'উন্নয়ন' নামক শব্দটি শুনতে
ভালো লাগলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এ শব্দটির সাথে মিছে আছে কান্না, উচ্ছেদ আর ভূমি হারানোর
আর্তচিৎকার। তাই বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু
করে অপরাপর মন্ত্রী-এমপিদের মুখ থেকে উন্নয়নের কথা শুনে পাহাড়িরা আশঙ্কিত না হয়ে পারছে
না।
সরকার রাঙামাটিতে বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডকেল কলেজ স্থাপনের সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে
ফেলেছে। অন্যদিকে সাজেককে দার্জিলিং বানানোর ঘোষণা দিয়ে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র সহ রাস্তাঘাট
উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারার নাক্রাই
ছড়ায় জলবিদ্যুত প্রকল্পের কথা শুনা যাচ্ছে। মন্ত্রী-এমপি তথা সরকারের কথাবার্তা শুনে
ও কাজ কর্ম দেখে মনে হচ্ছে উন্নয়ন হলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সমস্যার সমাধান হয়ে
যাবে। পাহাড়িরা যেন শুধু উন্নয়নই চাচ্ছে, আর কোন কিছুই নয়। আসলে এই 'উন্নয়ন' নামক শব্দটির
পেছনে রয়েছে সরকারের সুগভীর ষড়যযন্ত্র। পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার একটা গোপন
পরিকল্পনা।
সত্যি বলতে কি, পার্বত্য
চট্টগ্রামের জনগণকে বহু আগে থেকেই উন্নয়নের ঘুম পাড়ানি গান শোনানো হচ্ছে। সেজন্য পার্বত্য
চট্টগ্রামে উন্নয়ন শব্দটি নতুন কিছু নয়। বহু আগে থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ এ শব্দটির সাথে
পরিচিত। শুধু পরিচিত নয়, উন্নয়ন সম্পর্কিত অনেক তীক্ত অভিজ্ঞতাও পাহাড়িদের রয়েছে। তাদের
অভিজ্ঞতা বলে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে যতবেশি ‘উন্নয়নের’ কাজ হয়েছে, তত বেশি তারা নিঃস্ব
হয়েছে, নিজের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়েছেন ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের জন্য কি বিপর্যয় নিয়ে এসেছে তার বিস্তারিত বিবরণ
না দিলেও চলবে। কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
কি প্রভাব ফেলেছে সে সম্পর্কে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। মূলত কাপ্তাই বাঁধ ছিল পার্বত্য
চট্টগ্রামের জনগণের জন্য এক চরম অভিশাপ। তখনো কি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি? পার্বত্য
চট্টগ্রামবাসীদের কি শোনানো হয়নি সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির অমৃত ললিতবাণী? এই কাপ্তাই
বাঁধের ফলে যে ৫৪ হাজার একর আবাদী জমি পানির নীচে তলিয়ে গেলো, লক্ষাধিক পাহাড়িকে উদ্বাস্তু
হতে হলো এই বেদনা কি পাহাড়িরা কোনদিন ভুলতে পারবে?
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ
অবশ্যই উন্নয়ন চায়। এই উন্নয়ন কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়। এই উন্নয়ন সার্বিক রাজনৈতিক,
সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক। উন্নয়ন হচ্ছে একটি সামগ্রিক ধারণা।
এর সাথে অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। রাজনৈতিক অধিকারকে অস্বীকার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের
মাধ্যমে একটা জাতিকে শাসন-শোষণ করার শাসকগোষ্ঠির মানসিকতা কখনো শুভ ফল দেবে না। অর্থনৈতিক
উন্নয়নকে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অধিকারকে বিযুক্ত করে দেখা হচ্ছে একটি অত্যন্ত
ভুল ও একপেশে ধারণা। বর্তমান সরকার এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে
উন্নয়নের বুলি আওড়াচ্ছে।
যে কোন জাতি ও জনগণের উন্নয়নের
মূল শর্ত হচ্ছে তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন। এই অধিকার না থাকলে যে উন্নয়ন কর্মকান্ড
পরিচালিত হবে তার সুফল সাধারণ জনগণ ভোগ করতে পারবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতায়
এর প্রমাণ মেলে।
মোট কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামে
তথাকথিত উন্নয়নের নামে যাই হোক না কেন যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা
হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের জন্য কখনো শুভ ফল বয়ে আনবে
না। আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠিরগুলোর উন্নয়নের বলি হওয়ার অভিজ্ঞতার
কথা বিবেচনা করি, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়নের কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে
তাতে উৎফুল্ল হওয়ার বদলে বরং আতঙ্কিতই হতে হবে। সরকারের
এই উন্নয়নের ফাঁদ থেকে বের হতে না পারলে কাপ্তাই বাঁধের মতো আবারো পাহাড়িদের আর্তনাদ
করা ছাড়া আর কোন উপায়ই থাকবে না। #
নিরন চাকমা
২৭.১০.২০১৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন