- নিরন চাকমা
ভোরে ফুল তোলা, ফুল দিয়ে ঘর সাজানো, গৃহপালিত
পশুদের (গরু, ছাগল, মহিষ...) ফুলের মালা পরিয়ে সাজিয়ে দেওয়া, গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে
গাঙ/ছড়ার পাড়ে ফুল দেওয়া/ফুল নিবেদন করে নতুন দিনগুলোর সুখ-শান্তি কামনা করা (আজকাল
বুদ্ধমূর্তিতেও ফুল দিয়ে একই প্রার্থনা করা হয়) এরপর গোসল করে পরিশুদ্ধ হয়ে বাড়িতে
ফিরে আসা--এটাই হচ্ছে ফুল বিঝুর মাহাত্ম্য। এছাড়া বাড়িতে বা পাড়ায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকলে
ছড়া থেকে পানি নিয়ে এসে তাদেরকে গোসল করানো হতো। আর অনেকে ফুলবিঝুর দিনেই নানা রকম
শাক-সবজি/তরিতরকারি সংগ্রহে বনে-জঙ্গলে যেতেন (এখন তো সবকিছু কিনতে পাওয়া যায়) এবং
পরদিন অর্থাৎ মূল/মুর বিঝুতে পরিবেশনের জন্য সেসব সবজির মিশ্রণে পাজন রান্না করা হতো।ভাদজরা ফুল
তবে এখনকার মতো আগেকার দিনে এক সাথে মিলেমিশে
সেজেগুজে নদীতে/ছড়ায় ফুল দেওয়া/ফুল নিবেদন করা হতো না। তখন নদী/ছড়ার ঘাটে, কুয়াঘাটে
যার যার মতো ফুল দিয়ে প্রার্থনা করতেন। আর এতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন মায়েরা। শুধু
ফুল দেওয়া নয়, নদীতে ছোট্ট ঘর বানিয়ে এবং বটবৃক্ষের তলায় ফুল বিঝুর দিন থেকে ৭ দিন
পর্যন্ত সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো হতো, যার মাধ্যমে প্রকৃতির সাথে মানুষের যে নিবিড়
বন্ধন তা ফুটে ওঠে।
তবে ‘ফুল বিঝু’তে ফুল দিয়ে ঘর সাজানোটাই সবচেয়ে
আনন্দের কাজ। বাড়ির ছোটরা সকাল সকাল সুতা দিয়ে ফুলের মালা গেঁথে বাড়ির দরজায়, জানালায়
ফুলের মালা দিয়ে সাজাতো (এটা এখনো চালু রয়েছে)। আর এতেই উৎসবের আমেজটা টের পাওয়া যেতো
সহজেই।
বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছু জাঁকজমক
হয়েছে। সুন্দর পোশাকে সেজেগুজে নদীতে ফুল দিতে যাওয়া, ক্যামেরা বন্দি হওয়া, সেলফি তোলা—এসব
যেন এখনকার ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। আর এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি, ভিডিও, রিলস
আপলোডের জন্যও সেজেগুজে ফুল দিতে যায় অনেকে। সাংবাদিকরা হুড়মুড় খেয়ে পড়ে কে বেশি সুন্দর
সুন্দর ছবি তুলতে পারে, ভিডিও ধারণ করতে পারে সে প্রতিযোগিতায়। ফলে প্রকৃতঅর্থে ফুল
বিঝু’র যে একটা গম্ভীর্য ভাব ছিল সেটা বদলে গিয়ে কেবলমাত্র আনন্দ-স্ফুর্তিতে পরিণত
হয়েছে বলা যায়।
যাক, এ বিষয়ে সকলের যার যার মত থাকতে পারে।
আর এলাকা ভেদে অনুষ্ঠানের ধরণও ভিন্ন হতে পারে। আমরা ছোটকালে যা দেখেছি, যেভাবে দেখেছি,
এবং বর্তমানে যা দেখছি তা সংক্ষিপ্তভাবে এখানে তুলে ধরলাম মাত্র।
এটাও ঠিক যে, সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। পুরাতন
সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে নতুন সংস্কৃতি জায়গা করে নেয়। তবে রাজা দেবাশীষ রায় যেমন বলেছেন,
পুরোনো ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতি-নীতির মধ্যে যেগুলো জাতির জন্য ভালো সেগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে, আর যেগুলো খারাপ সেগুলোকে আমাদের
বাদ দিতে হবে।
নানা আলোচনার মাধ্যমে আমরা আমাদের ঐতিহ্য,
সংস্কৃতি সম্পর্কে নিশ্চয় আরো অনেক কিছু ধারণা লাভ করতে পারবো সেটাই আশা রাখি। ধন্যবাদ।
সবাইকে ফুল বিঝু ও বৈ-সা-বি
‘র (বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু...) শুভেচ্ছা।
১২.০৪.২০২৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন