বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৩

মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা নতুন জীবনের স্বপ্ন

মানুষ মরণশীল এটা চিরন্তন সত্য। সময় হলে যে কাউকে সে পথে ধাবিত হতেই হবে। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু অনাকাঙ্খিত ও অস্বাভাবিক। এই মৃত্যু নামক জিনিসটিকে কেউ সহজে মেনে নিতে চায় না। তবুও তাকে আঁকড়ে ধরেই জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

আমি এই মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছিলাম। যদিও মৃত্যুদূতটি আমার খুব কাছ দিয়েই চলে গিয়েছিল। সেই মুত্যুদূতটি আর কেউ নয়, সন্তু লারমারই লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনীর দল।

২০০৪ সালের ২৬ মার্চ। রাঙামাটি সদর উপজেলার কুদুকছড়ি হেডম্যান পাড়ার একটি বাড়িতে সহযোদ্ধা বন্ধুদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৫টা। হঠা গুলির আওয়াজ হলো। আমরা পালানোর চেষ্টা করলাম। পিছনে পিছনে গুন্ডার দলটি  গুলি করতে করতে আমাদেরকে ধাওয়া করলো।  এ সময় গুন্ডাদের ছোঁড়া একটা গুলি আমার বাম পায়ের ‘রানে” বিদ্ধ হয়। এরপর আমি কোন রকমে একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে সক্ষম হই। দু’তিন মিনিট পরই ২/৩জন গুন্ডাকে আমার একেবারে পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখলাম।  এ সময় তারা বলাবলি করছিলো এদিকেতো একজন চলে গেছে। সে কোথায় গেল...। আমি যত পারি চুপচাপ হয়ে রইলাম। যদি তারা টের পেতো তাহলে নিশ্চিত তারা আমাকে মেরে ফেলতো। ভাগ্যিস তারা আমি যে লুকিয়ে আছি সেটা টের পায়নি। আস্তে আস্তে রাত নেমে এলো।  লোকজনের কোন সাড়া শব্দ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর গুন্ডার দলটি চলে গেছে বলে মনে হলো। তারপরও ভয় হচ্ছিল যদি তারা লুকিয়ে থাকে। এদিকে যতই সময় যাচ্ছে ততই আমার পা ভারী হয়ে উঠছে, যন্ত্রনা করছে, পানির পিপাসা বেড়ে গেছে।  আমাকে সহযোগিতা করবে এমনতো আর কেউ পাশে নেই।  কোন উপায়ন্তর না দেখে  সাহস করে ‘ও মানুষ, ও মানুষ’ করে বড়বড় করে দু’একটি চিকার দিলাম। আমার চিকার শুনে গ্রামের লোকজন সাড়া দিলো। পরে তাঁরা এসে আমাকে ঐ ঝোঁপের ভেতর থেকে উদ্ধার করে প্রথমে একটি বাড়িতে নিয়ে গেলো।  তাঁদের কাছ থেকে আমি পানি খুঁজলে তাঁরা আমাকে পানি খেতে বারণ করলো। পানির পরিবর্তে তাঁরা আমাকে লেবু কেটে রস খেতে দিলো। এরপর তাঁরা আমাকে কুদুকছড়ি বাজারে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিসার ব্যবস্থা করলো। এদিন গুন্ডাদের হামলায় আমি ছাড়াও আরো দু’জন আহত হন। যদিও তাদের আঘাত আমার মতো মারাত্মক ছিল না। এর মধ্যে একজন হলেন সহযোদ্ধা সম্রাট ও অপরজন পলাশ নামে স্থানীয় এক যুবক। পরে সহযোদ্ধারা আমাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানোর  ব্যবস্থা করলেন।

রাত আনুমানিক আটটার দিকে কুদুকছড়ি বাজার থেকে আমাদেরকে বহনকারী গাড়িটি রওনা দেয়। পথিমধ্যে গাড়িটির চাকা পাংচার হয়ে যায়।  এরপর নতুন চাকা লাগিয়ে আবার রওনা হয়। যাবার পথে বিভিন্ন জায়গায় আর্মির চেকপোষ্টে দু’তিন বার আমাদের বহনকারী গাড়ি আটকানো হয়। তারা আমাদের সাথে থাকা লোকদের কাছ থেকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং গাড়ি তল্লাশি চালায়। এভাবে করতে করতে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পৌঁছতে আমাদের অনেক রাত হয়ে যায়। চট্টগ্রামে অবস্থানরত সহযোদ্ধারা আমাদেরকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান। কিন্তু রাত বেশি হওয়ার ফলে সেদিন ভালোভাবে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যাযনি। পরদিনই আমার পায়ের অপারেশন করা হয়।

দীর্ঘ দু’মাসের অধিক হাসপাতালে চিকিসাধীন থাকার পরও আমার পা’য়ের অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়ায় পরে হাটুর উপর কেটে পা’টি বাদ দিতে হয়। সেই থেকে শুরু হয় আরেকটা নতুন জীবন। এক পায়ে চলা জীবন।  সুস্থ-স্বাভাবিক একজন মানুষের শরীর থেকে একটি অঙ্গ হারানো যে কত কষ্টের, কত বেদনার তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারে। তারপরও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামের পথে চলমান আমার জীবন। যতদূর সম্ভব সমাজ ও জাতির জন্য ভালো কিছু করার স্বপ্ন লালন করি। সে লক্ষ্যে আজো রয়েছি অবিচল।

শারিরীকভাবে আমাকে পঙ্গু করা গেলেও যে চেতনাকে ধারণ করে আমি সমাজ ও জাতির জন্য কাজ করে যাচ্ছি সে চেতনা পঙ্গু হয়নি। এ চেতনার কোন মৃত্যু নেই। এ চেতনা শ্বাশত ও মহান। এ চেতনাই হচ্ছে আমার প্রেরণা এবং আদর্শ।

মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা এই নতুন জীবনে আমি স্বপ্ন দেখি নিপীড়িত জুম্ম জনগণের ভাগ্য বদলের। আমি স্বপ্ন দেখি জুম্ম জাতীয় ঐক্যের। যেদিন এই পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে রচিত হবে নতুন ইতিহাস, জুম্ম জনতা ফিরে পাবে বেঁচে থাকার ন্যায্য অধিকার, প্রতিষ্ঠিত হবে নিপীড়ন-নির্যাতন মুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম সেদিনই আমার জীবন সার্থক হবে। তাই আশায় বুক বাঁধি আমরা বিজয়ী হবোই...।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন