শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১

বিয়ে বাড়িতে ফেলাজেয়্যার দেখা

মাঘ আসতে না আসতেই পাহাড়ে শীত বেশ জেঁকে বসেছে। আমাদের দেশে শীতকালটা অনেকটা নামি-দামী অতিথির মতো। দু'এক দিনের জন্য এসে চলে যায়। কিন্তু এই ক'দিনের আপ্যায়নের জন্য নিতে হয় কত প্রস্তুতি, করতে হয় নানা আয়োজন। শীত বস্ত্র কেনা, বছর আগে যত্নে রাখা পুরোন গরম কাপড়গুলো বের করে রোদে শুকিয়ে ঠিকঠাক রাখা, ঘর গরম রাখার জন্য আলজ্যা বানানো ইত্যাদি কত কিছু করতে হয়।

শীতে আরও একটা বিষয় চোখে পড়ে। সেটা হলো এ সময় বিয়ের ধুম পড়ে যায়। পাহাড়ে শীতকালটা বিয়ের মৌসুমও। কোথাও না কোথাও 'মেলা' (বিয়ে) লেগেই আছে।

এজন্য ইদানিং প্রায় সময় বিয়ের দাওয়াত আসছে। জুম্মরাও আজকাল বিয়ের কার্ড ছাপায়। অনুষ্ঠানও হয় জাঁকজমক। এসব অনুষ্ঠানে যেনNauveau riche দের আভিজাত্য প্রদর্শনীর প্রতিযোগীতা চলে। নুয়্য জামেই নুয়্য বোকে গিফ্‌ট দেয়ার রেওয়াজ প্রচলন হয়েছে বহু আগে। হিল্লো সমাজটা কি দ্রুত 'আধুনিক' হয়ে যাচ্ছে?

নানা ব্যস্ততার কারণে ওসব বিয়েতে প্রায়ই যাওয়া হয় না। তাছাড়া এসব 'আধুনিক' অনুষ্ঠানে মনে হয় যেন নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। অনেক সময় নিজেকে প্রশ্ন করি আমি কি ব্যাক ডেটেড হয়ে যাচ্ছি? নাকি আধুনিকতার নামে ওরা খারাপ কিছু আমদানী ও চালু করছে? তবে যেই হোক, আমি ওসব অনুষ্ঠানে গেলে একদম 'ধুরি আন্যা অঘলক' হয়ে যাই।

তাই এটা ওটা বলে, নানা ছলনা করে ওসব বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো আমি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা আমার অভ্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু সব চেষ্টা কি সফল হয়! কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত্রি হয়। এইবার এই বাঘের কবলে কীভাবে পড়েছি তারই গল্প আজ আপনাদের শোনাচ্ছি।

আমার স্কুল জীবনের বন্ধু গৌরব। তাকে সঙ্গীরা লেঙুরো বলে ডাকতাম। একেবারে পরাণে পরাণ বন্ধু। একসাথে কত খেলেছি, স্কুলে গেছি, নদীতে মাছ ধরেছি, আর কত কিছু করেছি, তার কি সবই মনে থাকে, নাকি অন্যকে বলা যায়! স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমি দূরে চলে যাই; আর সে খাগড়াছড়ির একটি কলেজে ভর্তি হয়। তারপরও আমাদের মধ্যে বার দুএক দেখা সাত হয়েছে, চিঠিপত্রের আদান প্রদানও হয়েছে। এমনকি তার বিয়ে ও প্রথম কন্যার 'কোজোই পানি লনা'র অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থেকেছি। এমন বন্ধুর সাথেও যে একদিন অদেখার দীর্ঘ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তা তখনো বুঝতে পারিনি। মহা পরিনির্বাণের আগে মহামতি বুদ্ধ আনন্দকে বলেছিলেন, (বুদ্ধ পরিনির্বাণ গেলে তাকে আর দেখতে পাবেন না বলে আনন্দ কাঁদছিলেন) এক অযুত দুই অযুত কাল বেঁচে থাকলেও একদিন আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হবেই। এটাই জগতের নিয়ম। মিলন হলে বিচ্ছেদ অনিবার্য। জগতের নিয়েমেই আমাদেরও সেদিন বিচ্ছেদ হয়েছিল। কিন্তু বিধাতার কোন নিয়মে আজ আমাদের মধ্যে আবার দেখা হলো! জগত বিধাতা বড়ই বিচিত্র!

থাক দর্শনের কথা। কী বলতে কী বলে ফেলি! তো, আমার ছেলেবেলার বন্ধু গৌরব একদিন বলা নেই কওয়া নেই আমার কাছে এসে হাজির। আমি তো তাকে দেখে তাজ্জব। চিনতেই পারছিলাম না। কিভাবে আমার ঠিকানা পেয়েছে, কিভাবে এসেছে, আসতে কোন ঝামেলা হয়েছে কিনা ইত্যকার অহেতুক প্রশ্নবানে তাকে জর্জরিত করলাম। সে আমার গুচ্ছপ্রশ্নের উত্তরে কী যেন বললো এখন আর মনে নেই। এরপর আমি তাকে খোঁচা মেরে হেসে বললাম: 'তো কী জন্য তোমার বন্ধুকে এতদিনে মনে পড়লো? কোন ঠেকায় পড়েছো নাকি? নাকি আমাদের দলের কোন কর্মী তোমার বা তোমার কোন আত্মীয়ের ওপর খারাপ কিছু করেছে?' সে আমার একগাদা প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে হাতে একটা বড় সাইজের এনভেলপ ধরিয়ে দিলো। খামের ওপর ডান পাশে সুন্দর অরে আমার নাম লেখা। বাম পাশে উপরে আলপনার মাঝে আলতোভাবে আঁকা নারীমূর্তি, যেমনটা বিয়ের কার্ডে সচরাচর দেখা যায়।

আমি আরেক বার তাজ্জব বনে গিয়ে আচমকা বললাম: তোমার মেয়ে ধনবি এত বড় হয়েছে? সে জানালো, মেয়ে ও জামাইয়ের সম্মতিতে বিয়েটা হচ্ছে। জামাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে একটি এনজিওতে চাকুরী করে। তবে 'চাকুরী করে' না বলে ওই এনজিওটার মালিক বললেই যথার্থ হতো কিন্তু সেটা শোভন নয়। তার মেয়েও নাকি গ্রাজুয়েশনের পর একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করছে। আমার বন্ধু আরো জানালো যে, তার মেয়ে ধনবিও কলেজে পড়ার সময় প্রসিত খীসার দলের হিল উইমেন্স ফেডারেশন করতো, আর জামাই করতো সন্তু লারমার দল।

"আচ্ছা, খুব মজার তো" আমি বললাম। "তো কীভাবে বৈপরিত্যের ঐক্য হলো?" বিষ্ময়সমেত আমার প্রশ্ন। সে জানালো সে সব জানে না, কারণ এটা ছেলেমেয়েদের নিজস্ব বিষয়। বেশী উৎসুক্য প্রকাশ পেলে পাশে তাদের 'আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ' ও 'স্বাধীন ব্যক্তির সার্ভভৌমত্বকে' আন্ডারমাইন করছি বলে রব উঠে সে ভয়ে কান থাকলেও না থাকার, চোখ থাকলেও না দেখার ভাণ করতে হয়েছে। তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, বর্তমান যুগ ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ, গ্লোবালাইজেশনের যুগে আন্তঃব্যক্তিক ব্যাপারগুলো এখন খুবই সেনসিটিভ।

আমি পরে আমার নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা ছিঃআইএ মারফত আমাদের এই নব্য 'রাধামন - ধনপুদির' মিলনের যে ইতিহাস উদ্ধার করেছি তাতে আমি রীতিমত চমকিত হয়েছি। আসলে দুনিয়ায় যা আশা করা হয়, তা হয় না; যা আশা করা হয় না, তাই হয়। চুম্বকের বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। পদার্থ বিজ্ঞানের এই সূত্র প্রেম বিজ্ঞানেও যে মূর্ত হয়ে দেখা দিতে পারে সে কথা কষ্মিনকালেও ভাবিনি। ভাবলে অপদার্থবিদ উপাধি লাভ হতো তা নিশ্চিত। এমনকি বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংসএর বিগ ব্যাংগ থিওরী আবিস্কারের মতো 'স্মল ক্র্যাক' সূত্র আবিস্কার করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলে অপদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার মতো ছিল না। সে রকম ভাবতে পারি না বলে আমার কপালে কোন পুরস্কারই কোনদিন জুটলো না।

যাক, বন্ধুর কথায় ফিরে আসি। তার পীড়াপীড়িতে অগত্যা বিয়েতে যেতে রাজী হতে হলো। আমি পার্টির কাজ, ব্যক্তিগত অসুবিধা, ইত্যাদি একের পর অজুহাতের বাণ ছুঁড়ে আমন্ত্রণ ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু বন্ধুত্বের মধুর ভাষা আমার প্রতিরোধের সকল অস্ত্র নিস্তেজ করে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে আমি বললাম, আমি তো একা যেতে পারবো না। আমার সাথে আরো কয়েকজন যাবে। সে বললো, সে কি বলতে হয় নাকি? তোমাকে নিমন্ত্রণ করা মানেই তো একসাথে অনেক জনকে আমন্ত্রণ করা। এতো আমাদের বাড়তি পাওনা।

এক সপ্তাহ পর আমন্ত্রণ রা করার দিন উপস্থিত হলো। আমি নির্দিষ্ট সময়ে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে হাজির। কিন্তু দেখি আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে আমিই (আমার লোকজনসহ) প্রথম 'আসামী হাজির'। মনে মনে বললাম স্কুল কলেজে পরীায় তো জীবনে কোন দিন প্রথম হতে পারিনি, আজ বিয়ের দাওয়াত রায় প্রথম হলাম, এটাও বা কম কিসে। তারপরও আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকলাম। আজকাল কোন আলোচনা সভা, মিটিঙ বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে দেরীতে উপস্থিত হওয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সময় জ্ঞান আমাদের দিন দিন লোপ পাচ্ছে। পাঁচটায় মিটিঙের সময় দেয়া হলে লোকজন আসতে শুরু করে ৬টা থেকে। তারপর অনুষ্ঠন শুরু করতে বেজে যায় ৭টা। এর পরও আমন্ত্রিতদের সবাই উপস্থিত হয় না। যারা দেরীতে আসে তারাই সবচেয়ে ব্যস্ত এবং যারা সবচেয়ে ব্যস্ত তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তথা ভিআইপি, ভেরী ইম্পর্ট্যান্ট পারসন, অথবা তারও উপরে ভিভিআইপি বা ভেরী ভেরী ইম্পর্ট্যান্ট পারসন - এ রকম একটা ধারণা আমাদের মধ্যে অবচেতনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে যারা নির্দিষ্ট সময়ে মিটিঙে হাজির হয় তারা সাধারণ লোক, আম জনতা। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে ঠিকমত কাজ চলবে কীভাবে? আমাদের পশ্চাদপদতার জন্য যেসব কারণ দায়ি তার মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব হলো একটি।

কিছুক্ষণ পর একে একে আসতে শুরু করলো এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যে পুরো বিয়ে বাড়ি উঠোনসহ লোকজনে ভরে গেলো। চেনা অচেনা অনেকের সাথে দেখা হলো এবং এক পর্যায়ে আলাপ জমে উঠলো। প্রথমে পারিবারিক কুশলাদি থেকে শুরু হয়ে আবহাওয়া, কৃষি, তারপর কে কোথায় চাকরী পেলো ইত্যাদি এটা ওটা আলোচনা শেষে চিরাচরিত বিষয় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে এসে বিতর্ক জমে উঠলো।

চাকুরীর কথা যখন উঠলো তখন কান টানলে মাথা আসে সূত্র অনুযায়ী জেলা পরিষদের দুর্নীতির প্রসঙ্গও আসলো। অনেকে জেলা পরিষদের বিষয়ে এন্তার অভিযোগ তুলে ধরলো, তারপর ক্ষোভ প্রকাশ করলো। একজন বললো, 'চাকুরী না হয় না দেবে, কিন্তু টাকাগুলো নিলো কেন? কত কষ্ট করে বেচাররা ওই টাকা জোগাড় করেছে।'

আরেকজন বললো, 'চাকুরীগুলো তো কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আগেভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ কারণে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য মন্ত্রী জেলা পরিষদের দুর্নীতির বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করে না।'

'তিন ইউপিডিএফ নেতার স্ত্রীও নাকি জেলা পরিষদের চাকুরী পেয়েছে।' এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মনে করে একজন সবাইকে জানালো।

আড্ডায় শিক্ষা বিভাগে চাকুরী করেন এমন একজন, কংজাই মারমা উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, 'জেলা পরিষদের লোকজন যথেষ্ট চালাক। তারা জানে কাকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়। আমার ধারণা ইউপিডিএফের মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্যই ওই তিনটা পদ তাদেরকে দেয়া হয়েছে। ইউপিডিএফ নেতাদের ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।'

ইউপিডিএফের কথা উঠতেই একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলো সন্তু গ্রুপের প্রতি যে ঐক্য-সমঝোতার আহ্বান দিয়েছি তাতে আমরা কতটুকু আন্তরিক। আমি তাকে বললাম যে আমাদের ওই প্রস্তাব নতুন নয়, ২০০০ সাল থেকে আমরা ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে আসছি। সমঝোতার জন্য প্রয়াত উপেন্দ্র লাল চাকমাসহ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রচেষ্টা, অন্য অনেকের মধ্যস্থতার প্রস্তাব, কোথায় কখন কতবার জেএসএসের সাথে বৈঠক হয়েছে ও সে সব বৈঠকের ফলাফল কি হয়েছে, জেএসএস কিভাবে সমঝোতা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে ইত্যাদির বিবরণ দিয়ে তাকে বললাম, 'সুতরাং সন্তু গ্রুপ যে ঐক্য-আলোচনায় আসছে না তার কারণ ভিন্ন কিছু হতে পারে।'

ঢাকায় একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন সঞ্জিত ত্রিপুরা। তিনিও বিয়ে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। এতণ তিনি আমাদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আমার কথার পর তিনি বললেন, 'আমি একটু ফোর নিতে চাই। সংঘাত যেভাবে শুরু হোক, ইউপিডিএফকে অন্তত এ জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে যে তারা বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যের প্রস্তাব দিয়েছে। তাছাড়া জেএসএস ইতিপূর্বে দুই তিন বার সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করার পরও ইউপিডিএফ নেতারা ঐক্যের প্রস্তাব দিচ্ছেন। তাদের শক্তিও আগের চাইতে বেড়েছে। কাজেই তারা দুর্বল অবস্থানে থেকে নয়, বরং তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ও ভালো অবস্থানে থেকে এই প্রস্তাব দিচ্ছেন। তাই এখানে আন্তরিকতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা নিতান্তই অবান্তর।'

নাতিদীর্ঘ একটা লেকচার দেয়ার পর তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন ইউপিডিএফ এখন কী করবে। আমি তার উত্তর দিতে যাচ্ছি এমন সময় একটি বেসরকারী কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক ঝিমিত দেওয়ান গুরু গম্ভীর কণ্ঠে বললো: আসলে সবকিছু নির্ভর করে শর্তের উপর। বর্তমানে যে fratricidal conflict চলছে তার কারণ চুক্তির পর এই সংঘাতের শর্ত তৈরি হয়েছে। যখনই এই শর্তগুলো ধীরে ধীরে লোপ পাবে বা নতুন শর্ত এই বর্তমান শর্তগুলোকে অপসারণ করবে তখনই সংঘাত বন্ধ হবে। নতুন শর্তের মধ্যে ধরতে পারেন ইউপিডিএফের ঐক্যের প্রস্তাব, সংঘাত বন্ধের পে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেবল এই দু'টি শর্ত সংঘাত বন্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। আরও কিছু সাবজেক্টিভ শর্ত সৃষ্টি করতে হবে আমাদের।"

এ সময় একজন তাকে প্রশ্ন করলো, আপনার মতে আর কী ধরনের শর্ত দরকার সংঘাত বন্ধের জন্য, আর সেই শর্তগুলো কীভাবে আমরা সৃষ্টি করতে পারি?

সরাসরি উত্তর না দিয়ে অধ্যাপক সাহেব বললেন: আপনারা হয়তো অনেকে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের আত্মজীবনীমূলক বই A Journey পড়ে থাকতে পারেন। এই বইয়ে তিনি নর্দান আয়ারল্যান্ডের শান্তি আলোচনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এবং ১০টি central principles of resolution-এর কথা বলেছেন। ৫ নং নীতিতে তিনি বলেছেন “The conflict won’t be resolved by the parties if left to themselves. If it were possible for them to resolve it on their own, they would have done so. Ergo, they need outside help.”

"এই মধ্যস্থতাকারী বা তৃতীয় প বা তার ভাষায় বহিঃপ এর কী ভূমিকা হওয়া উচিত সে সম্পর্কে টনি ব্লেয়ার সাহেব যা বলেছেন তা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘The point is the outside party do not just help negotiate and mediate: they act as a buffer, a messenger and, crucially, as a persuader of good faith in a climate usually dominated by distrust. They also help define issues and indeed turning points.’

অধ্যাপকের কথা সবাই হা করে শুনছিল। তিনি এতটুক বলার পর থেমে গেলেন, অন্যরাও চুপ করে রইলেন। কি বলবেন কেউ ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন: "যারা ইউপিডিএফ-জেএসএস এর চলমান conflict কীভাবে মীমাংসা করা যায় সে সম্পর্কে ভাবেন তারা টনি ব্লেয়ারের এই কথাগুলো থেকে কিছুটা হলেও কিউ পেতে পারেন। তবে সাকসেসের গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো না। কারণ টনি ব্লেয়ার নিজে উত্তর আয়ারল্যান্ডে চুক্তি করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারলেও আরব-ইসরায়েল শান্তি আলোচনায় ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি আরবদের আস্থা হারিয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি honest broker নন এবং ইসরেয়েলীদের প্রতি তার পক্ষপাত রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আরো নানা কিসিমের অভিযোগও শোনা যায়। আমি নিজেও টনি ব্লেয়ারের রাজনৈতিক দর্শন ও বিভিন্ন পলিসির সাথে মোটেই একমত নই। তবে তার পয়েন্টগুলো গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই।"

অধ্যাপকের কথা শেষ হলে অন্দর মহল নাকি কোথা থেকে একজন এসে হঠাৎ তাকে নমস্কার দিয়ে বললো: 'স্যার, আমার নাম চুচ্যাঙ্যা। আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না। আমি এক সময় জেএসএস করতাম। এখন দল ছেড়ে দিয়ে টুকটাক এটা ওটা করে সংসার চালাচ্ছি। আমি আপনার কথা বেড়ার ওপাশ থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম।'

অধ্যাপক বললেন 'আপনাকে না চিনলেও আপনার নাম চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনি ব্লগার নাকি, ফেইসবুকে লেখেন?'

চুচ্যাঙ্যা বললেন, "না স্যার, আমি একজন সাধারণ পাবলিক। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানি না। তবে কয়েকদিন আগে আমার বন্ধু অডংকে আমার কিছু প্রশ্ন ইন্টারনেটে ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। ইউপিডিএফের কাছে এই প্রশ্নগুলো রেখেছিলাম। চমক দেয়ার জন্য অডংকে ফেলাজিয়া নামে ফোন করেছিলাম, এখন সে এই নামটাই ইন্টারনেটে চালু করে দিয়েছে।'

তার কথা শুনে আমি বললাম 'ও, তাহলে আপনি সেই ফেলাজেয়া বাবু? হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আপনার প্রশ্নগুলো দেখেছি।'

অধ্যাপক চুচ্যাঙ্যা ওরফে ফেলাজেয়্যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'যাকে আপনি প্রশ্ন করেছেন তিনি নিজেই আপনার সামনে বসে আছেন।' আমার দিকে আঙুল তাক করে তিনি বললেন, 'এই যে ইনিই হলেন নিরন বাবু, ইউপিডিএফের বি-বি-খ্যাত নেতা। তার মুখ থেকেই সরাসরি আপনার প্রশ্নের জবাব জেনে নিন।'

'অধ্যাপক সাহেব এটা কি একটু বেশী বাড়াবাড়ি হলো না? আমি কখন বিখ্যাত নেতা হলাম, আমি নিজেকে একজন অতি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী মনে করি।' তারপর চুচ্যাঙ্যাকে ল্য করে বললাম, 'সব কিছু তো ইন্টারনেটে ফেইসবুকে বলা যায় না। আপনি একদিন আমাদের অফিসে আসেন না কেন, এসব বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ করা যাবে।'

'ঠিক আছে, তাই হবে।' চুচ্যাঙ্যা বাবু জানালেন।

সঞ্জিত অনেকণ ধরে আলোচনা শুনছিলেন। ইন্টারনেটের কথা উঠতেই তার মনের ভাব প্রকাশ না করে থাকতে পারলেন না: 'আমিও সিএইচটিবিডির বিতর্কগুলো পড়েছি। তবে আমার কেন জানি মনে হয় ওখানে আঙুল ঢুকে পড়েছে। বিশেষত আমার দু'একজনকে খুবই সন্দেহ হয়।'

এদিকে আলোচনার ফাঁকে সময়বাবু যে অনেকদূর চলে গেছে সেদিকে কেউ খেয়াল করেনি। ক্ষিদে নামক রাসটাও অনেকের পেটে গোঙানি শুরু করে দিয়েছে। অবশেষে বিয়ে বাড়ির প্রধান গৌরব নিজে এসে খানা রেডি হওয়ার সংবাদ দিলেন। আমরাও তাড়াতাড়ি আসনে বসে গেলাম।

গৌরব ঘুরে ঘুরে 'লারে গুরি হিয়্য' বলে আমাদের লভিয়ত (আপ্যায়ন) করলেন, আর আপে করে বলতে লাগলেন, 'এখন মেলা মেঝবানে পুজ্জুনী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যুবক যুবতীরা লখাপড়া অথবা ঢাকা-চট্টগ্রামে মিল কারখানায় চাকুরীতে ব্যস্ত।'

খাওয়ার পর চুচ্যাঙ্যা বাবুর সাথে আলোচনার দিন তারিখ ঠিক করে নতুন বউকে আশির্বাদ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে আসলাম।
নির্দিষ্ট দিনে চুচ্যাঙ্যা বাবু তার এক বন্ধুকে নিয়ে আমাদের পার্টি অফিসে হাজির হলেন। তাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। তিনি তার গেরিলা জীবনের রোমাঞ্চকর কথা শোনালেন। বললেন তিনি বহু আশা নিয়ে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মনে প্রাণে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। প্রসিত খীসার নেতৃত্বে বাইরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হওয়ায় তিনি ও তার কমরেডরা অত্যন্ত খুশী ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দ্বিগুণ উসাহ নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি বললেন, "আমরা তো জানতাম ভেতরে বাইরে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কাজ হচ্ছে। কিন্তু একদিন হঠা আমাদের কাছে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসে প্রসিতসহ ৫ জনকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে গ্রেফতার করতে হবে। আমরা যারপর নাই হতবাক হয়েছি। কিন্তু উপরের নির্দেশ কোন প্রশ্ন করা যাবে না।"

তিনি আক্ষেপ করে আরো বললেন যে, চুক্তি সম্পর্কে তাদেরকে কোন ধারণা দেয়া হয়নি, মতামত নেয়া তো দূরের কথা। কেবল বলা হয়েছে অস্ত্র জমা দিতে হবে।

দুঃখ করে বললেন, 'যাই হোক, চুক্তি হলো, যা পাওয়া গেছে তাই সদ্ব্যবহার করে জনগণের স্বার্থে কাজ করা হবে এই ছিল আমাদের আশা। কিন্তু তাও হলো না। জেলা পরিষদের নেতৃত্বের যে হাল, আমাদের নেতৃত্বেরও তাই হলো।'

আমাদের কথা ঘুরে ফিরে ওই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে এসে পড়লো বার বার। তিনি রাক ঢাক না করে তার হতাশার কথা ব্যক্ত করলেন। জুম্ম জাতির সেরারাই এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে আফসোস করলেন। আমি বললাম একজন সংগ্রামী বিপ্লবীর হতাশ হওয়া সাজে না। শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই হলো তার কাজ। আপনার এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ঠিক হয়নি।

তিনি বললেন 'আমি তো একজন সামান্য মানুষ। আমি কী করতে পারি।"

আমরা সামান্য হতে পারি, কিন্তু কেউ ফেলাজেয়্যা নই। আপনিও অনেক কিছু করতে পারেন।

যেমন?

আমি নাতিদীর্ঘ একটা বক্তব্য দিতে শুরু করলাম: 'আপনি যেহেতু ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত নিয়ে চিন্তিত, এটা বন্ধের জন্য আপনি কাজে লেগে যেতে পারেন। প্রত্যেকের এটা করা উচিত। এটা একটা দায়িত্ব। পাড়ায় কারো বাড়িতে আগুন লাগলে আমরা কী করি? আমরা গ্রামের সবাই সেই আগুন নেভানোর জন্য যার যার সাধ্যমত চেষ্টা করি। কারণ প্রথমত এটা একটা সামাজিক দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত তার সেই আগুনে আশে পাশের অনেকের বাড়িও পুড়ে যেতে পারে। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের যে আগুন এখন জ্বলছে সেটাও নেভানোর দায়িত্ব আছে আমাদের। কিন্তু আমরা কী সে দায়িত্ব পালন করছি? নিজো হিয়াত গরম ন ফুদিলে আমি জুরো থেই। নিজো হিয়াত পল্লে থে আমার দুনিয়া আন্ধার অয়। কিন্তু নিজের গায়ে পড়ার আগে আমাদের খবর থাকে না।'

তিনি ও তার বন্ধু আমার কথায় সায় দিলেন। তার বন্ধু বললেন আমিও তো বলি আমাদের কিছু একটা করা উচিত। আমরা আমাদের ছেলেদের এভাবে মরতে দিতে পারি না।

আমি বিয়ের বাড়িতে অধ্যাপকের বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, 'কোন সমস্যা যতই কঠিন হোক (অধ্যাপক ইংরেজীতে intractable শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন) বার বার চেষ্টা করলে তার সমাধান পাওয়া যায়। অনবরত বারিবিন্দু পড়ে পাথর পর্যন্ত ক্ষয় হয়ে যায়।'

তার বন্ধু বললেন, 'আমাদের সমস্যার সমস্যা হলো আমরা জুম্মরা কোন কাজে বিনি আদা করে লেগে থাকতে পারে না। অথচ লেগে থাকতে না পারলে কোন কিছুতে ফল পাওয়া যায় না।'

এরপর আমি অডং বাবুর মাধ্যমে চুচ্যাঙ্যা বাবু যে প্রশ্ন রেখেছিলেন সে প্রসঙ্গে চলে আসলাম; বললাম চুক্তি বাস্তবায়নে ইউপিডিএফের সহযোগিতার ধরণ কী হবে সেটা নেগোশিয়েশনের বিষয়। সব কিছু আগাম বলা ঠিক নয় আর সব জায়গায় সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমি তাকে একজন সংগঠন করা লোক ও একজন সাধারণ লোকের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্যের কথা তুলে ধরলাম। তার পর ইউপিডিএফ কেন গঠন হলো, কী ধরনের কঠিন কঠোর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে ও এখনো হচ্ছে, পার্টি কী চায়, আন্দোলনের ধরণ কী হতে পারে, এতে কার কী ভূমিকা থাকা উচিত এ সব ব্যাপারে সংক্ষেপে বললাম।

তিনি বললেন, 'আসলে আমার বোকামি হয়েছে। সংগঠন থেকে দূরে থাকায় আমার চিন্তা চেতনাও যেন লোপ পেতে বসেছে। নামটা আমার চুচ্যাঙ্যা হলেও দিন দিন ভুত্যাং হয়ে যাচ্ছি।' শেষ বাক্যটি বলে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন।

এরপর তিনি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন বলে অঙ্গীকার করলেন। নতুন করে আন্দোলন শুরু করার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। বিদায় নেয়ার আগে বললেন আমার সাথে আলাপ করে তার ভালো লেগেছে এবং মাঝে মধ্যে এভাবে আলোচনা করার জন্য অফিসে আসলে আমি বিরক্ত হবো কীনা জিজ্ঞেস করলেন।

'মোটেই না। বিরক্ত হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আমাদের অনেক কাজের মধ্যে একটি হলো জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের, জিজ্ঞাসার জবাব মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা।

আমার সাথে হ্যান্ডচেক করে তারা দু'জনে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোলেন। আমি বললাম, 'আপনার বন্ধু অডং বাবুকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন এবং বলবেন তিনি যেন তার ফেইসবুকে লেখালেখিটা চালু রাখেন।'

'আচ্ছা বলে দেবো' বলে তারা চলে গেলেন।


সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১

ফেসবুক আলোচনা-৪

প্রিয় অডঙ,
আমাদের পার্টির জন্মদিনে শুভ কামনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ (ইউপিডিএফ-এর জন্মদিন ও কিছু চাওয়া)। ইউিপিডিএফ গঠনের পটভূমি বিশ্লেষণ পূর্বক আপনি কিছু পরামর্শও দিয়েছেন। এতে আমরা আপনার দায়িত্ববোধের পরিচয় পাই। এ জন্যও আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

আমাদের কাজের নীতি, আদর্শ, কর্মসূচী ও ...কলাকৌশলের আলোচনা বিশ্লেষণ সমালোচনা হবে সেটা খুবই স্বাভাবিক। একভাবে আমরা সেটা প্রত্যাশা করি। কারণ পার্টিকে ঠিক রাখার জন্য জনগণের কঠোর পর্যবেক্ষণ ও তদারকি দরকার। তবে আমার যা প্রত্যাশা থাকবে তা হলো, আমরা যাতে গামলার পানিটার সাথে বাচ্চাটাকেও ছুঁড়ে ফেলে না দিই। We should not thow the baby out with the bathwater. (কথাটার ওপর জোর দেয়ার জন্য ইংরেজী বাক্যটা বলা হলো) অর্থা আমরা চাই, পার্টির ভুল ত্রুটি সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা যেন পুরো পার্টিকেই শেষ করে না দিই, ফেলে না দিই। আমরা যাতে সমালোচনা করা বলতে কেবল ভুল ধরিয়ে দেয়া না বুঝি, কাউকে কালো রঙে চিত্রায়িত করা না বুঝি। আমাদের মধ্যে প্রয়োজনে কঠোর কঠিন সমালোচনা হোক, বিতর্ক হোক, বিতর্কে হারজিত হোক, যুক্তি পাল্টা যুক্তি হোক, কিন্তু যাতে সেটা শত্রুতার পর্যায়ে না যায় আর যাতে আমরা আমাদের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হই। আমাদের বিতর্ক সমালোচনা পরিচালিত হতে হবে বৃহত্তর ঐক্যের অভিমুখে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সমাজে একটি পার্টি সহজে জন্মলাভ করতে পারে না; প্রয়োজন, দাবি ও অনুকুল পরিস্থিতি না থাকলে এটা অসম্ভব। কেবল মাত্র তরুণ নেতার ক্ষোভ একটি পার্টিকে জন্ম দিতে পারে না। একটি পার্টির জন্ম ও বিকাশের জন্য কিছু সাবজেকটিভ ও অবজেকটিভ শর্তের প্রয়োজন হয়। এটা অনেকেটা একটা সন্তানের জন্ম দান ও লালন পালনের মতো। সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না, কারণ আমার দৃষ্টিতে বিষয়টা বেশ গভীর এবং আলোচনা করতে অনেক সময়ের দরকার হবে।

আপনাকে ও অন্যান্য যারা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি।


বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১

কিরণ বাবুর ‘কিছু অজানা কথা’ প্রসঙ্গে

কিরণ বাবুর লেখাটি পড়লাম। তিনি ৯৬ সালের নির্বাচনে কার কি ভূমিকা সে সম্পর্কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। এ সম্পর্কে আমার জানা কিছু তথ্য তুলে ধরছি। পুরো বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য আগে ৯১ সালের নির্বাচনের ওপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেশে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বহু বছর পর নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা থেকেও প্রার্থী দেয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তখন পিসিপির সভাপতি ছিলেন বিশ্বজি চাকমা (গুল)। পাহাড়ি গণপরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন বিজয় কেতন চাকমা। দীপংকর তালুকদার রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে কানাডায় পাড়ি জমানোর পথে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সুযোগ বুঝে তিনি কলকাতা থেকে দ্রুত ঢাকা চলে আসেন এবং আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি এ জন্য যে কৌশলের আশ্রয় নেন তার তারিফ করতে হয়। তার পে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সরকারের সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারী শরদিন্দু শেখর চাকমা। যতদূর জানা যায় ঢাকায় প্রদানেন্দু বাবুর বাসায় নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে ঢাকাস্থ জুম্ম মুরুব্বীদের একটি মিটিঙের আয়োজন করা হয়। সেই মিটিঙে বিজয় কেতন বাবুকেও রাখা হয় কৌশল হিসেবে। মিটিঙে দীপংকর তালুকদারের প্রার্থীতা সমর্থন করে লিখিতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিজয় কেতন বাবু অনেকটা সৌজন্যতার খাতিরে সেই সিদ্ধান্তে স্বার করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে বিশ্বজি চাকমা ওই মিটিঙে উপস্থিত না থাকলেও পিসিপির সভাপতি হিসেবে তার স্বাক্ষর অন্য একজন দিয়ে দেন, তার কোন সম্মতি না নিয়ে। এরপর দীপংকর তালুকদার মিটিঙের রিজ্যুলেশন নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যান এবং তার মনোনয়ন নিশ্চিত করেন।

৯১ সালের নির্বাচনে জেএসএসের ভূমিকাও স্পষ্ট ছিল না। এ সময় থেকে জেএসএস নেতৃত্ব লেজুরবাদী ও আত্মসমর্পনবাদী লাইন গ্রহণ করেছিল। তারা 'তৃতীয় পক্ষের' মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে চেয়েছিল। এজন্য ঢাকায় শেখ হাসিনার কাছে চিঠিসহ একজন প্রতিনিধিকেও পাঠিয়েছিল। কিন্তু হাসিনা তার সাথে দেখা করেননি। পরে সমঝোতা ছাড়াই জেএসএস আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থন দেয়।

৯৬ সালের নির্বাচনে পিসিপি দীপংকর তালুকদারকে সমর্থন দিয়েছিল এ তথ্য সঠিক নয়। আমার জানা মতে জেএসএসও প্রথম দিকে তাকে সমর্থন দেয়নি। এই নির্বাচন যখন হয় তখন প্রসিত খীসা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পাহাড়ি গণ পরিষদের হাল ধরেন। পিসিপি-পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ চেয়েছিল কোন দলের না হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়া হোক। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের প্রশ্নে কোন পার্টিরই সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল না (এখনো নেই)। আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালে পাহাড়িদের বাঙালি বানিয়েছিল। বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে জুম্মদেরকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকী দিয়েছিল। এ কারণে জেএসএসকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি চার লক্ষ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করে, একের পর এক গণহত্যা চালায়, পার্বত্য চট্টগ্রামকে শ্মশান বানিয়ে দেয়। তাই এ দলগুলোকে নির্বাচনে সমর্থন দেয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু জেএসএস বাইরে এত বছর ধরে আন্দোলনরত তিন সংগঠন বা অন্য কারোর মতামত না নিয়ে মনগড়াভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্তু লারমা আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরের সাথে এ বিষয়ে একটি অলিখিত চুক্তি করে ফেলেন। (খেয়াল করবেন আওয়ামী লীগের সাথে অলিখিত চুক্তি করার অভ্যাস তখন থেকেই শুরু) তাদের দু'জনের বৈঠকে দূতিয়ালী হিসেবে কাজ করেন এডভোকেট শক্তিমান চাকমা। বৈঠকটি হয় ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোন এক জঙ্গলাকীর্ণ আস্তানায়। সেখানে যে সিদ্ধান্ত হয় তা হলো এই -- জেএসএস তিন জেলার প্রার্থীদের নাম দেবে। আওয়ামী লীগ তাদেরকে দলীয় মনোনয়ন দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই অলিখিত চুক্তির সম্পূর্ণ বরখেলাপ করে তার পছন্দমত প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়। ফলে জেএসএস তখন চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। মাঝ দরিয়ায় নৌকাডুবির মতো অবস্থা। এ কুলেও ফিরতে পারছে না, ওকুলেও পার হতে পারছে না। শেষ বেলায় কি করবে কোন উপায় না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে খাগড়াছড়িতে হংস ধ্বজ বাবুকে ও রাঙামাটিতে বিজয় কেতন বাবুকে সমর্থন দেয়। তবে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে জেএসএস কর্মীরা যার যার মত কাজ করে। কেউ সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগকে, আর কেউ প্রচারণা চালায় বিজয় কেতন বাবুর পক্ষে। জনগণ চরমভাবে বিভ্রান্ত হয়। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের মধ্যে যে এত আওয়ামী লীগ প্রীতি তা তো এক দিনে হয়নি। এই ক্ষেত্র তো জেএসএসই তৈরি করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার জন্য লোকজনের ওপর জোর জবরদস্তি করা হয়েছিল। অথচ ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রামে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। প্রধানত জেএসএস নেতৃত্বের ভুলের কারণেই আওয়ামী লীগ হিলে শিকড় গাড়তে পেরেছে।

দুই বা ততোধিক পার্টির মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য বা অন্য কোন বিষয়ে সমঝোতা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কৌশলগত ঐক্য আর সুবিধাবাদী ঐক্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগের সাথেও ক্ষেত্র বিশেষে ঐক্য হতে পারে বৈকি। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের জন্য যেভাবে জেএসএস আওয়ামী লীগের সাথে মৌখিক বা অলিখিত চুক্তি করেছে তা সুবিধাবাদী ঐক্য এবং চুক্তির ধরণটাও ঠিক ছিল না। ইউপিডিএফের বর্তমান নেতৃবৃন্দ সে সময় জেএসএস নেতৃত্বকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বার বার সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জেএসএস তাতে কণামাত্র কর্ণপাত করেনি। আওয়ামী লীগ যে কত ধূর্ত তা তারা সে সময় বুঝতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ওবায়দুল কাদেরকে সন্তু বাবুর সাথে দেখা করতে জঙ্গলে পাঠিয়েছিলেন, কারণ তখন তাদের প্রয়োজন ছিল। কারণ তখন জেএসএসের জনসমর্থন ছিল এবং সেই জনসমর্থন আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে কাজে লাগানোর দরকার ছিল। অথচ ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জেএসএসকে ফিরেও তাকায়নি। সন্তু বাবু এই দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালান। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা সন্তু বাবুকে সাক্ষাত পর্যন্ত দেননি। তাই অবশেষে ২০০১ সালে তিনি বিএনপি নেতা মান্নান ভূঁইয়ার সাথে দেখা করে বিএনপি প্রার্থীদের সমর্থন দেন। অবশ্য বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও জেএসএস প্রকাশ্যে নির্বাচন বানচালের হুমকী দিয়ে ইউপিডিএফ সমর্থিত এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে হাসিনার সাত না পেয়ে শেষ বেলায় সন্তু লারমা রাঙামাটি ও বান্দরবানে তার দলের প্রার্থী দাঁড় করান।

কাজেই দেখা যায়, জেএসএস নেতৃত্বের ভুল নীতি, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা, সুবিধাবাদিতা, আত্মসমর্পনবাদী-পরাজয়বাদী লাইন ও পরাশ্রয়বাদী মানসিতার কারণে নির্বাচনে বার বার ভরাডুবি হয়েছে। ১৯৯১ ও ৯৬ সালের নির্বাচনের ভুলের মাশুল এখনো পর্যন্ত জেএসএস ও ইউপিডিএফ উভয় পার্টিকে দিতে হচ্ছে।

উপরের আলোচনা থেকে বিষয়টি কতটুকু স্পষ্ট করতে পেরেছি জানিনা, তবে যতদূর সম্ভব নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

উক্ত ঘটনাগুলোর সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা আলোচনায় অংশ নিলে আরো বেশী ভালো হয়। কারণ সামনে যাওয়ার জন্য অনেক সময় পেছনে যেতে হয়। আমাদেরকে অতীত কাজের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে।

বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১১

ফেসবুকে আলোচনা-৩

অডঙ চাকমার ২য় পর্ব জবাবের প্রেক্ষিতে

প্রিয় অডং,
 আপনার 'নিরন চাকমার জবাবে(২য় পর্ব)' পড়লাম। আপনি লিখেছেন:

'দেশের সকল আইন, সকল নীতি, সকল রাষ্ট্রীয় র্কমকান্ড যদি দেশের সংবিধানের সাথে সংগতি রেখে করতে হয়, তাহলে একটি পার্টির সকল নীতি, র্কমসূচী বা র্কাযক্রম কনে গঠনতন্ত্র অনুসারে হবে না? সংবিধানের আলোকে যদি ডিফেন্স পলিসি করতে হয়, একটি দেশের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সংসদের অনুমোদন লাগে সেখানে কেন একটি রাজনতৈকি দলের সেলফডিফেন্স-এর জন্যে গঠনতন্ত্রের নীতি-আর্দশ অনুসরণ করতে হবে না? পার্টির সবাই সাধু সজ্জন নয়। সেলফডিফেন্স-এর নামে যদি অরাজকতা সৃষ্টি হয়, খুন খারারি মারামারি হয়, সেগুলোর দায়দায়িত্ব কে নেবে? সেসব অন্যায় বা অপরাধরে জন্যে কী বিচার হবে? র্পাটি কীভাবে ভুক্তভোগীদের জন্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করব?'

বলবো অন্যকে জব্দ করতে আপনি চমকার কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন। আপনার এ বিরল গুণের তারিফ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে একটি বুদ্ধ জাতকের কথা মনে পড়ছে। একদিন ধর্ম সেনাপতি সারিপুত্র ধর্মসভায় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক বৃদ্ধ ভিক্ষু তাকে জব্দ করার জন্য একটি অন্তঃসারশুন্য, অর্থহীন প্রশ্ন করে(অর্থা সেই প্রশ্নটার কোন উত্তর হয় না)। সারিপুত্র সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ধর্মসভা থেকে উঠে নিজ শয়ন কক্ষে চলে যান। এতে ধর্ম কথা শ্রবণে ব্যাঘাত ঘটার জন্য উপস্থিত শ্রোতারা ক্ষুদ্ধ হয় এবং ওই বৃদ্ধ ভিক্ষুকে ধর ধর বলে ধাওয়া করে। বৃদ্ধটি পালানোর সময় ভিক্ষুদের ব্যবহৃত পায়খানায় পড়ে যান। এভাবে তার আত্মরক্ষা হয়। পরদিন এ বিষয়টি বুদ্ধকে জানানো হলো বুদ্ধ এ জাতকটি বলেছিলেন। এটি ঈশান চন্দ্র ঘোষ অনূদিত ছয় খণ্ডের জাতকের ২ নং খন্ডে সংকলিত হয়েছে(১৫৩ নং জাতক)। এই জাতকটিই আমার উত্তর মনে করতে পারেন।

তবে জাতকটি পড়ে যাতে আমাকে ভুল না বুঝেন তার জন্য আগে ভাগে এখানে বলতে চাই, আমি মোটেই নিজেকে সিংহতুল্য মনে করছি না। মহান সারিপুত্রের সাথেও নিজেকে তুলনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। 'কুদু আগাজর চান তারা, কুদু পুনর কেজ ফরা।' সারিপুত্র হলেন আকাশের গ্রহ নত্র -- মহাপুরুষ। আর আমি হলাম একজন সামান্য রাজনৈতিক কর্মী। তার সাথে নিজেকে তুলনা করে পাপের ভাগীদার হতে চাই না।

আপনার প্রশ্নগুলোও আমি একেবারে অন্তঃসার শূন্য বলছি না। আপনি একজন অভিজ্ঞ মানুষ, আপনি নিশ্চয়ই সে রকম প্রশ্ন করবেন না। তবে আপনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন তার জবাব জানা থাকলেও এখানে এ সময়ে উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আপনি জানেন আমরা কোন পরিস্থিতিতে কাজ করি। আর এটা জেনেই আপনি ওই প্রশ্নগুলো করেছেন। সুতরাং এ অবস্থায় শ্রদ্ধেয় সারিপুত্রের কৌশল অবলম্বন করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই।

মিটিং মিছিল মানববন্ধন প্রসঙ্গ:
এগুলো করতে রাজনৈতিক দলের লোক হতে হয় না। কেবল রাজনৈতিক দলগুলো মিটিঙ মিছিল সমাবেশ মানববন্ধন করে না। এনজিওগুলোও দেদার করছে। বরং বলা যায় বাংলাদেশে অন্যান্য সেকটরের মতো রাজনীতিটাও এনজিওকরণ হয়ে যাচ্ছে।

যাই হোক, যে বিতর্ক হলো তার থেকে আমরা কী সিদ্ধান্ত টানতে পারি? আমার মতে, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য যে যেভাবে পারে কাজ করতে হবে। গণবিক্ষোভ গণপ্রার্থনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের আন্দোলনকে আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করতে হবে। যারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের পক্ষে তাদের সবাইকে একই প্লাটফরমে আসতে হবে শত মত পার্থক্য বিতর্ক সত্বেও। এভাবে যদি ব্যাপক ঐক্য গড়ে ওঠে তাহলে সেটা ঐক্য-সমঝোতা বিরোধীদের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করবে এবং শেষে এক পর্যায়ে তারা সংঘাত বন্ধ করতে বাধ্য হবে।

যখন এই উত্তরটা লিখতে শুরু করি তখন জানতে পারি বাঘাইছড়ি ও দীঘিনালায় পাহাড়িদের ওপর হামলা হয়েছে। একজন মারা গেছে, অনেকে আহত হয়েছে। আর কতকাল আমাদের এভাবে মার খেয়ে থাকতে হবে? নিজ জন্মভূমিতে আমরা আজ পরবাসী শুকর কুকুরের মতো ধরে ধরে মারছে। যখন ইচ্ছে হয় তখন হামলা চালাচ্ছে। মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করছে। এর পরও সন্তু বাবুরা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করে ইউপিডিএফের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যেতে চান না। সন্তু বাবু ছাড়া জেএসএসে বুঝার মতো নেতা কি আর নেই? নিজেরা নিজেরা মারামারি করলে আমাদেরই ক্ষতি সেটা বুঝার মানুষ কি জেএসএস(সন্তু গ্রুপ)-এর মধ্যে নেই? চুপ করে বসে থাকার আর সময় নেই। যারা এতদিন চুপ করে আছেন তারা জেগে উঠুন। ঐক্য ছাড়া কোন বিকল্প নেই।


মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১১

ফেসবুকে আলোচনা-২

হিল্লো গাবুজ্যার মন্তব্য ও অডঙ চাকমার জবাবের প্রেক্ষিতে
প্রথমে হিল্লো গাবুজ্যাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি লিখেছেন, 'এত কিছু বলার কারন-আপনার হয়ত স্মরন থাকার কথা এর আগে আপনার ফেসবুকে শেয়ার করা কয়েকটি লেখায়ও প্রশ্ন রেখেছিলাম কিন্তু উত্তর না পাওয়ায় বিব্রত হতে হয়েছি।' আপনার প্রশ্নের উত্তর যদি না দিয়ে থাকি, তাহলে সেটা হবে বেখেয়াল বশতঃ। তবে যেই হোক, তার জন্য আমি দুঃখিত। উত্তর না পাওয়ায় আপনাকে বিব্রত হতে হয়েছিল বলে দ্বিগুণ দুঃখ প্রকাশ করছি।এরপর আমি বলতে পারি, মতলববাজী মানসিকতা বাদ দিয়ে কেউ যদি আমাদের সাথে বিতর্ক করতে আসে, বা কেউ কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তখন তার সাথে আলোচনা করা বা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সাধারণভাবে একটা চেষ্টা আমাদের দিক থেকে থাকে।

যাই হোক, এবার আসল কথায় আসা যাক।প্রসিতদার 'আড়ালে থাকার' মধ্যে কোন রহস্য নেই।তিনি পার্টি শৃঙ্খলা ও নিয়ম নীতির অধীন।তিনি ইচ্ছে করছে বলেই যা কিছু করতে পারেন না। যে ইন্টারভিউটা তিনি দিয়েছেন, যেটা নিয়ে অডং বাবু আলোচনার সূত্রপাত করেছেন, সেই ইন্টারভিউতে তিনি যা বলেছেন তা তিনি তার উচ্চ পর্যায়ের সহযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা করেই বলেছেন।প্রসিতদা সন্তু বাবুর মতো প্রায় সময় মিডিয়ার সামনে হাজির হন না এটা ঠিক।কিন্তু তার মানে এই নয় তিনি জনগণের কাতারে নেই।বরং উল্টোটাই ঠিক। প্রসিতদার কাজের স্টাইল আর সন্তু বাবুর কাজের স্টাইল এক নয়।ইউপিডিএফের কাজের স্টাইল পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব পরিস্থিতিতে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে।

'আর পাঃ চট্টগ্রামের প্রধান আঞ্চলকি রাজনতৈকি দল এবং সবচেয়ে পুরনো দল হিসেবে কতটুকু র্মযাদা দেন এবং এ বিষয়ে আপনার পার্টির দূরদর্শিতা কতটুকু?'

আপনার এই প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পেরেছি কিনা বলতে পারবো না।তবুও যেটুকু বুঝেছি তার ভিত্তিতে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন যে, প্রসিতদা তার উপরোক্ত ইন্টারভিউতে জেএসএসের এক সময়কার প্রগতিশীল ভূমিকার কথা স্বীকার করেছিলেন।ইউপিডিএফের বহু লেখায় ও প্রচারপত্রে এটা স্বীকার করা হয়েছে।কারণ যা সত্য তা স্বীকার করতে আমাদের কোন সংকোচ ও দ্বিধা নেই।১৯৬০, ৭০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে সংগ্রাম শুরু করার ক্ষেত্রে জেএসএসের বড় ধরনের, বলতে গেলে একক, অবদান রয়েছে। জেএসএসের বহু নেতা কর্মী জীবন উসর্গ করেছেন স্বজাতির মুক্তির জন্য। ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, বহু ত্যাগ তিতিক্ষা করেছেন। এ সবই সত্য। কিন্তু একই ভাবে এটাও সত্য যে, জেএসএসেরও কিছু গুরুতর ভুল রয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। সে ভুলগুলো আজ এখানে আলোচনা করছি না।তবে এটুকু বলবো আন্দোলনে জেএসএসের অবদানের পাশাপাশি এই ভুলগুলোও আলোচনা হওয়া দরকার। তা না হলে আমরা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবো এবং একই জায়গায় ঘুরপাক খেয়ে পড়ে থাকবো।মোট কথা হলো, প্রত্যেক নতুন প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের ভূমিকাকে ক্রিটিক্যালি বিচার করতে হয়, অর্থা তার দোষ গুণ নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হয় এবং বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণিত ভুলগুলো ফেলে দিয়ে যা সঠিক তা গ্রহণ করতে হয়।পুরাতন প্রজন্ম এই সমালোচনা মেনে নিতে না পারলেও তা করতে হবে সামগ্রিক স্বার্থে।বিষ ফোঁড়া হলে সেটার পুঁজ জোর করে বের করতে হয়, এখানে জোর করা হচ্ছে ভালোর জন্য।ইউপিডিএফও সে কারণে জেএসএস নেতাদের ভালো না লাগলেও তাদের ভুলগুলোর সমালোচনা করে থাকে।এটা সামগ্রিক জাতীয় স্বার্থেই।যে সমাজে সমালোচনা নেই, বিতর্ক নেই, দ্বন্দ্ব নেই, সে সমাজ বন্ধ্যা, অচল।

ইতিহাসে দেখা যায়, বহু দল বা নেতা এক সময় প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করলেও পরে তাদের সেই ভূমিকা আর থাকেনি। জেএসএসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।এম এন লারমার জেএসএস আর সন্তু লারমার জেএসএস এক নয়। ভাই হলেও এম এন লারমা আর সন্তু লারমা এক নন, একই নীতি আদর্শের মানুষ নন। এমনকি তাদের দু'জনের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও টেমপেরামেন্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন, দুই মেরুর।
আপনার প্রশ্নের উত্তর কতটুকু দিতে পেরেছি জানিনা।তবে দেয়ার চেষ্টা করেছি, এটুকু বলতে পারি।

এবার অডঙ বাবুর জবারের প্রেক্ষিতে আসি। আপনাকেও ধন্যবাদ পুনরায় আলোচনায় অংশ নেয়ার জন্য। বৃটিশরা চাকমাদের সম্পর্কে বলেছেন চাকমারা নাকি তর্কপ্রিয়। আমার লেখার মাধ্যমে এই অভিযোগের (নাকি অন্য কিছু) সত্যতা প্রমাণিত হতে পারে সেই ভয় সত্বেও আপনার ১২ ডিসেম্বরের লেখার জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি।

(১)স্বীকার করছি এবং বুঝি যে, কোন কোন সময় কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একেবারে শীর্ষ নেতার কাছ থেকে বক্তব্য আশা করা হয়।তবে সস্তা হাততালি, বাহবা পাওয়ার জন্য বক্তব্য দেয়ার অভ্যাস যেন আমাদের পেয়ে না বসে।আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি, প্রসিতদা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের ঘোষণা ইতিমধ্যে দিয়েছেন।সমাবেশ ডেকে বক্তৃতাবাজি করে দেননি বটে, তবে কয়েকজন অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলোচনায় ওই ঘোষণা দিয়েছেন।সবচেয়ে বড় কথা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য আমরা ব্যর্থ হওয়ার পরও বার বার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের দিক থেকে।এ ব্যাপারে আগে দীর্ঘ আলোচনা করেছি।নতুন করে আর বলতে চাই না।তাই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের প্রশ্নে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতি সন্দেহ পোষণ করা হবে চরমতম অন্যায়ের মধ্যে একটি।যেখানে আমাদের সহযোদ্ধারা একের পর এক খুন হচ্ছে, অপহরণ হচ্ছে, ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে অস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে আমাদের জীবনেরও কোন নিরাপত্তা নেই এবং যেখানে আমরাই আর্থিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে, মানসিকভাবে সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, সেখানে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে আমাদের চাইতে আর কে বেশী আন্তরিক হবে? এ জন্য যখন 'জ্ম্মুজাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না, মানুষের জীবন নিয়ে মস্করা করবনে না।' প্রসিতদার উদ্দেশ্যে লেখা অডঙ বাবু আপনার এই বাক্যটা পড়ি তখন কাঁদবো না হাসবো বুঝতে পারিনি। মনে কিছুটা ব্যথাও পেয়েছি। আপনার লেখাগুলো পড়লে মনে হয় আপনি ছাড়া বুঝি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে আর কেউ আন্তরিক নয়। তাই বলি কি, যদি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে আপনি এতই আন্তরিক হন, তাহলে কেবল কথা না বলে, কেবল ফেইসবুকে লেখালেখিতে সীমাবদ্ধ না থেকে মিছিল মিটিং ও সভার আয়োজন করুন, মানববন্ধন করুন, লং মার্চ ইত্যাদি করুন। জানি আমার এ কথা শুনে আপনি আপনার অপারগতা প্রকাশ করতে নানা অজুহাত খুঁজবেন। কারণ অন্যের সমালোচনা করা সহজ, বাস্তবে নিজে করা বড়ই কঠিন। এটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

(২) “কাজেই একজন সংঘাতের মূল হোতা হলে অন্যজন হবে উস্কানি দাতা কিংবা অনুঘটক।”
না, তারপরও 'সীতা কার বাপ' এর মতো কথা বললে আমার মতো অমের কী উপায় আছে? এক চোখা বিচারে নিরীহ ব্যক্তিও শাস্তি পায়, আর দোষী ব্যক্তি কেটে পড়ার সুযোগ পায়। দোহাই আপনি একচোখা বিচারক হবেন না।

আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ইউপিডিএফের রাজনৈতিক চিত্ত অত্যন্ত পরিস্কার। আমি দৃঢ়ভাবে বলবো, আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত এড়ানোর জন্য, আর যখন সংঘাত বেঁধে গেছে তখন তা বন্ধ করার জন্য। এতে আমরা 'উত্তম' হয়েছি কিনা জানি না, তবে আমরা আমাদের দিক থেকে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি এটুকু বলতে পারি।

(৩) 'অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই, পঁচা ডিম, টমটো, জুতা ইত্যাদি নিক্ষেপ করার মত এরকম গণতান্ত্রকি পদ্ধতির সাথে একমত নই, সর্মথক নই। ...
স্বীকৃত সাধারণ মত ও পদ্ধতির সাথে দ্বিমত পোষণ করার পূর্ণ অধিকার আপনার আছে। ভুল বলেননি সেটাই ভালো।

“পঁচা ডিম, টমেটো, জুতা” ইত্যাদি নিক্ষেপ করে আপনি পেতে চাচ্ছেন “সাবাশ” আর সন্তুবাবু বুঝছেন “কচু”।" তাহলে কি বোঝা যাচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে এখানে দুটো মতের সাথে দ্বন্দ্ব -- এক পক্ষ গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলে, আর অন্য পক্ষ সেই গণতন্ত্রের ভাষা বোঝে না। তার কাছে সেটা এলিয়েন ল্যাঙ্গুয়েজ, ভিনদেশী ভাষা। অডঙ বাবুর আদালতের রায়ে সাব্যস্ত: উভয়েই দোষী! ইউপিডিএফ দোষী, কেননা জেএসএস না বোঝা সত্ত্বেও সে গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলেছে। আর, জেএসএস দোষী, কারণ সে গণতন্ত্রের ভাষা বোঝে না। জয় হোক অডঙ বাবুর বিচারের!

(৪) 'আত্মরক্ষার সাধারণ ধারনা নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই, কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিলো আপনাদের আত্মরক্ষার ধারনার ধরন ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে।'
শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকার করে নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, যদিও স্বীকার করাটা আনকোয়ালিফাইড নয়।

"যেই আত্মরক্ষার কথা বলছেন, আপনাদের পার্টির গঠনতন্ত্রে কোথাও কী কিছু লেখা আছে?আপনাদের গঠনতন্ত্র মেনে আপনারা কী আপনাদের আত্মরক্ষার নীতি কৌশল ঠিক করেছেন?"

একটি পার্টির গঠনতন্ত্রে সবকিছু লেখা থাকে না। সংবিধান যেমন একটি দেশের মূল দলিল, গঠনতন্ত্রও একটি দল বা সংগঠনের মৌলিক দলিল। এই গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতেই পার্টির অন্যান্য নিয়ম কানুন ঠিক করা হয়। আর আত্মরক্ষা বিষয়টি এতই সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি ব্যাপার যে সেটা কোন পার্টির গঠনতন্ত্রে লেখার প্রয়োজন হয় না।

(৫) সবশেষে বলবো, একটি বিষয়ে সবাইকে খেয়াল থাকতে অনুরোধ করবো। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের যে ডাক ইউপিডিএফসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে সেটা সেনাবাহিনীর অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত যাতে বন্ধ না হয়, যাতে আমাদের মধ্যে সব সময় মারামারি হানাহানি লেগে থাকে তার জন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা লক্ষণীয়। যেমন কিছুদিন আগে ১০ নভেম্বর সেনাবাহিনী 'ইউপিডিএফ এর এ কোন প্রহসন?' শিরোনামে জেএসএসের নামে একটি লিফলেট বিলি করেছে। আমরা মনে করি না যে জেএসএস এটি ছাপিয়েছে। কারণ জেএসএসএর লিফলেটের ভাষা এ রকম নয়। যাই হোক, লিফলেটের মূল কথা হলো সংঘাত বন্ধের দাবিতে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা নস্যাৎ করে দেয়া। আর সেটা করতে হলে প্রথমেই দরকার ইউপিডিএফের ঐক্যের আহ্বানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়া; জনগণের মনে সংশয় সৃষ্টি করে দেয়া। কাজেই এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সেনাবাহিনী জানে, ইউপিডিএফ জেএসএস এক হলে, জুম্ম জনগণ এক হয়ে গেলে, তাদের বিদায় ঘন্টা বাজবে। তবে আজ হোক কাল হোক সেই ঘন্টা বাজাতে হবেই।




বেক্ষুনে গম থাক্কুয়্য, সুগে থাক্কুয়্য।

সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১১

ফেসবুকে আলোচনা-১

প্রিয় অডঙ, অমিত হিল ও অন্য বন্ধুরা,
"ভ্রাতৃঘাতীসংঘাত বন্ধে প্রসতি খীসার স্পষ্ট অঙ্গীকার শুনতে চাই" শিরোনামে ১১ ডিসেম্বর ফেসবুকে লেখা অডঙ চাকমার ও "শ্রদ্ধেয় স্যার প্রসতি বিকাশ খীসাকে এক খোলাচিঠি" শিরোনামে একই তারিখে লেখা অমিত হিলের লেখা আমাদের নজরে এসেছে। এছাড়া এ সম্পর্কিত অনেকের মন্তব্যও চোখে পড়েছে। লেখার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

যদিও লেখাগুলো প্রসিতদাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে, তবুও তার পক্ষ হয়ে আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছি। কারণ প্রসিতদা ফেইসবুক ব্যবহার করেন না। তবে তিনি তার ইন্টারভিউ সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং সরাসরি আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

অমিত হিল ও অডঙ ফেসবুকে নিয়মিত লেখেন, সে কারণে আপনারা পরিচিত মুখ, সরি, পরিচিত নাম বা আইডি। ইতিপূর্বেও আপনাদের সাথে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বিষয়ে আমার আলোচনা হয়েছে। সুতরাং আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের পার্টির অবস্থান আপনাদের জানা আছে। তাই নতুন করে সেটা ব্যাখ্যা করা অনেকটা চর্বিত চরণের মতো হবে। তারপরও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আমি আমাদের সাধারণ পার্টি লাইন অনুসরণ করে আপনাদের মন্তব্য, প্রশ্ন ও বক্তব্যের জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি। আমার বক্তব্য দীর্ঘ হবে, তাই ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ করছি।

(১)অডঙ বাবু ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধের জন্যে প্রসিতদার মুখ থেকে "প্যাঁচালো" (তার ভাষায়) কথা নয়, স্পষ্ট "অঙ্গীকার" শুনতে চেয়েছেন। খুব ভালো কথা। তবে প্যাঁচালো কথার চেয়ে অঙ্গীকার কি খুব বেশী উত্তম? যখন অনেক রাজনৈতিক ও নেতা মুহূর্তে অঙ্গীকার করে তা পর মুহূর্তেই ভেঙে ফেলেন? ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য ইউপিডিএফ অঙ্গীকারের চাইতেও অনেক বেশী করেছে ও এখনো করছে। সেটা হলো বাস্তব কাজ। যদি চোখ, কান খোলা রাখেন তাহলে এ বাস্তব কাজ সম্পর্কে জানতে পারবেন। সবকিছু খোলাসা করে বলার স্থান এটা নয়। দুঃখিত।

(২)"কুসুম প্রিয় চাকমা ও প্রদীপ লাল চাকমাদরে জেএসএস জঘন্যভাবে খুন করছিলো বলে ইউপডিএফকেও সেভাবে জঘন্য খুনরে নশোয় মেতে উঠতে হবে সেটা মেনে নিতে পারি না। খুনের বদলে ‍খুন এটা সুস্থ রাজনীতি হতে পারে না।"

আপনার সাথে এ ব্যাপারে আগেও বিতর্ক হয়েছে। নতুন করে এ প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু বলার নেই। তবুও একটা গল্প বলি। আমাদের এক ইউপিডিএফ নেতার সাথে এক বিদেশী শুভাকাঙ্খীর কথা হচ্ছিল। তখন ইউপিডিএফ-জেএসএসের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে (অবশ্য লড়াই বললে ভুল হবে, ইউপিডিএফ একের পর এক মার খাচ্ছিল, জেএসএসের আক্রমণে মারা যাচ্ছিল আর ইউপিডিএফ প্রতিরার চেষ্টা করছিল।) আলোচনার বিষয়বস্তুও ছিল ওই ভ্রাতৃঘাতি হানাহানি।ওই বিদেশী ইউপিডিএফ নেতাকে বলছিলেন 'আপনাদের উচিত পালিয়ে গিয়ে হলেও মারামারিটা এড়ানো।' ইউপিডিএফ নেতা সংঘাত শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপট, বাস্তব পরিস্থিতি, সংঘাত বন্ধের জন্য বারংবার চেষ্টা ইত্যাদি সম্পর্কে বলার পরও উক্ত বিদেশীর মনে তখনো সংশয় রয়ে গেছে দেখে তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন: ধরুন, আপনি একজনকে তার ভুলের জন্য সমালোচনা করলেন। কিন্তু তিনি আপনার সমালোচনার জবাব না দিয়ে আপনার গায়ে হাত তুললেন। আপনি মারামারি এড়ানোর জন্য দৌঁড় দিয়ে পালাতে থাকলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তিও আপনার পিছু পিছু দৌঁড় দিয়ে আপনাকে ধরে মারতে থাকলো। তখন আপনি কী করবেন?

এর জবাবে উক্ত বিদেশী শুভাকাঙ্খী স্পষ্টভাবে বললেন, I’ll fight back. অর্থাৎ আমি প্রতিরোধ করবো। তখন ইউপিডিএফ নেতা বললেন, ‘That’s what we’re doing." আসলে কোন ঘটনার প্রেক্ষিত বা পূর্ব অবস্থা জানা না থাকলে বিষয়গুলো ঠিকভাবে বোঝা কঠিন। অডং এর ক্ষেত্রেও এটাই হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

বর্তমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের প্রেক্ষিতটাও আমাদের ভালোভাবে জানা থাকা দরকার। প্রেক্ষিতটা আমি বহু আগের ঘটনা উল্লেখ করে শুরু করতে পারি। তবে সেটা দীর্ঘ হবে। তাই মোটা দাগে তুলে ধরছি: চুক্তি সই হয়েছে। ইউপিডিএফ সমালোচনা বা প্রত্যাখ্যান যাই বলেন সেটা করেছে। সারেন্ডারের সময় প্রতিবাদ করেছে। এগুলো সব গণতান্ত্রিক পন্থায়। কিন্তু জেএসএস তখন কী করলো? চুক্তির লিখিত ও মৌখিক সমালোচনার জবাব কি তারা লেখনির মাধ্যমে দিয়েছে? না। তারা তার জবাব দিয়েছে প্রদীপ লাল ও কুসুম প্রিয়কে হত্যা করে। কিন্তু হত্যা করেই শেষ নয়। প্রদীপ লাল কুসুম প্রিয়কে খুন করা হলো, কোন বিচার নেই। হত্যাকারীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে ও একের পর এক হুমকী দিয়ে যাচ্ছে। তারপর কয়েকদিন পর খুন করা হলো খাগড়াছড়িতে হরেন্দ্র ও হুরুক্যাকে। তারও কয়েকদিন পর দীঘিনালায় মৃণাল ও আনন্দময়কে এবং মারিশ্যায় অন্য এক ইউপিডিএফ সদস্যকে মেরে ফেলা হলো। তাছাড়া ধরে ধরে আরো অনেককে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। সিএইচটি কমিশনের রিপোর্টে এ সব বিস্তারিত লেখা আছে। তখন সে এক ভয়াবহ অবস্থা। প্রতিবাদে মিছিল পর্যন্ত করা যায় না। চট্টগ্রামে পর্যন্ত পুলিশ দাঁড়াতে দেয়নি। ইউপিডিএফের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে লালদীঘি ময়দান থেকে ৪৫জনকে গ্রেফতার করে। এত খুন, এত অন্যায়, অথচ তার কোন প্রতিকার নেই। পালিয়ে গিয়েও বাঁচার উপায় নেই। ধরে ধরে জবাই করা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে। সে এক কঠিন পরিস্থিতি, যার মুখোমুখি আমরা ইতিপূর্বে কোনদিন হইনি বা স্বপ্নেও ভাবিনি। অডঙকে প্রশ্ন, এই অবস্থায় হলে আপনি কী করতেন? তবে আপনি মুখে যাই বলুন না কেন, এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে আপনার নিজেরই অজান্তে আপনি কখন যে আত্মরক্ষায় নেমে পড়তেন তা নিজেই ঠাহর করতে পারতেন না। কারণ এটাই প্রকৃতির ধর্ম। প্রত্যেক প্রাণী সেটাই করে থাকে। চাকমা কথায় আছে, 'আগুনত পল্লে মরা সুগুনীবোয়্য তিন পাক খায়।' সে জন্য আত্মরক্ষার অধিকার আইনে পর্যন্ত স্বীকৃত। এ কথাগুলো মনে হয় আগেও বলেছি। কিন্তু যে অধিকার প্রকৃতি এবং আইন পর্যন্ত একজন মানুষকে দেয় সেই অধিকার অডং চাকমা আমাদের দিতে চান না। তার অভিধানে মনে হয় আত্মরা নামক শব্দটিই নেই। আর তাই তার বিচারে ডাকাত ও ডাকাতি প্রতিরোধকারী ব্যক্তি সবাই সমানভাবে দণ্ডনীয়। যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করতে চায় ও যে চায় না তারা সবাই তার চোখে সমানভাবে দোষী। কারণ তিনি 'নিরপেক্ষ’! আর তিনি এমন নিরপেক্ষ তার চোখে নিতান্ত সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগও অপরাধ হয়ে যায়ভ (যেমন তিনি প্রশ্ন করেছেন চুক্তি না মানার অর্থ কী প্রত্যাগত নিরীহ জেএসএসস স্যদরেকে পিনোন দেখিয়ে অপদস্থ করা? ইত্যাদি।) কিন্তু তার জানা থাকা উচিত পঁচা ডিম, টমেটো, জুতা ইত্যাদি নিক্ষেপ করে প্রতিবাদ জানানো বিশ্বে সর্বত্র স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। অথচ অডঙ চাকমার কাছে সেটা স্বীকৃতি পায় না।

(৩)অডঙ বাবু, উপদেশ দেয়া, সমালোচনা করা, অন্যের দোষ ধরিয়ে দেয়া, এবং এমনকি নিজের পরিচয় গোপন করে রূঢ় ভাষায় কঠোর কথা বলা অনেক সহজ। কিন্তু বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, উপর্যুপরি আক্রমণের বিরুদ্ধে সংযত থেকে মাথা ঠাণ্ডা করে সংগ্রাম করা অত্যন্ত কঠিন। যখন একটি পক্ষ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত আছে বলেও স্বীকার করতে চায় না, তখন সেই সংঘাত থেকে উত্তরণ অন্য পক্ষের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্বেও সহজ হয় না। এটা কি এতই কঠিন বিষয় যে আপনারা অনেকে বুঝতে অপারগ? অনেক সময় দেখা যায় - দোষ করেছে এক ভাই, কিন্তু মায়ের বকুনী খেতে হচ্ছে অন্য ভাইকেও? ইউপিডিএফের অবস্থাটা হয়েছে অনেকটা ওই অন্য ভাইটির মতো যে কোন দোষ করেনি? সেজন্য অমিত হিলের কাছ থেকেও শুনতে হচ্ছে, "বারবার সবদোষের আঙ্গুলি শুধু স্যার সন্তুর দিকে নিক্ষেপ করেন কেনো? আচ্ছা, যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, সারেন্ডারের সময় পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার দেখানো, পিনোন দেখানো ইউপিডিএফের অপরাধ হয়েছে, কিন্তু রূপায়ন দেওয়ান ও সুধাসিন্ধু খীসারা কী করেছেন? কেন তাদের কর্মী ও সমর্থকদেরও খুন করা হচ্ছে? কেন জেএসএসের পরীক্ষিত নেতা ও সন্তু বাবুর এক সময়কার একান্ত অনুগত চন্দ্র শেখর চাকমাকে পর্যন্ত গুলি করা হলো? ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের পক্ষে কথা বলায় ও জেএসএসের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলায় তো তাদের মহা কাল হয়েছে। যিনি সামান্যতম সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, যিনি গণতান্ত্রিকভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল মত পার্থক্যের মীমাংসা করতে চান, আপনারা যাই বলুন না কেন তাকে মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন। হয়তো অডঙ বা অন্য কারো কাছে এ ব্যাপারে ভালো 'তালিক' থাকতে পারে। যদি থাকে, তাহলে দয়া করে আমাদের জানালে বড়ই উপকৃত হই। তবে এটাও বলি যদি আগেভাগে আমরা জানতাম সন্তু বাবু সমালোচনা মোটেই সহ্য করতে পারেন না, গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে মোটেই মানেন না, এবং যদি কণা মাত্রও আঁচ করতে পারতাম যে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে তিনি এমন নিষ্ঠুরভাবে পশুশক্তি দিয়ে দমন করতে চাইবেন এবং শেষ পর্যন্ত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের জন্ম দেবেন, তাহলে আমরা অবশ্যই চুপ করে থাকতাম অথবা অন্য কৌশল ভেবে দেখতাম। তবে আগেও বলেছি, এখনও বলতে চাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য হিটলারকেই দায়ী করা হয়; মিত্র শক্তি ও অক্ষ শক্তি উভয়কে সমানভাবে দায়ী করা হয় না। বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার অনেক চেষ্টা সত্বেও, এমনকি তোষামোদী নীতি প্রয়োগ করার পরও হিটলারকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করা থেকে নিবৃত করা যায়নি। সন্তু বাবুও এমন টেমপেরামেন্টের মানুষ আমার সন্দেহ হয় চুপ করে থাকলেও ইউপিডিএফ নেতারা এবং বিশেষত প্রসিত খীসাসহ চার পাঁচ জন বাঁচতে পারতেন কীনা এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে এড়ানো যেত কীনা। কারণ আপনারা হয়তো জানেন না, চুক্তির আগেই সন্তু বাবু প্রসিতদাসহ আরো কয়েকজনকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি সে সময় বর্তমান ইউপিডিএফ নেতা সচিব চাকমা ও শান্তিদেব চাকমাকে শান্তিবাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে গিয়ে মানসিক নির্যাতন চালিয়েছিল এবং প্রসিত খীসার পক্ষে কাজ করবে না এই মর্মে লিখিত অঙ্গীকার নিয়েছিল। এছাড়া পানছড়িতে রিংকু (সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য) ও কুসুম প্রিয়কে (যাকে পরে খুন করা হয়) লতিবান থেকে ধরে নেয়া হয়েছিল। অপরাধ -- প্রসিতদার পক্ষে কথা বলা ও তার সংগঠন করা। তাদের দু'জনকে পরে ধূধূকছড়ায় নিয়ে যাওয়ার সময় রাতে পূজগাঙে গ্রামবাসীরা উদ্ধার করেছিল। এ ধরনের বহু ঘটনা আছে যা চুক্তির আগে ঘটেছে। তখনতো পিনোনও দেখানো হয়নি, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানারও তোলা হয়নি।

সত্যি বলতে কী, প্রসিতদা ও রবিদা চুক্তি হওয়ার আগে রাজনীতি থেকে অফ যেতে চেয়েছিলেন। প্রসিতদা তো স্পষ্টভাবে সন্তু লারমাকে বলেছেন, 'ফুটবল মাঠে খেলার সময় কোন খেলোয়াড় আহত হলে তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। আমিও না হয় সে ভাবে রাজনীতি ও আন্দোলন থেকে ইস্তফা দিয়ে জেএসএসকে সাপোর্ট দিয়ে গেলাম। দর্শক গ্যালারীতে থেকেও নিজের টিমের খেলোয়াড়দের হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতে হয়। মূল লক্ষ্য হলো নিজের দলটা যাতে জেতে। আমিও না হয় দর্শক গ্যালারির একজনের মতো হয়ে গেলাম' এটা ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকের কথা। প্রসিতদা এ ব্যাপারে একেবারে লিখিতভাবে অঙ্গীকার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন সন্তু বাবু সেটাকে চ্যালেঞ্জ বলেছিলেন। সন্তু বাবুর এক কথা, প্রসিত খীসাকে জেএসএস পার্টিই করতে হবে। প্রসিতদাও করতে রাজী ছিলেন, তবে আগে গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচী পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু সন্তু বাবু জেএসএসের গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচী পড়তে দিতে রাজী হননি। এই হলো অবস্থা। প্রসিতদা অফ যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করার পর সন্তু লারমা যদি তাতে রাজী হতেন তাহলে আজ এ পরিস্থিতি হতো না। এটা প্রসিতদার কোন অভিমানের কথা ছিল না বা কৌশল ছিল না। তিনি মনে প্রাণেই চেয়েছিলেন জেএসএস যেহেতু এত বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, সেহেতু সে-ই আন্দোলনের মূল খুঁটি হিসেবে থাকুক। কোন ধরনের বিভেদ সৃষ্টি হলে তা আন্দোলনে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। কেউ যদি এতেও প্রসিতদার মধ্যে খুঁত দেখতে পায়, সেটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি। কিন্তু আমি বলবো, সন্তু লারমা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলার বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে প্রসিতদাকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার বা তার স্বপক্ষে নেয়ার যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাতে তার (সন্তু লারমা) রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তার মধ্যে গণতান্ত্রিক মনোভাবের অনুপস্থিতিই হলো সকল সমস্যার জনক। একটি পার্টিতে বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন মত থাকা খুবই স্বাভাবিক, না থাকাটাই অস্বাভাবিক। যখনই পার্টির মধ্যে এই মত পার্থক্যগুলো গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান করার সংস্কৃতির চর্চা না হয়, তখনই সমস্যা তৈরি হয়, এবং তখনই সেই সমস্যাগুলো অগণতান্ত্রিক পন্থায় সমাধানের চেষ্টা করা হয়। লাম্বা-বাদি গৃহযুদ্ধ থেকেই আমরা এই শিক্ষাই লাভ করে আসছি।

(৪)"কে আগে হত্যা শুরু করছে, আর কে পরে শুরু করছে সটো কোন প্রশ্ন নয়।"

কেন নয়? তবে বিষয়টার উপস্থাপনা আপনার সঠিক হয়নি। বিষয়টা এভাবে উপস্থাপন করা উচিত: কে আগে হত্যা শুরু করেছে, আর কে সে হত্যা থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে সেটা একটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্ন। কারণ আত্মরক্ষার অধিকার প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। আমি যতটুকু জানি বাংলাদেশ পেনাল কোডেও এ অধিকার দেয়া হয়েছে। Nothing is an offence if it is committed in the exercise of the right to self defense. এমনকি আন্তর্জাতিক আইনেও রাইট টু সেল্ফ ডিফেন্স বা আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত। "Self-defence is an inalienable right of any nation. Right of self-defence, both individually and collectively is widely recognised in international law. Article 51 of the UN Charter affirms, "Nothing in the present Charter shall impair the inherent the right of individual or collective self-defence if an armed attack occurs against a Member of the United Nations, until the Security Council has taken measures necessary to maintain international peace and security"
BSF lodges 'war crime' FIR against BDR Is right of legitimate self-defence a 'war crime'?http://www.banglarights.net/HTML/incidence-6.htm

কে আক্রমণকারী আর কে আত্মরাকারী সেটা সকল দন্দ্ব সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু অডঙ চাকমা সে কথা স্বীকার করতে মোটেই প্রস্তুত নন। আত্মরক্ষা সম্পর্কে ইতিপূর্বেও তার সাথে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে। এক্ষেত্রে তার সমস্যা হলো, 'বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার।'

সেল্ফ ডিফেন্স সম্পর্কে আরো পড়ুন: http://en.wikipedia.org/wiki/Right_of_self-defense

(৫) অডঙ এর কথা, "জ্ম্মুজাতরি ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না, মানুষের জীবন নিয়ে মস্করা করবনে না।"

আপনার মনের ক্ষোভ, দুঃখ ও রক্তপাত বন্ধের আকুতি বুঝতে পারি। ক্ষোভের যন্ত্রণায় এ ধরনের কথা কারো মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়া একান্ত স্বাভাবিক। আপনাকে মোটেই দোষ দিই না। ইউপিডিএফ নেতাদের এসব সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে হরি কিশোর চাকমার সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে লেখা গল্পটা মনে পড়ছে।

(৬) "বারবার সবদোষের আঙ্গুলি শুধু স্যার সন্তুর দিকে নিক্ষেপ করেন কেনো? অমিত হিলের এই প্রশ্নের উত্তরে উপরে বলেছি। আরো কিছু বলার আছে। আপনার সন্তু স্যার যে দোষী তা তো তিনি তার নিজের বক্তব্যের মাধ্যমেই স্পষ্ট করেছেন। ১০ নভেম্বর এম এন লারমার স্মরণ সভায় কী বলেছেন ভুলে গেছেন? 'সন্তু স্যারের' দিকে দোষের অঙ্গুলী শুধু কি আমরাই তাক করছি? শ্রদ্ধেয় বনভান্তে এমনি এমনি বলেননি যে, 'হিটলার মারা যাওয়ার পরই কেবল ইউরোপবাসী শান্তি ফিরে পেয়েছিল; পার্বত্যবাসীও সন্তু লারমা মারা গেলেই তবে শান্তি পাবে।'

(৭) ইউপিডিএফ সংঘাত বন্ধে আন্তরিক কীনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে বলবো এটা অত্যন্ত অমূলক। কিছু দিন আগে একটা কৌতুক পড়েছিলাম। কৌতুকটা হলো এই: এক চোখ ফুলিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল ছেলে। মা দেখে আঁতকে উঠলেন: এ কী! কী হয়েছে!
ছেলে: জামানের সঙ্গে মারামারি করেছি।
মা: ছি, মারামারি করতে নেই। কাল স্কুলে যাওয়ার সময় মিষ্টি নিয়ে যাবে আর জামানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে।
পরদিন ছেলে স্কুলে মিষ্টি নিয়ে গেল। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরল অন্য চোখটা ফুলিয়ে। মা বললেন, আজ আবার কী হয়েছে?
ছেলে: জামান আরো মিষ্টি চেয়েছে।

ইউপিডিএফেরও যেন ওই ছেলেটার দশা হয়েছে। মা ও ছেলের এত আন্তরিকতা সত্বেও জামানরা যদি আরো মিষ্টির লোভে এমন কান্ড করে তাহলে নিষ্কৃতির কী উপায়? ছেলেটা দ্বিতীয়বার জামানের কাছে মিষ্টি নিয়ে গেছে কীনা সেটা আমরা জানিনা, কিন্তু ইউপিডিএফ একটা চোখে আঘাত পাওয়ার পরও আবার মিষ্টি নিয়ে(ঐক্যের আহ্বান) হাজির হয়েছে জেএসএসের(সন্তু গ্রুপ) কাছে। দেখা যাক, কী হয়। তবে আপনারা যেভাবে ইউপিডিএফের আন্তরিকতায় অহেতুক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাতে কী যারা ভাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ হোক চায় না তাদেরকে লাভবান করবে না? কৌশলগত দিক থেকেও আপনাদের ওই সন্দেহ প্রকাশ ইমেশিওর হয়েছে।

(৮) অমিত হিল: "তবুও আক্ষপে থেকে যাচ্ছ, আমার ব্যক্তগিতভাবে রাজনতৈকি ময়দানে বজ্রকন্ঠ বাজানোর সুযোগ হয়ে উঠনি। এরজন্য আপনারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। ছোটকাল থেকে রাজনৈতিক চেতনায় বেড়ে উঠেছি, ভেবেছিলাম একদনি স্বজাতির মুক্তিকল্পে নিজের জীবনকে উৎর্সগ করবো।"

আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, পড়ে হতবাক হলাম। তবে তার মানে এই নয় যে দায় অস্বীকার করছি। কারণ এটা ঠিক ভাতৃঘাতি সংঘাতের মতো পরিস্থিতি জান্তে অজান্তে অনেক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সমাজে অনেক খারাপ বাজে উপসর্গের জন্ম দেয়। তবে এটাও ঠিক দারিদ্র্য, কঠিন পরিস্থিতি, রূঢ় বাস্তবতা কাউকে কাউকে শেষ করে দিলেও, কাউকে কাউকে মহান করে তোলে। নজরুলের ভাষায়, হে দারিদ্র্য তুমি করেছো মোরে মহান। তবে সময় হারিয়ে যায়নি। আপনি এখনো 'স্বজাতির মুক্তিকল্পে নিজের জীবন উৎসর্গ' করতে পারেন। যারা প্রকৃত সংগ্রামী বিপ্লবী, যারা স্বজাতির মুক্তির চিন্তায় বিভোর, কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি তাদের দমাতে পারে না। এটাই বিশ্ব ইতিহাসের নিয়ম। কবে কখন অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হবে, তারপর নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন! অপো করতে করতেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে। অনুকূল পরিস্থিতিতে সবাই বিপ্লবী সাজতে পারে, কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্রোতের বিপরীতে অমিত তেজে এগিয়ে যেতে সবাই পারে না। আর সংগ্রামের পথ ফুল বিছানো নয় - এটাও নিশ্চয় আপনার জানা আছে। বুদ্ধ বলেছেন, আজ শীত, আজ গরম এই অজুহাতে ভালো কাজ ফেলে রাখা ঠিক নয়। সুতরাং আপনার কাছে পরামর্শ আপনিও অজুহাত না দেখিয়ে 'স্বজাতির মুক্তিকল্পে নিজের জীবন উৎসর্গ' করতে আজই নেমে পড়ুন।

(৯) অমিত হিল প্রসিতদাকে 'স্যার' সম্বোধন করেছেন। জেএসএসে সন্তু লারমাসহ অন্যান্য নেতাদের অবশ্যই স্যার বলে ডাকতে হয়। তবে ইউপিডিএফে নেতাদের স্যার বলে সম্বোধনের রেওয়াজ নেই। এটা আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক লেগাসি ও আমলাতান্ত্রিকতার মতো দেখায়। এমনকি ইউপিডিএফে নেতাদের নামের আগে বিশেষণও প্রয়োগ করা হয় না। এগুলো বাহুল্য ও অর্থহীন এবং ক্ষেত্র বিশেষে খারাপ। ইউপিডিএফে নেতাদের সাধারণত দা সম্বোধন করা হয়।

(১০) যারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে না বলেছেন তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। আপনারা দৃঢ়ভাবে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বিপক্ষে অবস্থান নিন, শুধু মুখে না বলে বাস্তবে সংঘাত বন্ধের জন্য নেমে পড়ুন, বাস্তব কর্মসূচীতে অংশ নিন, তাহলে একদিন এই সংঘাত বন্ধ হবেই। ইউপিডিএফ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য ১১ নভেম্বরের গণ বিক্ষোভ ও ১৮ নভেম্বরের গণপ্রার্থনা অনেক কাজ দিয়েছে। মুখের কথার চাইতে এ ধরনের কর্মসূচী অনেক ফলপ্রসূ।

দীর্ঘ জবাব পড়ার জন্য ধন্যবাদ।