রবিবার, ৮ মার্চ, ২০১৫

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীদের নিরাপত্তাহীনতা

আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের দেশে দেশে নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে আজকের এই দিনটিকে পালন করা হয়ে থাকে। 

যে চেতনাকে ধারণ করে নারী দিবসের স্বীকৃতি, বর্তমানে সে চেতনা অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। মূলতঃ এ দিনটি নারীদের অধিকার আদায়ের একটি দিন। আন্দোলনের মাধ্যমেই নারীরা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল এ দিনের স্বীকৃতি। কিন্তু  নারীদের গৌরবদীপ্ত এ দিনটিকে এখন একটি আনন্দ-উৎসবের দিনে পরিণত করা হয়েছে।

যে কারণে নারী দিবসের স্বীকৃতি
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ । সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুঁচ কারখানার নারী শ্রমিকেরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে আট ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন।

আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেফতার হন বহু নারী। কারাগারে নির্যাতিত হন অনেকেই। তিন বছর পরে ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’। ১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার অধিকার।

১৯১০ সালের এই দিনে ডেনমাকের্র কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।

এর পর থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। এর দু বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

নারী অধিকার ও নারী নির্যাতন
প্রত্যেক দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে। এদিনটিতে নারী সংগঠনগুলো তপর হয়ে ওঠে। সমাবেশ-মিছিল শোভাযাত্রা হয়। সরকারীভাবেও দিবসটি পালিত হয়। রাষ্ট্রের হোমরা চোমরারা নারী অধিকার নিয়ে অনেক গালভরা বাক্য বিস্তার করেন। অনেক প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। নারী অধিকার বিষয়ক সনদ, সিদ্ধান্ত, প্রস্তাব ও খসড়া আইন লিখতে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের নারী সমাজের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। নারী নির্যাতন, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ, নারীর অবমূল্যায়ন কমে না। 

বর্তমান সভ্য সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্রের অসভ্য রক্ষক ও তাদের লেলিয়ে দেয়া গুন্ডাদের হাতে দিনাজপুরের ইয়াসমিন, বাঘাইছড়ির কল্পনা চাকমা ও চট্টগ্রামের সীমারা এখনো বলি হয়। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটে নারী ধর্ষণ, নির্যাতনের মতো বর্বর ঘটনা। বছর শেষে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা, সংগঠনগুলো নির্যাতনের হিসাব মেলায়। ছাড়িয়ে যায় হাজার হাজার নারী নির্যাতনের ঘটনা। এক কথায় দেশে নারী সমাজের অবস্থা খুবই ভয়াবহ।


পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীদের অবস্থা
দেশের দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীদের অবস্থার চিত্র আরো বেশী ভয়াবহ ও করুণ। জাতিগত নিপীড়ন, বিশাল সামরিক বাহিনী ও সেটলার উপস্থিতির প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে ব্যাপক মাত্রায় নারী নির্যাতন। প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে সেনা সদস্য অথবা সেটলার বাঙালিদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। সেনা কমান্ডার কর্তৃক হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণ পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনার একটি নমুনা মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক জুম্ম নারী ধর্ষণ, অপহরণ কোন অপরাধ বলে গণ্য হয় না। বরং এসব ঘটনা সংঘটনকারীকে পুরষ্কারই প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ এইসব কাজকে তথাকথিত
Counter-insurgency -এর কৌশল হিসাবে মনে করা হয়। সেজন্য আজ পর্যন্ত কোন সেনা সদস্যকে নারী নির্যাতনের কারণে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে বলে জানা যায়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। সর্বদা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে জুম্ম নারীদের। নারী দিবসের তিনদিন আগে গত ৫ মার্চ রাঙামাটির কাউখালীর ঘাগড়ায় নিজ বাড়িতে এক গর্ভবতী জুম্ম নারী কয়েকজন বাঙালি যুবক কর্তৃক জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত দুই মাসে কমপক্ষে ১০ জন জুম্ম নারী ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এক তথ্য অনুযায়ী গতবছর ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছিল ৩৪ জন জুম্ম নারী। যা এর আগের বছরগুলোর চেয়ে দ্বিগুন।

আসলে জুম্মোদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য শাসকগোষ্ঠি যে কৌশল, সেই কৌশলের অংশ হিসেবে চালানো হয় জুম্ম নারীদের বিরুদ্ধে এই যৌন সন্ত্রাসের। সামরিকায়িত ও যুদ্ধ কবলিত প্রত্যেক দেশেই ধর্ষণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামও যে তার ব্যতিক্রম নয় তার প্রমাণ মেলে এই অপরাধের পরিমাণ ও মাত্রা দেখে।


কাজেই, এসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী সহ দেশের সকল নারী সমাজকে আরো বেশি সজাগ ও সোচ্চার হয়ে সুসংগঠিত হতে হবে। এইসব অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারীদের তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।


নিরন চাকমা
৮.৩.২০১৫

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন