মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘স্বায়ত্তশাসন’ দাবির যৌক্তিকতা

নিরন চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি এক সময় ছিল স্বাধীন রাজ্য। তৎসময়ে এ অঞ্চলের মানুষ তাদের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে জীবন-যাপন করেছে। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন পার্বত্য অঞ্চলটিকে সম্পূর্ণ দখলে নিতে হয় তখন থেকেই তারা এ অঞ্চলের স্বাধীন মর্যাদাকে আস্তে আস্তে কেড়ে নিতে শুরু করে। তারা নিজেদের প্রশাসন ব্যবস্থা এ অঞ্চলের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। যদিও তারা এ অঞ্চলের মানুষদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং ১৯০০ সালের রেগুলেশনের মাধ্যমে কিছু সুরক্ষার পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। তবে তারা যে অবিচারটি গেছেন সেটি হচ্ছে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র গঠন করে দেয়ার সময় সম্পূর্ণ পাহাড়ি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া। তাদের এই পদক্ষেপই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পরবর্তীকালের সকল দুর্দশার মূল কারণ।

ছবিটি পিসিপি’র ৩ যুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত
একটি ফেস্টুন।
পাকিস্তানি শাসকরা এ অঞ্চল দখল নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের প্রণীত পাহাড়িদের সুরক্ষার আইনের ধারাগুলো একে একে রদ করে দেন। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম এক 
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম তার স্বকীয় সত্তা ফিরে পায়নি। উপরন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠি তথা সরকার এ অঞ্চলের জাতিগুলোর স্বতন্ত্র পরিচয় একেবারেই নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেয়। পাহাড়ে দ্রুত সামরিক বাহিনী মোতায়েন, সমতল থেকে বাঙালি এনে পুনর্বাসনসহ নানা দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের ওপর নিপীড়ন শুরু করা হয়। ডজনের অধিক গণহত্যা, অসংখ্য হত্যাকাণ্ড, সাম্প্রদায়িক হামলা, অন্যায় দমন-পীড়ন চালিয়ে পাহাড়িদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের ওপর বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠির এই নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন এখনো চলমান রয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশ্বের সামরিকায়িত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।

‘স্বায়ত্তশাসন’ দাবি উত্থাপন

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি দীর্ঘদিনের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ’৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ পাহাড়ি নেতারা প্রথম স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেছিলেন, যা তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান নাখোশ করে দিয়েছিলেন।

এরপর ১৯৯২ সালের ২০ মে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ৩য় প্রতিবার্ষিকীর সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করা হয়। তখন এই দাবি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। জনসংহতি সমিতি ১৯৮৫ সালে সরকারের সাথে তাদের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেছিল। পরে তা সংশোধন করে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায় তারা।

এর পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ১০ মার্চ ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পাহাড়ি গণ পরিষদ (পিজিপি), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) পার্বত্য চট্টগ্রামে “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন” প্রদানের দাবি উত্থাপন করে। তিন সংগঠন যে সময় এ দাবি উত্থাপন করে তখন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার সমঝোতা বৈঠক চলছিল, যে বৈঠকের মাধ্যমে ওই বছর ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

এরপর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও উক্ত তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আবারো পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার প্রদর্শন করে এ দাবিকে জোরালোভাবে তুলে ধরেন।

আর ইউপিডিএফ গঠনলগ্ন থেকে এই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে।

এ স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে নিয়ে এতদিন তেমন আলাপ-আলোচনা না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত ১০ মে ২০২৫ ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক মাইকেল চাকমা অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে ব্রিফিংকালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার বিষয়ে সরকারের নিকট প্রস্তাব দেয়ার কথা জানালে এই স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় চলে আসে। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সেটলার বাঙালিদের কতিপয় ভূঁইফোড় সংগঠন, জেএসএস (সন্তু) ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একটি অংশ এ নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া জানায়। সেটলার বাঙালিদের ভূঁইফোড় সংগঠনগুলো বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন কেন প্রয়োজন?

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে ‘স্বায়ত্তশাসনের’ স্বীকৃতি দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো দেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিসত্তাগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসনসহ চার দফা দাবি পেশ করতে যাওয়া পাহাড়ি প্রতিনিধিদলকে পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে পাহাড়িদের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বলেও কথিত রয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক ক্যুতে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে মুজিবের অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন শুরু করেন। তিনি ১৯৭৯-৮০ সালে গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে সমতল থেকে চার লক্ষাধিক বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে এসে পাহাড়িদের জায়গা-জমির ওপর পুনর্বাসন করান। গণহত্যাসহ ভয়াবহ সহিংসতার মাধ্যমে পাহাড়িদের নিজ জমিজমা থেকে উৎখাত করে সেখানে বাঙালিদের বসতি দেয়া হয়। এতে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর জায়গা-জমি বেদখল হয়ে যায়। পরিবর্তন হয় জনমিতির। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই পুনর্বাসিত বাঙালিদের সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দিন দিন পাহাড়িরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে তাদের অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পাহাড়িদের অস্তিত্ব আরো বেশি সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

জিয়ার মৃত্যুর পর স্বৈরাচারী এরশাদের ৯ বছরের শাসনকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংক্ষিপ্ত সময়কাল বাদে বিএনপি, আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসন করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে দমন নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। তত্ত্বাবধায়কসহ সব সরকার একই নীতি বাস্তবায়ন করেছে, পাহাড়িদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু কথিত উন্নয়নের নামে ভূমি জবরদখল, পাহাড়ি উচ্ছেদ ও পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা বৃদ্ধি পায়।

চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের টানা দীর্ঘ দেড় দশকের অধিক শাসনকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। ‘৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের নামে ২০১১ সালে সংবিধানে পুনরায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তাসমূহকে সাংবিধানিকভাবে বাঙালি বানানো হয়। ২০১৫ সালে দমনমূলক ১১ দফা নির্দেশনা জারি করে দমন-পীড়ন বৃদ্ধি করা হয়।

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় নোবেলজয়ী ড. ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির কিছুটা হলেও পরিবর্তনের আশা করেছিলেন পাহাড়িরা। কিন্তু তা হয়নি। আগের সরকারগুলোর মতোই এই অন্তর্বর্তী সরকারও সেনাশাসন বহাল রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে একই দমননীতি বহাল রেখেছে। ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই ২০২৪ সালের ১৯-২০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর ও রাঙামাটিতে পাহাড়িরা সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেনাবাহিনী গুলি করে ও সেটলাররা হামলা চালিয়ে ৪ জন পাহাড়িকে হত্যা করে।

এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়িদের জাতিগত স্বাতন্ত্র্যতা ও অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের মতো একটি বিশেষ ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। কারণ পাহাড়ি জনগণের আলাদা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন করা এবং তাদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর তা একমাত্র স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে।

বস্তুত কোন কিছুর রক্ষা ও সংরক্ষণের কথা অথবা দাবি তখনই আসে যখন তার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ ভিন্ন ভাষা ভাষী পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অস্তিস্ত ও ভূমির ওপর হুমকি আসার কারণেই অতীতেও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠেছে এবং এখনো উঠছে। জাতীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে তার স্বকীয় সংস্কৃতি বেঁচে থাকতে পারে না। রাষ্ট্র পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্ব ও তাদের ভূমি সুরক্ষা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও ন্যায্য অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এ দাবি নিশ্চয় উঠতো না।

পাহাড়ি জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও পরিবেশের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই মাটি ও পরিবেশই এখানকার মানুষের নিজস্ব জীবনধারা, আচার, প্রথা, রীতি, অভ্যাস, মূল্যবোধ ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। তাই স্বকীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ, লালন-পালন ও বিকাশ সাধনের জন্য প্রয়োজন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ওপর পাহাড়ি জনগণের নিজস্ব অধিকার। ১৯০০ সালের “Chittagong Hill Tracts Regulation”-এ পাহাড়ি জনগণের এই অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসনামল থেকেই এই অধিকার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করে দেয়া হয়। তদুপরি এর পাশাপাশি ১৯৬০ সাল থেকেই পাহাড়ি জনগণকে তথাকথিত শিল্পায়নের নামে, বনায়ন কিংবা উন্নয়নের নামে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হতে থাকে। ফলে পাহাড়ি জনগণ ভূমির ওপর তাদের অধিকার হারায়। স্বাধীনতার পর সরকারি উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি পুনর্বাসনের ফলে এই ভূমি বেদখলের মাত্রা আরো অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায় স্বায়ত্তশাসনই পাহাড়িদের অস্তিত্ব রক্ষায় একমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবেই কাজ করতে পারে।

কারা স্বায়ত্তশাসনের বিরোধীতা করছে? তাদের মতলবই বা কী?

ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিন পার্বত্য জেলাকে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার জন্য সরকারের নিকট প্রস্তাব দেয়ার কথা জানালে এ নিয়ে সেটলার বাঙালিদের ভূঁইফোড় সংগঠনগুলো নানা প্রতিক্রিয়া জানায়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একটি কায়েমী স্বার্থবাদী অংশ তাদের ইন্ধন যোগায়। এদের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপের নেতা-কর্মীরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নানা প্রতিক্রয়া জানিয়েছে, যদিও তাদের প্রথম উত্থাপিত ৫ দফার মধ্যেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল।

সেটলার বাঙালিরা মাইকেল চাকমার স্বায়ত্তশাসন বা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার প্রস্তাবকে বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা ও দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছে এবং পাহাড়িদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অস্ত্র হাতে নেয়ারও হুমকি দিয়েছে তারা। আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কায়েমী স্বার্থবাদী অংশটি একদিকে সেটলারদের ইন্ধন যোগায়, অপরদিকে তারা নিজেরাও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সার্বভৌমত্বের হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। যার কারণে তারা পাহাড়ে সামরিক শাসন জারি রাখতে চায় এবং পাহাড়িদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে চায়।

অপরদিকে, জেএসএস এক সময় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থপন এবং এ দাবি নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম করলেও পরে তারা সেই দাবি থেকে সরে গিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে একটি অসম ও আপোষ চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু এখন তারাও স্বায়ত্তশাসনের বিরোধীতা করছে। স্বায়ত্তশাসনের কথা বললে তারা মনে করে সেটা পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা। ফলে তারা স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেই শাসকগোষ্ঠি ও সেটলারদের সাথে একই সুরে কথা বলে থাকে।

মূলত স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের চিরতরের জন্য অধিকারহীন করে রাখা। এই মতলবেই তারা নানা ষড়ন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

‘স্বায়ত্তশাসন’ কী বিচ্ছিন্নতাবাদ কিংবা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি?

পাহাড়িদের নিজস্ব অধিকার ভোগ করার জন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক কিছু ক্ষমতা। এর নামই স্বায়ত্তশাসন। দেশের ভেতরে সংখ্যালঘু বিভিন্ন জাতিসত্তার জাতীয় অস্তিত্ব, ভূমি অধিকার, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার জন্যই এই স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘুরা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে থাকে। এখানে বিচ্ছিন্নতার কোন কিছুই নেই। এটি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখন্ডতার প্রতিও কোন হুমকি নয়। কারণ পাহাড়িরাতো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাচ্ছে না, তারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন বা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ‘বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে। কাজেই, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা দেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বলে সেটলার বাঙালি ও স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের এই অপপ্রচারণা পাহাড়ি জনগণকে বিচ্ছিন্ন ও অধিকারহীন করে করে রাখার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বায়ত্তশাসনের দাবি কখনো বিচ্ছিন্নতা বা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হতে পারে না।

এখানে খুবই লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশের অতীতের সরকারগুলো যেমন স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে না নিয়ে পাহাড়িদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিল, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে হাঁটছে। ‘নতুন বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া থেকে পাহাড়িদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে। যদিও গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলার। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণও ইউপিডিএফের নেতৃত্বে এই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগের মতোই সেনাবাহিনীর প্রেসক্রিপশনে অন্যায় দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এতেই প্রমাণ হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে শাসকগোষ্ঠির নীতির কোন বদল হয় না। তাদের একটিই নীতি, সেটি হচ্ছে পাহাড়িদের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া। 

তবে, সরকার-শাসকগোষ্ঠি এবং শাসকগোষ্ঠিভুক্ত দলগুলোর মনে রাখা দরকার যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সেখানে বসবাসরত পাহাড়ি জনগণকে বিচ্ছিন্ন রেখে, সেনাশাসন দিয়ে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে বাংলাদেশ কখনো একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তাই বলে দিচ্ছে।

কাজেই, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম ও পাহাড়িদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার “স্বায়ত্তশাসন” প্রদানের মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা লাভ করতে পারে।#

০৩.০৬.২০২৫


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন