শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাকান্ড

রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসেৌধ।
 আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী দেশের বরণ্য সন্তান হাজার হাজার শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে তাদের ওপর চালায় নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন তারপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। ওরা আরো মনে করেছিল যে, এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে ওরা বসবাস করতে পারবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে এদেশকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের এসব বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। বর্বর পাক বাহিনী ও রাজাকাররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক সহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে এদেশকে মেধাশূণ্য করার অপচেষ্টা চালায়। তাই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এইদিনকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই এই দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)
বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে, একইদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ জুম্মদের উপরও চালানো হয় নির্যাতন ও হত্যাকান্ড। তবে এ নির্যাতন ও হত্যাকান্ড পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়নি। এদেশের মুক্তিবাহিনীই খাগড়াছড়ির কুকিছড়া-গাছবান এলাকায় এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করে। এদিন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কমপক্ষে ৮জন নিরীহ জুম্মকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে সেদিনের ঘটনা তুলে ধরা হলো:
প্রত্যক্ষদর্শী কনক বরণ চাকমা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, সেদিন ছিল মঙ্গলবার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। পাঞ্জাবী সৈন্য আর মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সেদিন একটা যুদ্ধ হয়। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর টিলার উপর দিকে কালো ধোঁয়া দেখা যায়। যখন কালো ধোঁয়া দেখা গেল তখন শিরে বাপ নামে এক ব্যক্তি আমার বাবাকে বলছে দেখ দেখ কিসের কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তখন আমার বাবা তাকে বলেন বোমার আগুনে মনে হয় বাড়িতে আগুন লেগেছে। এর কিছুক্ষণ পরই মুক্তি বাহিনীর ৪ জন সদস্য আমাদের পাড়ায় আসে। আসার পর প্রথমে তারা আমার জেঠার বাড়িতে এবং পরে আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। যখন আমাদের বাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছে তখন বাবা বাড়ির বাইরে ছিলেন। মুক্তি বাহিনীরা তখন বাবার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে,তোমার ছেলেরা কোথায়? তখন বাবা তারা লুকিয়ে আছে বলে উত্তর দেয়। মুক্তিবাহিনীরা সবাইকে বের হওয়ার নির্দেশ দেয়। তাদের নির্দেশ মোতাবেক আমার দুই ভাই বেরিয়ে আসলে মুক্তিবাহিনীরা আমাদের সবাইকে নিয়ে কিনারাম মাষ্টারের বাড়ির উঠানে নিয়ে যায়। এ সময় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কিনারাম চাকমার কাছ থেকে তুমি কি কর? তুমি কি কর? বলে বার বার জিজ্ঞাসা করে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে কিনারাম মাষ্টার আমি ডিপি, আমি ডিপি বলে উত্তর দেয়। তিনি নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতেও ভুলে যান। অথচ তিনি ছিলেন তখন গাছবান স্কুলের একজন শিক্ষক। এ সময় কিনারাম মাষ্টারের কাঁধে একটি গামছা ঝোলানো ছিল। মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা তার কাছ থেকে গামছা কেড়ে নিয়ে চোখ বেঁধে দিয়ে আমাদের চোখের সামনেই তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা আমার জেঠাতো ভাই, আমার দুই ভাই সহ মোট ৮ জনকে গুলি করে হত্যা করে।তাদেরকে হত্যার পর আমাদের আরো অন্য একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আমার বাবা মুক্তি বাহিনীর এক সদস্যের পায়ে পড়ে মা চাইলে মুক্তি বাহিনীর সদস্যটি তখন বাবাকে গালে চড় মেরে মাটিতে ফেলে দেয়।এরপর আমাদেরকে সেখানে রেখে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চলে গেলে আমরা প্রাণে বেঁচে যাই।
আরো এক প্রত্যক্ষদর্শী প্রিয়লাল চাকমা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমার বাবা সহ আমি বাড়িতে ছিলাম। বাড়িতে একজন হেডম্যানের সাথে বাবা কথা বলার কারণে আমি ক্ষেতে কাজ করার জন্য বাড়ি থেকে বের হই। কিছুদূর যাবার পর পথিমধ্যে মিজোদের একটা গ্রুপকে নাগাল পাই। এসময় মুক্তিবাহিনীর একটি গ্রুপ কুকি ছড়া ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। মিজোরা আমার কাছ থেকে নানা কিছু জিজ্ঞাসার পর ছেড়ে দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি আবার বাড়িতে ফিরে আসি।বাড়িতে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই মিজোদের সাথে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। আমরা যে যেদিকে পারি পালানোর চেষ্টা করি। ঘন্টা খানিক যুদ্ধ চলার পর মিজোরা পালিয়ে গেলে মুক্তিবাহিনীরা গ্রামে ঢুকে বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। তারা আমার ভাইকেও ধরে নিয়ে যায়। তাকে আর ফিরে পাওয়া যায় নি।একই দিনে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা লোকামনি, নীলমনি, বাজিবো ও পূর্ণ বিজ্ঞান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে। বাজিবো ও পূর্ণ বিজ্ঞান চাকমা এ সময় মাঠে গরু চড়াচ্ছিলেন। সেখান থেকে ধরে নিয়ে এসে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা তাদের চার জনকে একই গর্তে কবরে দেয়। আমার বাবাকে পরে আমরা অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে কবর দিই। (সূত্র: সিএইচটিনিউজ.কম)
এই হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় একের পর এক হত্যাযজ্ঞ। ’৭১ সালের ডিসেম্বর মাসেই পানছড়ি, দিঘীনালা সহ বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা জুম্মদের উপর হামলা, নিপীড়ন-নির্যাতন ও  বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড চালায়।  এর ধারাবাহিকতায় কাউখালী, লোগাঙ, নান্যাচর সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। চালানো হয়েছে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলা। যা আজো অব্যাহত রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যাকান্ডের চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
এছাড়াও ২০১১ সালের এই দিনে খাগড়াছড়ির দিঘীনালায় হত্যা করা হয় চিকন মিলা চাকমা নামে এক পাহাড়ি নারীকে। রাঙামাটি বাঘাইছড়ি এলাকায় এক মোটর সাইকেল চালকের লাশ পাওয়াকে কেন্দ্র করে সেটলার বাঙালিরা দিঘীনালার কবাখালী বাজার এলাকায় নিরীহ পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। এ হামলায় চিকন মিলা চাকমা গুরুতর আহত হলে হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। এদিন আরো বেশ কয়েকজন জুম্ম সেটলারদের হামলায় আহত হন।

১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। ইতিমধ্যে কুখ্যাত 
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যাকান্ডের বিচারতো দূরের কথা, এসব ঘটনার কোন সুষ্ঠু তদন্তও করা হয়নি। ফলে ডজনের অধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হলেও হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে আজো সাম্প্রদায়িক হামলা, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। ’৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে যদি রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিচার করা হয় তাহলে একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণহত্যা, নিপীড়ন-নির্যাতন, নারী ধর্ষণের সাথে জড়িতের কেন বিচার করা হবে না?

বাংলাদেশের জনগণ যদি ৪২ বছর আগে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, নিপীড়ন-নির্যাতনের বিচার চাইতে পারে, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যা ও নিপীড়ন নির্যাতনের বিচার চাওয়ার অধিকারও আমাদের রয়েছে। এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম তরুণ প্রজন্মকেই সোচ্চার হতে হবে।

নিরন চাকমা
১৪.১২.২০১৩











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন