সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

স্মৃতিতে রূপক দা

আমার অনুসরণীয় ব্যক্তিদের মধ্যে রূপক চাকমা ছিলেন একজন। তাঁর সাথে কাজ করার তেমন বেশি সুযোগ না হলেও যে ক’বার তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়েছে বা সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ হয়েছে তাতে তাঁর আচার-আচরণ, কথাবার্তা ও চালচলনে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাঁর অমায়িক আচরণে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি।

মনে পড়ছে ১৯৯৯ সালের কথা। রূপকদা সহ পিসিপি’র কেন্দ্রীয় একটি সফর দল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি সফর করে। এ সফর দলে আমিও যোগ দিই। সফর দলে আরো অনেকে ছিলেন, যারা আর এখন পার্টি বা সংগঠনের সাথে যুক্ত নেই। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে কমিটি গঠনের পর সফর দলটি রাঙামাটির নান্যাচর উপজেলার ঘিলাছড়িতে যায়। সেখানে গিয়ে চৈ ছড়ি নামক একটি গ্রামে আমরা রূপক দা সহ একটি বাড়িতে রাতযাপন করি। যতদূর মনে পড়ে ২১ জানুয়ারি ঘিলাছড়ি ইউপি কমিটি গঠনের পর বিকেলে আমরা ২৬ জনের একটি দল রওনা দিই লক্ষ্মীছড়ির উদ্দেশ্যে। ঘিলাছড়ি মৌন পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে আমরা লক্ষীছড়ির 'পেক্কো আদাম' নামের একটি গ্রামে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে রাতযাপন করা হয়। পরদিন ২২ জানুয়ারি আমরা রওনা দিই লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা সদরের উদ্দেশ্যে। কয়েক মাইল পথ পায়ে হেঁটে, এবড়ো-থেবড়ো পথ পাড়ি দিয়ে বিকেলের দিকে আমরা মরাচেঙের বাদী পাড়া নামক এলাকায় গিয়ে পৌঁছি।

২৪ জানুয়ারি আয়োজন করা হয় লক্ষ্মীছড়ি থানা শাখার সম্মেলন। এ সম্মেলন বানচাল করার জন্য প্রশাসন চক্রান্ত করে ১৪৪ ধারা জারি করে। এদিন রূপকদা সহ অন্যান্য নেতারা ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সহিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হন। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে হাজারো জনতার অংশগ্রহণে সেদিন আমাদের সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হয়।

মৃত্যুর কিছুদিন আগেও রূপক দা লক্ষ্মীছড়ি সফর করেন। সে সময়ও তার সাথে থাকা-খাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। সে সময় সেখানে অবস্থানকালে তিনি প্রচণ্ড ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন। ঔষধ সেবনের পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও তখন পর্যন্ত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ অবস্থায় পানছড়ি এলাকায় ইউপিডিফ’র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য তাঁর উপর দায়িত্ব পড়ে। তিনি কোন কার্পণ্য না করে দুর্বল শরীর নিয়ে লক্ষ্মীছড়ি থেকে খাগড়াছড়িতে যান নির্বাচনী প্রচারণার কাজে অংশ নিতে। কিছুদিন পরই তার মৃত্যুর খবর শুনতে পাই।

রূপকদা ২০০১ সালের আজকের এই দিনে (২১ সেপ্টেম্বর) ইউপিডিএফ’র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ চালানোর সময় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার পুজগাঙের মধুমঙ্গল পাড়ায় জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর সশস্ত্র সদস্যদের হামলায় শহীদ হন। শুনেছি সেদিন জেএসএস'র সদস্যরা যখন তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয় তখন তিনি 'আমি রূপক চাকমা' বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি মনে করেছিলেন পরিচয় পেলে ঘাতকরা তাঁর প্রাণ হরণ করবে না। কিন্তু রক্ত পিপাসু ঘাতকরা সেদিন তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে বীরদর্পে পালিয়ে যায়।

রূপকদা আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর যে চেতনা, তাঁর যে আদর্শ সেটা কোনদিন মুছে যাবে না। জুম্ম জাতির আদর্শের প্রতীক হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন।#

(দ্রষ্টব্য: ফেসবুকের পুরোনো নোট থেকে লেখাটি সংযোজন-বিয়োজন করে এখানে প্রকাশ করা হলো)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন