজর এলাকায় তাদের এক কর্মীকে মেরে ফেলে। (২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ পিস ক্যাম্পেইন গ্রুপ কর্তৃক ইউপিডিএফের দেয়া ঐক্যব্ধ কর্মসূচীর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে জেএসএসএর অবস্থান তুলে ধরে বিবৃতি)। এটাও জঘন্য মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। সাজেকের চতুর্থ বৈঠকে সন্তু গ্রুপের প্রতিনিধি আশীষ চাকমা লিখিতভাবে যে ৩/৪টি ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছিলেন তার মধ্যে কোন জেএসএস কর্মীকে মেরে ফেলার কথা ছিল না। তিনি তাদের কর্মীদের আত্মসমর্পনের বাধ্য করা, হুমকি দেয়া, হাড়ি পাতিল কেড়ে নেয়া ইত্যাদি ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন, যার অধিকাংশ তারিখবিহীন এবং পরে দেখা গেছে সেগুলো ঘটেছে সাজেকের সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে। সন্তু গ্রুপসহ সবাই জানে, কিরণ চাকমা নিহত হয়েছিলেন জেএসএস-এর দুই গ্রুপের সংঘাতের ফলে। সে কারণে জেএসএস চতুর্থ দফার বৈঠকে এবং তৎ পরবর্তী কোন সময় ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে কিরণ চাকমাকে হত্যা করার অভিযোগ তোলেনি। কিরণ চাকমা ছাড়াও সে সময় দীঘিনালা ও বাঘাইছড়ির দজর-শিজক এলাকায় জেএসএস এর দুই গ্রুপের মধ্যে চলা সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী হতাহত হয়েছিলেন।

বিশ্লেষণ: জেএসএস-এর মধ্যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিভক্তি ও সংকট, জেএসএস এর সংখ্যাগরিষ্ট অংশ দল থেকে বেরিয়ে আসার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়া, জরুরী অবস্থার সময় গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদি কারণে সন্তু লারমা পঞ্চম বৈঠকটি চেয়েছিলেন। অথচ উক্ত বৈঠকের প্রস্তাব দেয়ার কিছুদিন আগে তিনি ইউপিডিএফকে নির্মুলের কর্মসূচী দলীয় কংগ্রেসে নতুনভাবে দ্বিতীয় বারের মতো পাশ করিয়েছিলেন এবং ইউপিডিএফের সাথে কয়েক মাস আগে স্বাক্ষর করা সমঝোতা চুক্তি (২০০৬ সালের) লঙ্ঘন করেছিলেন। মূলত পার্টির আভ্যন্তরীণ সংকট থেকে উত্তরণ এবং নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করতে সময় নেয়ার জন্যই সন্তু লারমার জেএসএস ইউপিডিএফের সাথে সাজেক সমঝোতার জন্য তোড়জোর করেছিলেন।

৭. ষষ্ট বৈঠক: সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত:
ইউপিডিএফ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বহু আগে থেকে দুই পার্টির মধ্যে নির্বাচনী ঐক্যের জন্য সন্তু গ্রুপকে বলে আসছিল। কিন্তু সন্তু গ্রুপ তাতে সাড়া না দিয়ে আগের মতো আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির লেজ ধরার নীতি গ্রহণ করে। সন্তু লারমা নিজে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাথে নির্বাচনী ঐক্যের জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন, দৌঁড়ঝাপ মেরেছিলেন এবং ঢাকায় গিয়ে এই দুই দলের নেতাদের কাছে ধর্ণা দিয়ে অনুনয় বিনয় ও কান্নাকাটি করেছিলেন। কিন্তু তাতে কোন ফায়দা না হওয়ায় শেষ মেষ নিরাশ হয়ে রাঙামাটি ও বান্দরবান এই দুই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেন। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জেএসএস আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার জন্য জুম্মদেরকে বাধ্য করেছিল। আর চুক্তির পর ২০০১ সালের নির্বাচনে জেএসএস নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও রাঙামাটি আসনে বিএনপিকে ভোট দেয়ার জন্য অনেক এলাকায় লোকজনকে বাধ্য করেছিল।
যাই হোক, ২০০৮ সালের নির্বাচনের বেলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে থেকে পাত্তা না পাওয়ার পর হতাশ হয়ে রাঙামাটি ফিরে এসে সন্তু বাবু স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রার্থী দিতে বাধ্য হন এবং পড়ন্ত বেলায় ইউপিডিএফের সাথে নির্বাচনী ঐক্যের জন্য চেষ্টা চালান। সন্তু গ্রুপ বৈঠকের প্রস্তাব দিলে ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮ রাঙামাটির কুদুকছড়িতে দুই পক্ষের মধ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সন্তু গ্রুপের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন দেবংশী বাবু ও কান্ত বাবু। ইউডিএফের প্রতিনিধিত্ব করেন আনন্দ প্রকাশ চাকমা ও শান্তি দেব চাকমা। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন মুরুব্বীও এতে উপস্থিত ছিলেন।

সময় থাকতে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করতে রাজী না হওয়ায় ইউপিডিএফ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে সন্তু গ্রুপের প্রতিনিধিদের ভৎসনা করেন এবং ইতিপূর্বেকার সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘনের জন্য সমালোচনা করেন। সন্তু গ্রুপের প্রতিনিধিরা এসব বিষয় সম্পর্কে অবহিত নন বলে জানান। তারা বৈঠকে সন্তু গ্রুপের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বা Plenipotentiary কিনা প্রশ্ন করা হলে তারা প্রথমে ইতিবাচক উত্তর দেন, কিন্তু পরে যখন তাদের সশস্ত্র দলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্ন উঠে তখন তারা বলেন তারা সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা নিয়ে বৈঠকে আসেননি। ফলে শেষ মহুর্তে কোন ধরনের সমঝোতা ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। তবে সমঝোতা না হলেও সন্তু গ্রুপ নির্বাচনের আগের দিন ইউপিডিএফের সাথে তাদের সমঝোতা হয়েছে বলে বিভিন্ন জায়গায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে প্রচার চালিয়ে ইউপিডিএফ সমর্থকদের ভোট তাদের প্রার্থীদের পক্ষে আদায়ের চেষ্টা চালান।

বিশ্লেষণ: সন্তু গ্রুপ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে থেকে পাত্তা না পাওয়ার পর শেষ বেলায় এসে ইউপিডিএফের সাথে নির্বাচনী সমঝোতার জন্য হাজির হয়েছিল। জুম্ম স্বার্থ বিরোধী উক্ত দুই দলের পিছনে নির্লজ্জের মতো, ভিক্ষুকের মতো ঘুর ঘুর না করে যদি সন্তু লারমা সময় থাকতে ইউপিডিএফের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেদের মধ্যে নির্বাচনী ঐক্যের চেষ্টা করতেন তাহলে অবশ্যই সুফল পাওয়া যেতো। যখন সন্তু লারমা বৈঠকের প্রস্তাব দেয়, তার বহু আগে ইউপিডিএফ নির্বাচন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য মাঠে নেমে পড়েছিল। ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার সময় ও সুযোগ তখন তাদের ছিল না বললেই চলে। এক কথায়, বৈঠকে আসতে সন্তু লারমার দেরী করা, বৈঠকে সন্তু গ্রুপের প্রতিনিধিদের বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা এবং ছাড় দিতে অনীহা ইত্যাদির কারণে সন্তু গ্রুপের সাথে নির্বাচনী সমঝোতা হয়নি। বর্তমানে অনেক বিশিষ্টজন গত সংসদ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিযে দুই পার্টির মধ্যে সময় থাকতে সমঝোতা হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরছেন, কিন্তু সন্তু লারমা তাতে কোন কর্ণপাত করছেন না। সন্তু লারমার এক দোষ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, যার জন্য জুম্ম জাতিকে বহু ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে ও এখনো হচ্ছে।

উপসংহার: চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা যায়, জেএসএস সন্তু গ্রুপ জাতি ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে ইউপিডিএফের সাথে বৈঠক ও সমঝোতা করেনি। নিজের দলের সংকট কাটানোর জন্য অথবা জনমতের চাপে পড়ে লোকদেখানোর জন্যই তারা ইউপিডিএফের সাথে বৈঠক খেলা খেলেছে। আরও একটি কথা, ইউপিডিএফ জেএসএস বৈঠকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখনই জেএসএস ইউপিডিএফের সাথে বৈঠক চেয়েছে, অর্থা জেএসএস যখনই বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে, তখনই ইউপিডিএফ তাতে রাজী হয়েছে। অপরদিকে ইউপিডিএফ যত বারই জাতীয় স্বার্থে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে (আসলে শুরু থেকেই দিয়ে আসছে) ততবারই জেএসএস তা প্রত্যাখ্যান করেছে অথবা এড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে সমঝোতার প্রশ্নে ইউপিডিএফের আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, উদারতা ও সংযমের প্রকাশ লক্ষ্যণীয়। অপরদিকে জেএসএস সন্তু গ্রুপের দ্বিমুখী নীতি, ভণ্ডামী, কপটতা ও গণবিরোধী চরিত্রও আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তাই দেখা যায়, ইউপিডিএফের সাথে এত আলোচনা বৈঠক ও সমঝোতা সত্ত্বেও জেএসএস-এর ইউপিডিএফ নির্মূলের কর্মসূচী সব সময় বলব ছিল এবং এখনো আছে। এমনকি বৈঠক চলার সময়ও তার এই কর্মসূচীর পরিবর্তন বা বাতিল হয়নি। [সমাপ্ত]