বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

লোগাং গণহত্যা স্মরণে

আজ ১০ এপ্রিল ২০১৩ সাল। লোগাং গণহত্যার ২১ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৯২ সালের এদিন খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছগ্রামে সেনা-সেটলাররা পার্বত্য চট্টগামে স্মরণকালের বর্বরতম গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যায় কয়েকশ পাহাড়ি হতাহত হয়। শত শত ঘরবাড়িপুড়ে ছাই হয়ে যায়। আজকের এই দিনে এ হত্যাকাণ্ডে নিহতদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

১০ এপ্রিল ১৯৯২। দুপুরবেলায় হঠা শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। সেনা-বিডিআর, গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনী ও সেটলাররা পাহাড়িদের গুচ্ছগ্রামের উপর একযোগে হামলা চালায়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী(?)দল সেদিন বন্দুক দিয়ে আর সেটলাররা দা, কুড়াল, কিরিচ ইত্যাদি দিয়ে দুই ঘন্টার মত হত্যাযজ্ঞচালায়। পাহাড়িদের বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর যারা বাইরে ছিলএবং দৌঁড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল তাদের গুলি করা হয়। গ্রামের সব বাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়। আজকের এই দিনে এ হত্যাকাণ্ডেনিহতদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

লোগাং গণহত্যা এমন সময়েসংগঠিত সংঘটিত করা হয় যখন পাহাড়ি জনগণ মহান জাতীয় উতসব বৈ-স-বি(বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু)উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সে সময় খাগড়াছড়ি বৈসাবি উদযাপনকমিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঢাকা থেকে২৮ জন রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীকেআমন্ত্রণ জানায়। এ গণহত্যার ফলে আনন্দোতসব বাতিল হয়ে যায়। শোক ও কান্নায় ছেয়ে যায় সমগ্রপার্বত্য জনপদ। গণহত্যার পর পরই লোগাং এলাকা সেনাবাহিনী কর্তৃক sheield করে দেয়া হয়। বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবংতাদের দালাল দোসরদের ছাড়া কোন সাধারণ নাগরিককে উক্ত এলাকায় যেতে দেয়া হয়নি। ঢাকা থেকেআমন্ত্রিত সম্মানীত অতিথিবৃন্দকে সেনাবাহিনী উক্ত গণহত্যা সংঘটিত লোগাং এলাকায় যেতেদেয়নি। পানছড়িতে তাদেরকে আটকানো হয়।

লোগাং গণহত্যা দেশে বিদেশেএক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই ববর্রতার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাতে মুখর হয়ে ওঠেবিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও দেশ বিদেশের বিভিন্নমানবাধিকার সংগঠন। এ গণহত্যার প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ’৯২ সালের ২৮শে এপ্রিলখাগড়াছড়ি থেকে পদযাত্রা করে লোগাং পোড়া ভিটায় হত্যাকান্ডে নিহতদের স্মরণে পুষ্পমাল্যদিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

বার বার দেখা যায়, পাহাড়িদেরবৈসাবি উৎসব ঘনিয়ে এলেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলাসংঘটিত করে। যেমন ২০০৬ সালের মাইসছড়িতে পাহাড়িদের উপর সেটলার হামলার পর বৈসাবির আনন্দোৎসবপ্রতিবাদের মিছিলে পরিণত হয়েছিল। সে সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও রাজপথে নেমেছিল এবং বৈসাবিউৎসব বর্জনের ডাক দিয়েছিল। এরপর ২০১০ সালে সাজেক ওখাগড়াছড়িতে পাহাড়িদের উপর বর্বর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। বৈসাবি উৎসব শেষ হতে না হতেই ২০১১ সালে রামগড়েরশনখোলা পাড়া ও মানিকছড়িতে পাহাড়ি গ্রামে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও চট্টগ্রাম থেকে আসা পাহাড়িযাত্রীদের উপর বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। এ হামলায় আশীষ চাকমা চিরতরেনিঁখোজ হয়ে যায়।

এবার বড় ধরনের কোন ঘটনাসংঘটিত না হলেও খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বড়নাল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামপ্রাণ কুমার পাড়ায় সেটলাররা বিনা উস্কানিতে পর পর দু’ বার হামলা চালিয়েছে। তাদের হামলারপর উক্ত গ্রামের ২৭টি পাহাড়ি পরিবার এখনো ঘরবাড়ি ও গ্রাম ছাড়া হয়ে মানবেতর জীবন যাপনকরতে বাধ্য হচ্ছেন। বৈসাবি উৎসব শুরু হলেও সেটলারদের হামলার ভয়ে তারা  গ্রামে ফিরে যেতে পারছেন না। সেটলাররা প্রতিনিয়ততাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।

লোগাং গণহত্যা সহ পার্বত্যচট্টগ্রামে ডজনের অধিক গণহত্যা ও কয়েক ডজন সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তুকোন ঘটনারই আজ পর্যন্ত বিচার করা হয়নি। প্রকাশ করা হয়নি সঠিক তদন্ত রিপোর্টও। পার্বত্যচট্টগ্রামের কোন ঘটনা ঘটলেই সরকার যে কোন প্রকারে হোক ধামাচাপা দিয়ে রাখতে সর্বদা সচেষ্টথাকে। যেভাবে লোগাং গণহত্যার প্রকৃত চিত্র ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল।


পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিতসকল গণহত্যার সঠিক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও ঘটনার সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচারেরআওতায় নিয়ে আসার দাবিতে আমাদের আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণপ্রজন্মকেই এসব ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়েপড়তে হবে। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াবার মতো আমাদের আরজায়গা থাকবে না। তাই আসুন আমরা সকল ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধগড়ে তুলি। জুম্ম জনতার জয় হবেই হবে।