শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি ছাড়া পাহাড়িদের ভূমি অধিকারের নিশ্চয়তা কোথায়?

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'পাহাড়ে বসবাসকারী সবার ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যা করার প্রয়োজন তার সবই করবে সরকার।'(ইত্তেফাক, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪)

তিনি আরো বলেছেন, 'যারা পার্বত্যাঞ্চলে থাকেন তাদের ভূমির অধিকার রয়েছে। তারা আমাদের দেশের নাগরিক। এজন্য দেশের নাগরিকদের মতো তারাও ভূমির অধিকার ভোগ করবেন।' (সূত্র: ঐ)

এখন প্রশ্ন হচ্ছে,  তিনি কিভাবে পাহাড়িদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করবেন। প্রধানমন্ত্রী পাহাড়ে বা পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারীরা দেশের নাগরিকদের মতো ভূমি অধিকার ভোগ করার কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন তা বোধগম্য নয়। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িরা ছাড়াও কয়েক লক্ষ বহিরাগত বাঙালি বসবাস করছেন। যাদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিয়ে এসে পাহাড়িদের হাজার হাজার একর ভোগদখলীয় জমি বেদখল করে সেখানে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাহলে তিনি কি এই বহিরাগত বাঙালিদেরও ভূমি অধিকার নিশ্চিত করবেন?

প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত কথার মাধ্যমে এটা না বুঝার কোন কারণ নেই যে, 'পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী সবাই ভূমি অধিকার ভোগ করবেন' এই কথাটির মাধ্যমে তিনি বহিরাগত বাঙালিদের ভমি অধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন। এখানে পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার কথাটি তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর এটা মনে রাখার দরকার যে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা আর পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি ব্যবস্থাপনা এক নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল জমিই সামাজিক মালিকাধীন অর্থা সে সব হচ্ছে যৌথ সম্পত্তি। পাহাড়িরা যুগ যুগ ধরে প্রথাগত নিয়মেই নিজ নিজ ভূমির অধিকার ভোগ করে আসছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনের আওতায় এলেও তা ছিল ননরেগুলেটেড জেলা। ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলা বা অন্যান্য অঞ্চলে যে আইন-কানুন ছিল, তা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য ছিল না। ১৯০০ সালের রেগুলেশন যা ‘হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল’ নামে অধিক পরিচিত, সে আইন দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসিত হতো। ঐ শাসনবিধি উপনিবেশিক স্বার্থে রচিত ও প্রণীত হলেও, ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকরা এ অঞ্চলের “প্রথাগত অধিকারকে” স্বীকৃতি দিয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্র তথা সরকার পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি-সম্পত্তির অধিকার অস্বীকার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে সমতলের লাখ লাখ বাঙালিকে পাহাড়িদের বংশ পরম্পরার ভোগদখলীয় জায়গা-জমির ওপর পুনর্বাসন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জটিল করেছে। বহিরাগত বাঙালিদেরকে বেআইনীভাবে পাহাড়িদের জায়গা-জমি বন্দোবস্তি দেয়ার পরিণাম হচ্ছে মারাত্মক।

সরকারি উদ্যোগে আগত সেটলার ছাড়াও বর্তমানে নানা ধরনের লোক (বিভিন্ন কোম্পানী ও ব্যক্তি) বাইরে থেকে এসে সরকার-প্রশাসনের যোগসাজশে পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গা-জমি কিনছে, বন্দোবস্তি নিচ্ছে, লিজ নিচ্ছে। কী পরিমাণ জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তার পরিসংখ্যান দেখলেই চমকে উঠতে হয়। মূলতঃ পাহাড়ি জনগণের প্রতি সরকার-প্রশাসনের বৈরী মনোভাবের কারণে এভাবে বহিরাগতদের নিকট পাহাড়িদের জমি দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণই সরকারের ওপর বর্তায়। সরকার পাহাড়িদেরকে নিজ ভূমিতে সংখ্যালঘু ও বাস্তুভিটা থেকে বিতাড়িত করতে চায়।

সরকারের এটাও মনে রাখার দরকার যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের ওপরই কিন্তু নির্ভর করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি। ভূমি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে পাহাড়িদের ‘প্রথাগত ভূমি অধিকারকে' সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং বহিরাগত বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সমতলে সরিয়ে নিয়ে পাহাড়িদেরকে তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি ফিরিয়ে দেয়া। এটা করা  হলে ভূমি বা সম্পত্তির ওপর পাহাড়িদের আইনগত অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু সরকার প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি না দিয়ে, বহিরাগত বাঙালিদের পাহাড়িদের জায়গার উপর রেখে এ সমস্যা সমাধান করতে চাইলে তাতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। দেশের প্রচলিত আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা সমাধান করতে চাইলে তাতে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাই ঘটছে। এখন সরকার এ সমস্যাটি কিভাবে সমাধান করতে চায় তা দেখার বিষয়।#

নিরন চাকমা
৬.০৯.২০১৪

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন