-- নিরন চাকমা
[ এ লেখাটি ইউপিডিএফ-এর এক যুগপূর্তি সংকলন ‘নব জাগরণ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। অনলাইন পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য এটি এখানে প্রকাশ করলাম।]
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ
লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের
মধ্যে দিয়ে জনসংহতি সমিতি সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃত্ব
শূণ্যতা দেখা দেয়। চারিদিকে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সমাজে ভাঙন দেখা দেয় । এমনি
এক পরিস্থিতিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় নয়া যুগের নয়া পার্টি ইউনাইটেড পিপল্স
ডেমোক্রেটি ফ্রন্টর্( ইউপিডিএফ)। হাল ধরে সমাজ বিনির্মাণের কাজে এবং কাঁধে তুলে নেয়
জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব। এই পার্টি বর্তমানে এক যুগ অতিক্রম করেছে। এই এক যুগ
সময় পেরিয়ে আসতে এই পার্টিকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। অনেক সহযাত্রীকে হারাতে হয়েছে।
তারপরও এই পার্টি সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমি এই পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য
হয়ে অধিকারহারা জাতিসত্তাসমূহের মুক্তির সনদ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে শরীক হতে
পেরে নিজেকে নিয়ে খুবই গর্ববোধ করি।
পার্টি এবং আন্দোলন কোন
সহজ বিষয় নয়। একটা পার্টি তার লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমেই সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ইউপিডিএফ
পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সফলতার সঙ্গে
এক যুগ পার করতে সক্ষম হয়েছে। পার্টির এই এক যুগের সময়ে আমার বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার
সুযোগ হয়েছে এবং অর্জিত হয়েছে নানা অভিজ্ঞতা।
ছোটকাল থেকে সেনাবাহিনীর
নিপীড়ন-নির্যাতন দেখেছি, দেখেছি আমার সামনে থেকে বাবা এবং বড় ভাইকে সেনারা হাত কড়া
পড়ে বেধে নিয়ে যেতে এবং দেখেছি সেনাবাহিনী কর্তৃক আমাদের বাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়ার দৃশ্য।
অপরদিকে দেখেছি নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ। এহেন অবস্থায় নিজেকে
সংগঠনের সাথে কিংবা পার্টির সাথে যুক্ত করার মানসিকতা পেয়ে বসে। ১৯৮৯ সালে ২০ মে পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদ গঠন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের
মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এমন একটি সময়ে এই প্রতিরোধ সংগ্রামের সাথে যুক্ত হয়ে
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্য হয়ে স্থানীয়ভাবে কাজ করার সুযোগ হয়। সে সময়ের একটি দিনের কথা এ লেখায় স্মৃতিচারণ না
করে পারছি না। যেদিনটিতে আমরা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (লক্ষীছড়ি এবং বর্মাছড়ি শাখার)
বেশ ক’জন কর্মী মিলে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়ে অঙ্গীকার করেছিলাম।
সংগঠনের প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে সেদিন (তারিখ ঠিক মনে পড়ছে না) আমরা বেশ ক’জন
কর্মী (যারা তৎসময়ে পরীক্ষিত) লক্ষীছড়ি সদরের শিলাছড়ি বৌদ্ধ বিহারে
বসেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আন্দোলন সংগ্রামের
জন্য আমাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত উচিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভগবান বুদ্ধ ও শ্রদ্ধেয় ভান্তেকে সাক্ষী রেখে আমরা
সবাই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উচিয়ে সেদিন অঙ্গীকার করেছিলাম যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম
জনগণের প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে উৎসর্গ করবো। এ অঙ্গীকারের কথা আমার এখনো বার বার মনে
পড়ে। মাঝে মাঝে আমি এ অঙ্গীকারের কথা মনে করেই সাহস সঞ্চার করি।
খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষীছড়ি
উপজেলাটা হচ্ছে সবচেয়ে পশ্চাদপদ একটি উপজেলা। বর্মাছড়ি এলাকাটা আরো বেশি পশ্চাদপদ।
এখানে শিক্ষার হার কম, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। যদিও এই এলাকাটির অবস্থান চট্টগ্রামের
খুব কাছে। কথায় বলে বাতির নীচে অন্ধকার থাকে। এ কথাটি লক্ষীছড়ি-বর্মাছড়ি এলাকার ক্ষেত্রে
সর্বাংশে প্রযোজ্য। ছোটকাল থেকে সমাজের নানা কুসংস্কার এবং পশ্চাৎপদতার মধ্যে আমাদেরকে বেড়ে উঠতে হয়েছে। সমাজের নানা পশ্চাৎপদতা পেরিয়ে এসে পার্টিতে যুক্ত থেকে জাতীয় মুক্তির
আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়।
লক্ষীছড়ি বর্মাছড়ি এলাকায়
যখন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এবং পার্টির কাজ শুরু হয় তখন সিনিয়র-জুনিয়র মিলে আমরা অনেকে
এক সাথে কাজ করেছিলাম। বর্তমানে অনেকে আর সংগঠন কিংবা পার্টির সাথে যুক্ত নেই। অনেক
ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে বিভিন্নভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায়
আছে। এবং অনেকে সমাজের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে। অনেকে চেয়ারম্যান-মেম্বারও হয়েছে।
অনেকে বিভিন্ন চাকরীতে যুক্ত। কিন্তু এর মধ্যে
সহযোদ্ধা রতন বসু, সমীর সহ আমরা ক’জন আজো রয়েছি সেই সংগ্রামের পথে, যে সংগ্রাম জাতীয়
মুক্তি অর্জনের লক্ষে পরিচালিত হচ্ছে।
আসলে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন
কাজটা হচ্ছে পার্টি এবং আন্দোলন সংগঠিত করা। এই কঠিনতম কাজে যুক্ত থেকে কাজ করার মধ্যে
যে আনন্দ পাওয়া যায় অন্য কোনভাবেই সে আনন্দ পাওয়া সম্ভব নয়। এখানে বিভিন্ন জায়গা ও
ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা থেকে যুক্ত হওয়া সহযোদ্ধাদের নিযে একসাথে লড়াই সংগ্রামের
কাজ করে যাওয়া, এক সাথে খাওয়া, এক সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা সত্যিই রোমাঞ্চকর। এই রোমাঞ্চকর
অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই দৃপ্ত শপথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
মূলত পার্টি গঠনের আগে
থেকেই বিভিন্ন জায়গার ন্যায় লক্ষীছড়ি এলাকায়ও পার্টির কাজ শুরু করা হয়। জেএসএস তখনো
আত্মসমর্পণ করেনি। তারা বিভিন্নভাবে চুক্তি সম্পর্কে জনগণকে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছিলো(মূলত
ধোকা দেয়ার চেষ্টা)। অপরদিকে আমাদের পক্ষ থেকে চুক্তির বিভিন্ন দিক সমালোচনা করে বক্তব্য, বিবৃতি দেয়া
হচ্ছিল। ফলে স্পষ্টতই জেএসএস-এর সাথে মতভেদ দেখা দিতে লাগলো। ১৯৯৭ সালে ১০ জুন প্রকাশিত
স্বাধিকার পত্রিকায় একটি লিড নিউজকে কেন্দ্র করে জেএসএস-এর মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
সেদিন ঐ পত্রিকার মূল খবরটি ছিল “ আসন্ন চুক্তি অধিকার প্রতিষ্ঠা না জলাঞ্জলি।” চুক্তিকে
নিয়ে এ লেখায় যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল চুক্তির ১৩ বছরেও সে আশঙ্কার কোন হেরফের
হয়নি। আসলেই ’৯৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের
স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছিল। যার কারণে সন্তু লারমাকে চুক্তির ১৩ বছর পার হয়েও
এ চুক্তি বাস্তবানের জন্য চিৎকার-চেচামেসি করতে হচ্ছে।
যা হোক, জেএসএস’র সাথে
বিভিন্ন মতপার্থক্যের মধ্যেও আমাদের কাজ থেমে থাকেনি। আমরা আমাদের মতো করে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের
লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে থাকি। এবং জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, চুক্তির মধ্যে
অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার কোন সম্ভবনাই নেই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, লক্ষীছড়ি
এলাকায় কাজ করতে গিয়ে যার নেতৃত্বে আমরা কাজ করেছিলাম তিনি আজ পার্টি থেকে বিচ্যুত
হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করছেন।
লক্ষীছড়িতে পার্টির কাজ
করতে গিয়ে যে কাজগুলোর মাধ্যমে জনগণের সমর্থন লাভ করা সম্ভব হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম
কাজ হচ্ছে চুরি, ডাকাতি দমন করা এবং সামজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। কারণ জেএসএস-এর চুক্তি
ও আত্মসমর্পণের পর অন্যান্য এলাকার ন্যায় এ এলাকায়ও চুরি, ডাকাতি, মদ, জুয়া ইত্যাদি
অপকর্ম বৃদ্ধি পায়। সমাজে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় যা বর্ণনা করার মতো নয়। কাজেই এ
কাজগুলোকে আগে প্রাধান্য দিয়েই আমাদের এগুতে হয়েছে। এ কাজগুলো করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকারও
কম মুখোমুখি হতে হয়নি। সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হয়েছে।
যেদিন নয়া যুগের পার্টি
ইউপিডএফ গঠন হলো অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর ’৯৮ সালে তারপর দিন ২৭ ডিসেম্বর আমরা ১৫/২০ জন মিলে “নতুন পার্টি এসেছে, জুম্ম জাতি
জেগেছে” “ জুম্ম জনতার সংগ্রাম চলছেই, চলবে”... ইত্যাদি শ্লোগানে লক্ষীছড়ি বাজার থেকে
একটি মিছিল বের করি। সেদিন মিছিলে যারা ছিলাম আজ অনেকে পার্টির সাথে নেই। তারপরও যে
চেতনাকে ধারণ করে সেদিন আমরা মিছিল সহকারে নতুন পার্টিকে স্বাগত জানিয়েছিলাম পার্টির
এক যুগেও সে চেতনায় আমি আজো অবিচল রয়েছি।
এরপর আসলো ১০ ফেরুয়ারী
’৯৮ সাল। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে কলঙ্কজনক দিন। সেদিন সন্তু লারমার নেতৃত্বে জেএসএস-এর
সদস্যরা খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে প্রথম দফা অস্ত্রসমর্পণ করেছিল। সেদিন সন্তু লারমার তার
হাতে থাকা এসএমজিটি শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে ফুলের তোড়া উপহার নিয়েছিলেন। আমরা জেএসএস-এর
আত্মসমর্পণকে ধিক্কার জানিয়ে সেদিন লক্ষীছড়ি বাজারে সন্তু লারমার কুশপুত্তলিকা দাহ
করেছিলাম এবং টাঙ্গোন উড়িয়ে দিয়েছিলাম। সন্তু লারমার নেতৃত্বে জেএসএস-এর এই নির্লজ্জ
অস্ত্র সমর্পণের মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে লড়াই সংগ্রামের একটি পর্বের সমাপ্তি
ঘটে এবং ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের লড়াই জোরদার
হয়ে ওঠে।
পার্টির কাজ করার সুবাদে
১৯৯৯ সালের জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় টিমের সাথে
সাংগঠনিক সফরের উদ্দেশ্যে খাগড়াছড়িতে যাই। আমাদের টিমে শহীদ রূপক দা, সমারী দি, ক্যহ্লাচিং
দা সহ আরো অনেকে ছিলেন। এ সফরের মাধ্যমে ১৯ জানুয়ারী খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের
মাইসছড়ি ইউনিয়ন কমিটি, ২১ জানুয়ারী রাঙামাটি জেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন কমিটি এবং ২৪ জানুয়ারী
লক্ষীছড়ি থানা কমিটি গঠন করা হয়। লক্ষীছড়ি থানা কমিটি গঠন অনুষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসন
পরিকল্পিতভাবে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বিশাল সমাবেশের
মধ্যে দিয়ে সেদিন লক্ষীছড়ি থানা কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়। লক্ষীছড়িতে এই অন্যায় ১৪৪
ধারা ভঙ্গ করার মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে আরেকটি বীরত্বব্যঞ্জক
ঘটনা যুক্ত হয়। এবং চুক্তির পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগণ প্রকৃত মুক্তির আন্দোলন
থেকে যে সরে দাঁড়ায়নি তা আবারো দেখিয়ে দেয়।
১৯৯৯ সালের ২২ এপ্রিল।
পাহাড়ি গণপরিষদ এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন করা
হয় খাগড়াছড়িতে। এ সমাবেশে যোগ দিতে আমরা শত শত জনতাসহ লক্ষীছড়ি বাজারে উপস্থিত হই।
সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের ভাড়া করা গাড়িগুলো একটিও দেখা নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল,
যে দু’টি গাড়ি এসে পৌঁছেছে সেগুলো থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর আমরা বেশ ক’জন গাড়িগুলোর
খোঁজে থানার দিকে রওনা হই। সেখানে গিয়ে আমরা গাড়িগুলো দাবি করলে পুলিশের সাথে কথা কাটাকাটির
এক পর্যায়ে পুলিশ আমাকে আটক করে থানা হাজতে ঢুকিয়ে দেয়। আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য স্থানীয়
চেয়ারম্যান ও মুরুব্বীরা থানা কর্মকতাদের সাথে আলোচনা করছেন, এমনি সময়ে হাজতের ভেতর
থেকে মিছিলের শব্দ শুনতে পেলাম। মূলত আমাকে গ্রেফতার এবং খাগড়াছড়ি সমাবেশে যেতে বাধা
প্রদানের প্রতিবাদে জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে মিছিল করছিলো। সেই মিছিলের এমন গতি ছিল যে,
শেষ পর্যন্ত মিছিলটি সরাসরি থানায় গিয়ে উঠে। ফলে শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ ও ধরপাকড়।
সমান তালে চলতে থাকে সেটলার বাঙালিদের দিয়ে গঠিত লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমণ। মুহুর্তের
মধ্যে থানা হাজতে বন্দীর সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগলো। সেদিন পুলিশ ২৯ জনকে পুলিশ গ্রেফতার
করে। তার মধ্যে যিনি আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য সকাল থেকে থানা কর্তৃপক্ষের সাথে কথাবার্তা বলছিলেন সেই বাবুল চৌধুরীকেও পুলিশ
সেদিন গ্রেফতার করে। এছাড়াও যাদেকে সেদিন আটক করা হয় সবাই ছিল ছাত্র, যুবক এবং নিরীহ
জনগণ। অনেকেই ছিল পুলিশ এবং সেটলারদের লাঠিপেটায় আহত। পরে স্থানীয় মুরুব্বীদের সহযোগিতায়
সেদিন রাতে ১০ জনকে পুলিশ ছেড়ে দিলেও আমাদের ১৯ জনকে ছেড়ে দেয়নি। পরদিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল সকাল ৮ টার দিকে আমাদের ১৯ জনকে লক্ষীছড়ি
থানা থেকে একটি জিপে করে খাগড়াছড়ি জেলে প্রেরণ করা হয়। ফলে লড়াই-সংগ্রামের জীবনে যুক্ত
হলো আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতা।
আমরা যারা জেলখানায় গেলাম
তাদের কারোরই জেল সস্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। সেখানে কি কি করতে হয়, কিভাবে থাকতে
হয় তা আমাদের জানা ছিল না। তাই জেলখানায় ঢুকানোর পর স্বাভাবিকভাবে আমরা সবাই একটু হতচকিত
হই। আমাদেরকে যখন আমদানি ওয়ার্ডে ঢুকানো হলো তখন সেখানে যারা ছিলো তারা সবাই নতুন অতিথি
এসেছে বলে আমাদেরকে ঘিরে ধরলো। এরপর আমাদেরকে লাইন করে বসিয়ে কাউকে বডি চেক করা হলো,
কাউকে আগে কখনো জেল এসেছ কিনা, টাকা আছে কিনা ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা হলো। আর কাউকে দু’একটি
থাপ্পরও দেয়া হলো। আমাদের যেহেতু কারোর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না সেহেতু এটা নিয়ম মনে
করে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
এরপর আমাদেরকে তালিকাভুক্ত
করার পর জেলখানার সম্বল হিসেবে থালা, বাতি এবং কম্বল বরাদ্দ দেয়া হলো। সেদিন আমাদের
সকলের ঠাঁই হলো সেই আমদানী ওয়ােের্ড। পরদিন
থেকেই মোটামুটি জেলখানা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেল। আসলে আমদানী ওয়ার্ডে ঢুকানোর
পর যিনি আমাদেরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছিলেন তিনি ছিলেন আমদানী ওয়ার্ডের মেট। অর্থাৎ আসামীদের মধ্যে থেকে সাজাপ্রাপ্ত একজনকে মেট হিসেবে
নিয়োগ দিয়ে ওয়ার্ডের দেখাশুনা সহ যাবতীয় কাজ তদারকি করানো হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই
এই মেট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি বন্দীদের ওপর যা ইচ্ছা তাই করে থাকে।
জেলখানার ভেতর সে সময় বেশ
কয়েকজন বার্মা নাগরিকের সাথে দেখা হয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে সে সময় পর্যন্ত জেলে অন্তরীণ
ছিলেন। বার্মা সরকার তাদেরকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করায় তাদেরকে বাংলাদেশ
সরকার ফেরত পাঠাতে পারছে না বলে তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম। সে সময় খাগড়াছড়ি জেলে
তারাই রান্না-বান্না এবং বন্দীদের খাওয়া-দাওয়ার কাজটি করতেন। এদের মধ্যে একজন তার নাম
ঠিকানা আমাদের হাতে দেন, যাতে আমরা জেল থেকে বের হলে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে
দিই।
যা হোক, জেলখানার অভিজ্ঞতা
আমার খুবই সীমিত। মাত্র ১৯ দিনের মতো জেলে অন্তরীণ ছিলাম। এই ১৯ দিনের জেল জীবনে আমদানী ওয়ার্ডের মধ্যে আমাকে
থাকতে হয়েছে। তাই অন্য কোন ওয়ার্ড সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। তবে এটা বলতে পারি
যে, গোটা বাংলাদেশে অনিয়ম-দুর্নীতির যে চিত্র জেলখানার ভেতরও একই চিত্র দেখতে পেয়েছি।
খাদ্য, পানি সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। একজন বন্দী
যে পরিমাণ খাদ্য পাওয়ার কথা সে পরিমাণ খাদ্য দেয়া হয় না, যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা
সে পরিমাণ পানি দেয়া হয় না। এসব ক্ষেত্রে চলে দুর্নীতি। বন্দীদের বরাদ্দ থেকে একটি
অংশ জেলখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পকেটস্থ হয়ে যায়।
খাগড়াছড়ি জেলে ঢুকার পর
আমরা জানতে পারি খাগড়াছড়িতে আয়োজিত সমাবেশ বানচাল করে দিতে প্রশাসন গোটা খাগড়াছড়িতে
১৪৪ জারি করেছে। সেদিন খাগড়াছড়ি সমাবেশ যোগ দিতে এসে পুলিশের গুলিতে পুতুল ও সুরমণি
চাকমা শহীদ হয়েছেন এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন। পরে এ ঘটনায় আহত অনেকের সাথে জেলখানায়
দেখা হয়েছিলো। তাদের কাছ থেকে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত জেনেছি।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সন্তু লারমার যোগসাজশে এভাবে
গণতান্ত্রিক আন্দোালনের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের
আন্দোলনকে শুরুতে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু জনগণের আকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায়
এবং ইউপিডিএফ-এর সঠিক নেতৃত্বের কারণে সরকারের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। আজ পার্টির একযুগপূর্তি
তা-ই প্রমাণ করে।
দীর্ঘদিন লক্ষীছড়িতে কাজ
করার পর পার্টির সিদ্ধান্ত মোতাবেক দায়িত্ব পড়ে রাঙামাটি জেলার কুদুকছড়িতে কাজ করার।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০০৩ সালে ৬ জুন নতুন কর্মস্থল কুদুকছড়িতে যোগদান করি। সেখানে কাজ
করার সময়েই ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ জেএসএস-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক আমরা আক্রান্ত
হই। সন্ত্রাসীদের উপর্যুপুরি গুলিবর্ষণের মুখে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার বাম পায়ে একটি
গুলি লাগে। কোন রকমে পালিয়ে একটি ঝোঁপের ভিতর আশ্রয় নিই। পরে সন্ত্রাসীরা চলে গেলে
স্থানীয় জনগণ আমাকে উদ্ধার করে। সেদিন সন্ত্রাসীদের গুলিতে এক গ্রামবাসী সহ আমরা তিন
জন আহত হই। আহত অবস্থায় আমাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মেডিকেলে যাওয়ার
পথেও সেনাবাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় থামিয়ে তারা
আমাদের তল্লাশি চালিয়েছে। ফলে মেডিকেলে পৌছতে অনেক দেরী হয়ে যায়। চট্টগ্রাম মেডিকেলে
দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও আমার পা’টি রক্ষা করা যায়নি। ৭ মে ২০০৪ আমার
বাম পা হাটুর উপরে কেটে বাদ দিতে হয়। চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাই। শুরু হয় আরেকটি
নতুন জীবন। যে জীবন কখনো কেউ আশা করে না। দীর্ঘ দুই মাসের কাছাকাছি চট্টগ্রাম মেডিকেলে
চিকিৎসা করতে হয়েছে। এ সময় সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে যে ঐকান্তিক
সহযোগিতা পেয়েছি তা জীবনে কখনো ভুলে যেতে পারবো না। তাদের সহযোগিতা ছাড়া হাসপাতালের
বেডে শুয়ে দুই মাসের কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করা মোটেই সম্ভব ছিল না। চিকিৎসা শেষে ২০০৪ সালের ২১ মে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই।
পঙ্গু হওয়ার কারণে আমি প্রথমে মানসিকভাবে একটু ভেঙে পড়লেও পরে আন্দোলনের স্বার্থে এ
ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার চেষ্টা করি। এরপর ২৫ মে ’০৪ আমাদের পার্টি প্রধান প্রসিত দা’র একটি চিঠি হাতে
পাই। চিঠিতে তিনি লেখেন ...“মানুষের সাহস, উদ্যম, একাগ্রতা আর কঠিন সংকল্পের
কাছে কোন বাধাই বাধা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার
কর্ণেল তাহের’এর কথা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে। একজন সেক্টর কমান্ডার হয়েও তিনি নিজে
সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমে সৈনিকদের পরিচালনা করেছেন। যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের
বোমার আঘাতে তার ডান পা উড়ে গেছে। ডান পা হারিয়েও কর্ণেল তাহের ছিলেন অদম্য মনোবলের
অধিকারী। সৈনিকদের মাঝে ছিলেন একজন প্রিয় কমান্ডার। মুক্তি বাহিনীতে এবং পরবর্তী কালে
দেশ স্বাধীন হলে, সেনাবাহিনী পুর্ণগঠনের ক্ষেত্রে তার অনেক অবদান রয়েছে। কমান্ডার হিসেবে
তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। অফিসে বসেই সৈনিকদের পরিচালনা করেছেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট
উন্নত করার পেছনে তার অবদান রয়েছে। ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব তিনিই সংঘটিত করেছেন।
এক জন সুদক্ষ কমান্ডার হিসেবে কর্ণেল তাহের’এর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট র”জভেল্টও
সাধারণ মানুষের মতো সুস্থ ছিলেন না। ছোটবেলায় তার পোলিও হয়েছিলো। সে কারণে তিনি ঠিকমতো
হাঁটতে পারতেন না। রোগা হয়েও তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সৈনিকদের
উজ্জীবিত করার জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে তাকে হুইল চেয়ারে করে নৌ বাহিনীর জাহাজে নেয়া হয়েছিলো।
মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ সেনাপতি
তৈমুর লঙ’এর পাও ছিলো খোঁড়া। তিনি ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। অথচ এই তৈমুর লঙ গোটা
মধ্য এশিয়া দাবড়ে বেড়িয়েছেন। তার নাম শুনলে সে যুগে প্রতিপক্ষ সৈন্যদের বুক কাঁপতো।
প্যালেষ্টাইনের হিজবুল্লাদের
নেতা মোহাম্মদ ইয়াসিনও একজন পঙ্গু। তিনি উঠতে বসতে অক্ষম। হুইল চেয়ারে করে তাকে চলতে
ফিরতে হয়। অথচ এই ইয়াসিন প্যালেষ্টাইনে এক জঙ্গী আন্দোলনের নেতা।
পৃথিবীতে এ ধরনের আরো বহু
জ্ঞানী-গুণী বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন, যারা শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়েও দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা
সংঘটিত করেছেন। আসলে মানুষের প্রতিভা থাকলে তার বিকাশ ঘটবেই।...” প্রসিত দা’র এই চিঠিটা
পড়ে আমি এতই উদ্বুদ্ধ হই যে, যেন সঞ্জীবনী শক্তি ফিরে পেলাম এবং পার্টির সাথে সম্পৃক্ত
থেকে কাজ করার মানসিকতা আরো দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো।
এরপর চট্টগ্রামে অবস্থান
করে দীর্ঘদিন বিশ্রাম নিতে হয়েছে। দীর্ঘ বিশ্রাম ও চিকিৎসার পর শারিরীক কিছুটা উন্নতি হলে ২০০৫ সালের মে মাসে (সম্ভবত) কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য ঢাকায়
চলে যাই। সেখানে ব্রাকের একটি কৃত্রিম পা সংযোজনী কেন্দ্র থেকে কৃত্রিম পা সংযোজনের
পর ঢাকায় পার্টির কাজে যোগদান করি। ঢাকায় জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল সহ এক সাথে কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষত
বাম লেবাসধারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়। আসলে বাংলাদেশের
বাম লেবাসধারী কিছু সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল নিজেদের আঁখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত থাকার
কারণেই প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে কোন জোরালো আন্দোলন গড়ে
উঠতে পারছে না। প্রকৃত অর্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারা দেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত ও
মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একটি সত্যিকার গণআন্দোলনের কোন বিকল্প নেই।
ঢাকায় অবস্থান করার সময়েই
বাবা, মা দু’জনই মারা যান। মৃত্যুর আগে বাবা এবং মা উভয়ে আমার সাথে দেখা করার খুবই
ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। কিন্তু পার্টির কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে আমি তাদেরকে সে সুযোগ
দিতে পারিনি। ফলে মৃত্যুর আগে কারোর সাথে আর দেখা হয়নি এবং মৃত্যুর পর তাদের ধর্মীয়
অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়নি। মূলত আমার দুর্ঘটনার পর বাবা, মা দু’জনই মানসিকভাবে
খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। ফলে অতিরিক্ত মানসিক দুঃচিন্তাই ছিল তাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
আসলে পার্টির কাজ করতে গিয়ে পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয় স্বজনের সকল বন্ধন ছিন্ন করে পার্টির
দায়িত্ব ও কাজকে প্রাধান্য দিতে হয়। ব্যক্তিগত কাজের চাইতে পার্টির কাজকে আগে গুরুত্ব
দিতে হয়।
ঢাকায় থাকাকালীনই পার্টির
৭ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পার্টির লক্ষীছড়ি ইউনিট কর্তৃক আয়োজিত সমাবেশে অংশগ্রহণ
করতে লক্ষীছড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়। যদিও আমি লক্ষীছড়ি এলাকারই সন্তান কিন্তু এবারের লক্ষীছড়ি
যাওয়াটা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যেখানে এক বছর আগেও এলাকার জনগণ আমাকে একজন সুস্থ
স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে দেখেছে এবারে আমি যাচ্ছি একটি কৃত্রিম পায়ের উপর ভর দিয়ে খুড়িয়ে
খুড়িয়ে।
যাই হোক, পার্টির সিদ্ধান্ত
মোতাবেক সহযোদ্ধা রিকো সহ ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা
থেকে রওনা দিই। চট্টগ্রামে একদিন অবস্থান করার পর ২৫ ডিসেম্বর আমরা চট্টগ্রাম থেকে
একটি সিএনজি যোগে লক্ষীছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। অনেক আশঙ্কার পরও আমরা যথা সময়ে
লক্ষীছড়ি গিয়ে পৌঁছি। সেখানে পৌঁছে যারা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সফল করার লক্ষ্যে কাজ করছিলো
তাদেরকে খোঁজ নিতে আমরা পার্টি অফিসে যাই। সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে সার্বিক বিষয়ে খোঁজ
খবরা-খবর নেয়া হলো। এরপর আমরা যার যার স্থানে চলে গেলাম। পরদিন ২৬ ডিসেম্বর ৭ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে
লক্ষীছড়ি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে আয়োজিত সমাবেশ সফলভাবে সম্পন্ন করা গেলেও সেনাদের
মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেনারা আমাকে গ্রেফতারের জন্য নানা ষড়যন্ত্র চালায়। মোট কথা, পার্বত্য
চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর যে কর্তত্ব সেটা তারা যত্রতত্র ব্যবহার করে থাকে। জনগণের উপর খবরদারিত্ব বজায় রেখেই সেনারা তাদের
কর্তত্ব বজায় রাখতে চায়। সেনাবাহিনীর এই খবরদারিত্বের
মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। লক্ষীছড়িতে সেনাবাহিনীর তৎপরতা স্বচক্ষে দেখেই তা স্পষ্টভাবে বুঝা গেছে। পার্বত্য
চট্টগ্রামের নিপীড়িত জনগণের উপর সেনাবাহিনীর এ খবরদারিত্ব অচিরেই অবসান হওয়া দরকার।
সেনাদের নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত
সত্ত্বেও আমরা এক সপ্তাহ নাগাদ লক্ষীছড়িতে অবস্থান করি। এ সময় পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনের
সাথে সাক্ষাত হয় এবং এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত ও বিভিন্ন
বিষয়ে মতবিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল। তারা এলাকার নানা দুর্দশার কথা আমাদের সামনে তুলে
ধরেছিল। বিশেষত সেনাবাহিনী কর্তৃক কিভাবে জনগণ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সে বিষয়ে তারা
আমাদেরকে জানায়। আসলে লক্ষীছড়িতে এ নির্যাতন পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাপর অঞ্চলের নিপীড়ন-নির্যাতনের
ঘটনার কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শাসক চক্র পরিকল্পিতভাবে পাহাড়িদের ওপর এ নির্যাতন জারি
রেখেছে।
আমাদের প্রিয় পাবত্য চট্টগ্রামের
বুকে শাসক শোষকেরা যুগ যুগ ধরে যেভাবে পাহাড়ি জনগণকে নিপীড়িত নিষ্পেষিত করেছে তা একজন
অধিকার সচেতন মানুষের পক্ষে ভুলে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আমরা কাউখালী, পানছড়ি, লোগাং,
লংগদু, নান্যাচর সহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত ডজনের অধিক গণহত্যার কথা কখনো ভুলে
যেতে পারি না। এসব ঘটনা মনে করে আমাদেরকে আরো আন্দোলিত করে তোলে। আমরা ভুলে যেতে পারিনা
আমাদের সংগ্রামী নেত্রী কল্পনা চাকমার কথা।
যিনি অধিকারহারা মানুষের মুক্তি ও সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা ভুলে যেতে পারিনা
হাজার হাজার লোক সহায় সম্বল হারিয়ে শরনার্থী জীবন-যাপনের কথা। আমরা ভুলে যেতে পারিনা
গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের উপর নিপীড়ন নির্যাতনের কথা। আমরা কখনো ভুলে
যেতে পারি না আমাদের মা বোনের ইজ্জত লুন্ঠনের কথা। সুদুর অতীত থেকে আজ অবধি আমাদের
উপর নিপীড়ন নির্যাতনের কোন শেষ নেই। ব্রিটিশের পরে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশ
নামক ভূখন্ডে আমাদের উপর যে ধরণের বর্বর নির্যাতন
চালানো হয়েছে তা বর্ণনা করা যায় না। আজো থেমে নেই সেই নির্যাতনের স্টীম রোলার।
এসব নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে
জাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্য আমরা আবারো অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ
হয়েছি। সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামের মধ্যে
দিয়ে জাতিকে পরাধীনতার শৃংখল হতে মুক্ত করতে হবে।
নব অভিযাত্রী ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’
আদায়ের আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহ একদিন
না একদিন এসব নিপীড়ন-নির্যাতন, দুর্ভোগ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হবেই। মুক্তির এই শ্বাশ্বত
সুমহান আকাংখা আমাদের সারাক্ষণ বুকে লালন করতে হবে। পাহাড়ি জনগণের প্রাণের দাবি ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’
পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে সমস্ত রকমের লোভ-প্রলোভন,
মোহ ও ব্যক্তিগত স্বার্থকে দূরে ছুড়ে ফেলে আপোষহীনভাবে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
সকল ভেদাভেদ ভূলে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে মুক্তির লড়াইয়ে। না
হলে দুর্ভাগা জাতির মুক্তি অর্জন সম্ভব হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহারা
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে শপথে আমি পার্টি ও আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছি সে চেতনাকে
বুকে ধারণ করে পার্টি ও আন্দোলনের সাথে একিভূত ছিলাম, বর্তমানেও আছি এবং ভবিষ্যতেও
থাকবো, এই দৃঢ় প্রত্যাশা রাখছি। যতক্ষণ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহারা জনগণের
অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলতেই থাকবে। সত্য ও ন্যায়ের বিজয়
অনিবার্য।
-----
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন