শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১

বিয়ে বাড়িতে ফেলাজেয়্যার দেখা

মাঘ আসতে না আসতেই পাহাড়ে শীত বেশ জেঁকে বসেছে। আমাদের দেশে শীতকালটা অনেকটা নামি-দামী অতিথির মতো। দু'এক দিনের জন্য এসে চলে যায়। কিন্তু এই ক'দিনের আপ্যায়নের জন্য নিতে হয় কত প্রস্তুতি, করতে হয় নানা আয়োজন। শীত বস্ত্র কেনা, বছর আগে যত্নে রাখা পুরোন গরম কাপড়গুলো বের করে রোদে শুকিয়ে ঠিকঠাক রাখা, ঘর গরম রাখার জন্য আলজ্যা বানানো ইত্যাদি কত কিছু করতে হয়।

শীতে আরও একটা বিষয় চোখে পড়ে। সেটা হলো এ সময় বিয়ের ধুম পড়ে যায়। পাহাড়ে শীতকালটা বিয়ের মৌসুমও। কোথাও না কোথাও 'মেলা' (বিয়ে) লেগেই আছে।

এজন্য ইদানিং প্রায় সময় বিয়ের দাওয়াত আসছে। জুম্মরাও আজকাল বিয়ের কার্ড ছাপায়। অনুষ্ঠানও হয় জাঁকজমক। এসব অনুষ্ঠানে যেনNauveau riche দের আভিজাত্য প্রদর্শনীর প্রতিযোগীতা চলে। নুয়্য জামেই নুয়্য বোকে গিফ্‌ট দেয়ার রেওয়াজ প্রচলন হয়েছে বহু আগে। হিল্লো সমাজটা কি দ্রুত 'আধুনিক' হয়ে যাচ্ছে?

নানা ব্যস্ততার কারণে ওসব বিয়েতে প্রায়ই যাওয়া হয় না। তাছাড়া এসব 'আধুনিক' অনুষ্ঠানে মনে হয় যেন নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। অনেক সময় নিজেকে প্রশ্ন করি আমি কি ব্যাক ডেটেড হয়ে যাচ্ছি? নাকি আধুনিকতার নামে ওরা খারাপ কিছু আমদানী ও চালু করছে? তবে যেই হোক, আমি ওসব অনুষ্ঠানে গেলে একদম 'ধুরি আন্যা অঘলক' হয়ে যাই।

তাই এটা ওটা বলে, নানা ছলনা করে ওসব বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো আমি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা আমার অভ্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু সব চেষ্টা কি সফল হয়! কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত্রি হয়। এইবার এই বাঘের কবলে কীভাবে পড়েছি তারই গল্প আজ আপনাদের শোনাচ্ছি।

আমার স্কুল জীবনের বন্ধু গৌরব। তাকে সঙ্গীরা লেঙুরো বলে ডাকতাম। একেবারে পরাণে পরাণ বন্ধু। একসাথে কত খেলেছি, স্কুলে গেছি, নদীতে মাছ ধরেছি, আর কত কিছু করেছি, তার কি সবই মনে থাকে, নাকি অন্যকে বলা যায়! স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আমি দূরে চলে যাই; আর সে খাগড়াছড়ির একটি কলেজে ভর্তি হয়। তারপরও আমাদের মধ্যে বার দুএক দেখা সাত হয়েছে, চিঠিপত্রের আদান প্রদানও হয়েছে। এমনকি তার বিয়ে ও প্রথম কন্যার 'কোজোই পানি লনা'র অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থেকেছি। এমন বন্ধুর সাথেও যে একদিন অদেখার দীর্ঘ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তা তখনো বুঝতে পারিনি। মহা পরিনির্বাণের আগে মহামতি বুদ্ধ আনন্দকে বলেছিলেন, (বুদ্ধ পরিনির্বাণ গেলে তাকে আর দেখতে পাবেন না বলে আনন্দ কাঁদছিলেন) এক অযুত দুই অযুত কাল বেঁচে থাকলেও একদিন আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হবেই। এটাই জগতের নিয়ম। মিলন হলে বিচ্ছেদ অনিবার্য। জগতের নিয়েমেই আমাদেরও সেদিন বিচ্ছেদ হয়েছিল। কিন্তু বিধাতার কোন নিয়মে আজ আমাদের মধ্যে আবার দেখা হলো! জগত বিধাতা বড়ই বিচিত্র!

থাক দর্শনের কথা। কী বলতে কী বলে ফেলি! তো, আমার ছেলেবেলার বন্ধু গৌরব একদিন বলা নেই কওয়া নেই আমার কাছে এসে হাজির। আমি তো তাকে দেখে তাজ্জব। চিনতেই পারছিলাম না। কিভাবে আমার ঠিকানা পেয়েছে, কিভাবে এসেছে, আসতে কোন ঝামেলা হয়েছে কিনা ইত্যকার অহেতুক প্রশ্নবানে তাকে জর্জরিত করলাম। সে আমার গুচ্ছপ্রশ্নের উত্তরে কী যেন বললো এখন আর মনে নেই। এরপর আমি তাকে খোঁচা মেরে হেসে বললাম: 'তো কী জন্য তোমার বন্ধুকে এতদিনে মনে পড়লো? কোন ঠেকায় পড়েছো নাকি? নাকি আমাদের দলের কোন কর্মী তোমার বা তোমার কোন আত্মীয়ের ওপর খারাপ কিছু করেছে?' সে আমার একগাদা প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে হাতে একটা বড় সাইজের এনভেলপ ধরিয়ে দিলো। খামের ওপর ডান পাশে সুন্দর অরে আমার নাম লেখা। বাম পাশে উপরে আলপনার মাঝে আলতোভাবে আঁকা নারীমূর্তি, যেমনটা বিয়ের কার্ডে সচরাচর দেখা যায়।

আমি আরেক বার তাজ্জব বনে গিয়ে আচমকা বললাম: তোমার মেয়ে ধনবি এত বড় হয়েছে? সে জানালো, মেয়ে ও জামাইয়ের সম্মতিতে বিয়েটা হচ্ছে। জামাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে একটি এনজিওতে চাকুরী করে। তবে 'চাকুরী করে' না বলে ওই এনজিওটার মালিক বললেই যথার্থ হতো কিন্তু সেটা শোভন নয়। তার মেয়েও নাকি গ্রাজুয়েশনের পর একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজ করছে। আমার বন্ধু আরো জানালো যে, তার মেয়ে ধনবিও কলেজে পড়ার সময় প্রসিত খীসার দলের হিল উইমেন্স ফেডারেশন করতো, আর জামাই করতো সন্তু লারমার দল।

"আচ্ছা, খুব মজার তো" আমি বললাম। "তো কীভাবে বৈপরিত্যের ঐক্য হলো?" বিষ্ময়সমেত আমার প্রশ্ন। সে জানালো সে সব জানে না, কারণ এটা ছেলেমেয়েদের নিজস্ব বিষয়। বেশী উৎসুক্য প্রকাশ পেলে পাশে তাদের 'আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ' ও 'স্বাধীন ব্যক্তির সার্ভভৌমত্বকে' আন্ডারমাইন করছি বলে রব উঠে সে ভয়ে কান থাকলেও না থাকার, চোখ থাকলেও না দেখার ভাণ করতে হয়েছে। তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, বর্তমান যুগ ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ, গ্লোবালাইজেশনের যুগে আন্তঃব্যক্তিক ব্যাপারগুলো এখন খুবই সেনসিটিভ।

আমি পরে আমার নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা ছিঃআইএ মারফত আমাদের এই নব্য 'রাধামন - ধনপুদির' মিলনের যে ইতিহাস উদ্ধার করেছি তাতে আমি রীতিমত চমকিত হয়েছি। আসলে দুনিয়ায় যা আশা করা হয়, তা হয় না; যা আশা করা হয় না, তাই হয়। চুম্বকের বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। পদার্থ বিজ্ঞানের এই সূত্র প্রেম বিজ্ঞানেও যে মূর্ত হয়ে দেখা দিতে পারে সে কথা কষ্মিনকালেও ভাবিনি। ভাবলে অপদার্থবিদ উপাধি লাভ হতো তা নিশ্চিত। এমনকি বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংসএর বিগ ব্যাংগ থিওরী আবিস্কারের মতো 'স্মল ক্র্যাক' সূত্র আবিস্কার করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলে অপদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার মতো ছিল না। সে রকম ভাবতে পারি না বলে আমার কপালে কোন পুরস্কারই কোনদিন জুটলো না।

যাক, বন্ধুর কথায় ফিরে আসি। তার পীড়াপীড়িতে অগত্যা বিয়েতে যেতে রাজী হতে হলো। আমি পার্টির কাজ, ব্যক্তিগত অসুবিধা, ইত্যাদি একের পর অজুহাতের বাণ ছুঁড়ে আমন্ত্রণ ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু বন্ধুত্বের মধুর ভাষা আমার প্রতিরোধের সকল অস্ত্র নিস্তেজ করে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে আমি বললাম, আমি তো একা যেতে পারবো না। আমার সাথে আরো কয়েকজন যাবে। সে বললো, সে কি বলতে হয় নাকি? তোমাকে নিমন্ত্রণ করা মানেই তো একসাথে অনেক জনকে আমন্ত্রণ করা। এতো আমাদের বাড়তি পাওনা।

এক সপ্তাহ পর আমন্ত্রণ রা করার দিন উপস্থিত হলো। আমি নির্দিষ্ট সময়ে বিয়ে বাড়িতে গিয়ে হাজির। কিন্তু দেখি আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে আমিই (আমার লোকজনসহ) প্রথম 'আসামী হাজির'। মনে মনে বললাম স্কুল কলেজে পরীায় তো জীবনে কোন দিন প্রথম হতে পারিনি, আজ বিয়ের দাওয়াত রায় প্রথম হলাম, এটাও বা কম কিসে। তারপরও আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকলাম। আজকাল কোন আলোচনা সভা, মিটিঙ বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে দেরীতে উপস্থিত হওয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সময় জ্ঞান আমাদের দিন দিন লোপ পাচ্ছে। পাঁচটায় মিটিঙের সময় দেয়া হলে লোকজন আসতে শুরু করে ৬টা থেকে। তারপর অনুষ্ঠন শুরু করতে বেজে যায় ৭টা। এর পরও আমন্ত্রিতদের সবাই উপস্থিত হয় না। যারা দেরীতে আসে তারাই সবচেয়ে ব্যস্ত এবং যারা সবচেয়ে ব্যস্ত তারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তথা ভিআইপি, ভেরী ইম্পর্ট্যান্ট পারসন, অথবা তারও উপরে ভিভিআইপি বা ভেরী ভেরী ইম্পর্ট্যান্ট পারসন - এ রকম একটা ধারণা আমাদের মধ্যে অবচেতনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে যারা নির্দিষ্ট সময়ে মিটিঙে হাজির হয় তারা সাধারণ লোক, আম জনতা। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে ঠিকমত কাজ চলবে কীভাবে? আমাদের পশ্চাদপদতার জন্য যেসব কারণ দায়ি তার মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব হলো একটি।

কিছুক্ষণ পর একে একে আসতে শুরু করলো এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যে পুরো বিয়ে বাড়ি উঠোনসহ লোকজনে ভরে গেলো। চেনা অচেনা অনেকের সাথে দেখা হলো এবং এক পর্যায়ে আলাপ জমে উঠলো। প্রথমে পারিবারিক কুশলাদি থেকে শুরু হয়ে আবহাওয়া, কৃষি, তারপর কে কোথায় চাকরী পেলো ইত্যাদি এটা ওটা আলোচনা শেষে চিরাচরিত বিষয় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে এসে বিতর্ক জমে উঠলো।

চাকুরীর কথা যখন উঠলো তখন কান টানলে মাথা আসে সূত্র অনুযায়ী জেলা পরিষদের দুর্নীতির প্রসঙ্গও আসলো। অনেকে জেলা পরিষদের বিষয়ে এন্তার অভিযোগ তুলে ধরলো, তারপর ক্ষোভ প্রকাশ করলো। একজন বললো, 'চাকুরী না হয় না দেবে, কিন্তু টাকাগুলো নিলো কেন? কত কষ্ট করে বেচাররা ওই টাকা জোগাড় করেছে।'

আরেকজন বললো, 'চাকুরীগুলো তো কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আগেভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ কারণে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য মন্ত্রী জেলা পরিষদের দুর্নীতির বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করে না।'

'তিন ইউপিডিএফ নেতার স্ত্রীও নাকি জেলা পরিষদের চাকুরী পেয়েছে।' এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মনে করে একজন সবাইকে জানালো।

আড্ডায় শিক্ষা বিভাগে চাকুরী করেন এমন একজন, কংজাই মারমা উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, 'জেলা পরিষদের লোকজন যথেষ্ট চালাক। তারা জানে কাকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয়। আমার ধারণা ইউপিডিএফের মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্যই ওই তিনটা পদ তাদেরকে দেয়া হয়েছে। ইউপিডিএফ নেতাদের ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।'

ইউপিডিএফের কথা উঠতেই একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলো সন্তু গ্রুপের প্রতি যে ঐক্য-সমঝোতার আহ্বান দিয়েছি তাতে আমরা কতটুকু আন্তরিক। আমি তাকে বললাম যে আমাদের ওই প্রস্তাব নতুন নয়, ২০০০ সাল থেকে আমরা ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে আসছি। সমঝোতার জন্য প্রয়াত উপেন্দ্র লাল চাকমাসহ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রচেষ্টা, অন্য অনেকের মধ্যস্থতার প্রস্তাব, কোথায় কখন কতবার জেএসএসের সাথে বৈঠক হয়েছে ও সে সব বৈঠকের ফলাফল কি হয়েছে, জেএসএস কিভাবে সমঝোতা চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে ইত্যাদির বিবরণ দিয়ে তাকে বললাম, 'সুতরাং সন্তু গ্রুপ যে ঐক্য-আলোচনায় আসছে না তার কারণ ভিন্ন কিছু হতে পারে।'

ঢাকায় একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেন সঞ্জিত ত্রিপুরা। তিনিও বিয়ে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। এতণ তিনি আমাদের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আমার কথার পর তিনি বললেন, 'আমি একটু ফোর নিতে চাই। সংঘাত যেভাবে শুরু হোক, ইউপিডিএফকে অন্তত এ জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে যে তারা বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যের প্রস্তাব দিয়েছে। তাছাড়া জেএসএস ইতিপূর্বে দুই তিন বার সমঝোতার শর্ত লঙ্ঘন করার পরও ইউপিডিএফ নেতারা ঐক্যের প্রস্তাব দিচ্ছেন। তাদের শক্তিও আগের চাইতে বেড়েছে। কাজেই তারা দুর্বল অবস্থানে থেকে নয়, বরং তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ও ভালো অবস্থানে থেকে এই প্রস্তাব দিচ্ছেন। তাই এখানে আন্তরিকতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা নিতান্তই অবান্তর।'

নাতিদীর্ঘ একটা লেকচার দেয়ার পর তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন ইউপিডিএফ এখন কী করবে। আমি তার উত্তর দিতে যাচ্ছি এমন সময় একটি বেসরকারী কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক ঝিমিত দেওয়ান গুরু গম্ভীর কণ্ঠে বললো: আসলে সবকিছু নির্ভর করে শর্তের উপর। বর্তমানে যে fratricidal conflict চলছে তার কারণ চুক্তির পর এই সংঘাতের শর্ত তৈরি হয়েছে। যখনই এই শর্তগুলো ধীরে ধীরে লোপ পাবে বা নতুন শর্ত এই বর্তমান শর্তগুলোকে অপসারণ করবে তখনই সংঘাত বন্ধ হবে। নতুন শর্তের মধ্যে ধরতে পারেন ইউপিডিএফের ঐক্যের প্রস্তাব, সংঘাত বন্ধের পে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেবল এই দু'টি শর্ত সংঘাত বন্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। আরও কিছু সাবজেক্টিভ শর্ত সৃষ্টি করতে হবে আমাদের।"

এ সময় একজন তাকে প্রশ্ন করলো, আপনার মতে আর কী ধরনের শর্ত দরকার সংঘাত বন্ধের জন্য, আর সেই শর্তগুলো কীভাবে আমরা সৃষ্টি করতে পারি?

সরাসরি উত্তর না দিয়ে অধ্যাপক সাহেব বললেন: আপনারা হয়তো অনেকে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের আত্মজীবনীমূলক বই A Journey পড়ে থাকতে পারেন। এই বইয়ে তিনি নর্দান আয়ারল্যান্ডের শান্তি আলোচনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এবং ১০টি central principles of resolution-এর কথা বলেছেন। ৫ নং নীতিতে তিনি বলেছেন “The conflict won’t be resolved by the parties if left to themselves. If it were possible for them to resolve it on their own, they would have done so. Ergo, they need outside help.”

"এই মধ্যস্থতাকারী বা তৃতীয় প বা তার ভাষায় বহিঃপ এর কী ভূমিকা হওয়া উচিত সে সম্পর্কে টনি ব্লেয়ার সাহেব যা বলেছেন তা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘The point is the outside party do not just help negotiate and mediate: they act as a buffer, a messenger and, crucially, as a persuader of good faith in a climate usually dominated by distrust. They also help define issues and indeed turning points.’

অধ্যাপকের কথা সবাই হা করে শুনছিল। তিনি এতটুক বলার পর থেমে গেলেন, অন্যরাও চুপ করে রইলেন। কি বলবেন কেউ ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন: "যারা ইউপিডিএফ-জেএসএস এর চলমান conflict কীভাবে মীমাংসা করা যায় সে সম্পর্কে ভাবেন তারা টনি ব্লেয়ারের এই কথাগুলো থেকে কিছুটা হলেও কিউ পেতে পারেন। তবে সাকসেসের গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো না। কারণ টনি ব্লেয়ার নিজে উত্তর আয়ারল্যান্ডে চুক্তি করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারলেও আরব-ইসরায়েল শান্তি আলোচনায় ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি আরবদের আস্থা হারিয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি honest broker নন এবং ইসরেয়েলীদের প্রতি তার পক্ষপাত রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আরো নানা কিসিমের অভিযোগও শোনা যায়। আমি নিজেও টনি ব্লেয়ারের রাজনৈতিক দর্শন ও বিভিন্ন পলিসির সাথে মোটেই একমত নই। তবে তার পয়েন্টগুলো গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই।"

অধ্যাপকের কথা শেষ হলে অন্দর মহল নাকি কোথা থেকে একজন এসে হঠাৎ তাকে নমস্কার দিয়ে বললো: 'স্যার, আমার নাম চুচ্যাঙ্যা। আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না। আমি এক সময় জেএসএস করতাম। এখন দল ছেড়ে দিয়ে টুকটাক এটা ওটা করে সংসার চালাচ্ছি। আমি আপনার কথা বেড়ার ওপাশ থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম।'

অধ্যাপক বললেন 'আপনাকে না চিনলেও আপনার নাম চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনি ব্লগার নাকি, ফেইসবুকে লেখেন?'

চুচ্যাঙ্যা বললেন, "না স্যার, আমি একজন সাধারণ পাবলিক। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জানি না। তবে কয়েকদিন আগে আমার বন্ধু অডংকে আমার কিছু প্রশ্ন ইন্টারনেটে ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। ইউপিডিএফের কাছে এই প্রশ্নগুলো রেখেছিলাম। চমক দেয়ার জন্য অডংকে ফেলাজিয়া নামে ফোন করেছিলাম, এখন সে এই নামটাই ইন্টারনেটে চালু করে দিয়েছে।'

তার কথা শুনে আমি বললাম 'ও, তাহলে আপনি সেই ফেলাজেয়া বাবু? হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আপনার প্রশ্নগুলো দেখেছি।'

অধ্যাপক চুচ্যাঙ্যা ওরফে ফেলাজেয়্যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'যাকে আপনি প্রশ্ন করেছেন তিনি নিজেই আপনার সামনে বসে আছেন।' আমার দিকে আঙুল তাক করে তিনি বললেন, 'এই যে ইনিই হলেন নিরন বাবু, ইউপিডিএফের বি-বি-খ্যাত নেতা। তার মুখ থেকেই সরাসরি আপনার প্রশ্নের জবাব জেনে নিন।'

'অধ্যাপক সাহেব এটা কি একটু বেশী বাড়াবাড়ি হলো না? আমি কখন বিখ্যাত নেতা হলাম, আমি নিজেকে একজন অতি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী মনে করি।' তারপর চুচ্যাঙ্যাকে ল্য করে বললাম, 'সব কিছু তো ইন্টারনেটে ফেইসবুকে বলা যায় না। আপনি একদিন আমাদের অফিসে আসেন না কেন, এসব বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ করা যাবে।'

'ঠিক আছে, তাই হবে।' চুচ্যাঙ্যা বাবু জানালেন।

সঞ্জিত অনেকণ ধরে আলোচনা শুনছিলেন। ইন্টারনেটের কথা উঠতেই তার মনের ভাব প্রকাশ না করে থাকতে পারলেন না: 'আমিও সিএইচটিবিডির বিতর্কগুলো পড়েছি। তবে আমার কেন জানি মনে হয় ওখানে আঙুল ঢুকে পড়েছে। বিশেষত আমার দু'একজনকে খুবই সন্দেহ হয়।'

এদিকে আলোচনার ফাঁকে সময়বাবু যে অনেকদূর চলে গেছে সেদিকে কেউ খেয়াল করেনি। ক্ষিদে নামক রাসটাও অনেকের পেটে গোঙানি শুরু করে দিয়েছে। অবশেষে বিয়ে বাড়ির প্রধান গৌরব নিজে এসে খানা রেডি হওয়ার সংবাদ দিলেন। আমরাও তাড়াতাড়ি আসনে বসে গেলাম।

গৌরব ঘুরে ঘুরে 'লারে গুরি হিয়্য' বলে আমাদের লভিয়ত (আপ্যায়ন) করলেন, আর আপে করে বলতে লাগলেন, 'এখন মেলা মেঝবানে পুজ্জুনী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যুবক যুবতীরা লখাপড়া অথবা ঢাকা-চট্টগ্রামে মিল কারখানায় চাকুরীতে ব্যস্ত।'

খাওয়ার পর চুচ্যাঙ্যা বাবুর সাথে আলোচনার দিন তারিখ ঠিক করে নতুন বউকে আশির্বাদ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে আসলাম।
নির্দিষ্ট দিনে চুচ্যাঙ্যা বাবু তার এক বন্ধুকে নিয়ে আমাদের পার্টি অফিসে হাজির হলেন। তাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। তিনি তার গেরিলা জীবনের রোমাঞ্চকর কথা শোনালেন। বললেন তিনি বহু আশা নিয়ে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মনে প্রাণে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। প্রসিত খীসার নেতৃত্বে বাইরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হওয়ায় তিনি ও তার কমরেডরা অত্যন্ত খুশী ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দ্বিগুণ উসাহ নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি বললেন, "আমরা তো জানতাম ভেতরে বাইরে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কাজ হচ্ছে। কিন্তু একদিন হঠা আমাদের কাছে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসে প্রসিতসহ ৫ জনকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে গ্রেফতার করতে হবে। আমরা যারপর নাই হতবাক হয়েছি। কিন্তু উপরের নির্দেশ কোন প্রশ্ন করা যাবে না।"

তিনি আক্ষেপ করে আরো বললেন যে, চুক্তি সম্পর্কে তাদেরকে কোন ধারণা দেয়া হয়নি, মতামত নেয়া তো দূরের কথা। কেবল বলা হয়েছে অস্ত্র জমা দিতে হবে।

দুঃখ করে বললেন, 'যাই হোক, চুক্তি হলো, যা পাওয়া গেছে তাই সদ্ব্যবহার করে জনগণের স্বার্থে কাজ করা হবে এই ছিল আমাদের আশা। কিন্তু তাও হলো না। জেলা পরিষদের নেতৃত্বের যে হাল, আমাদের নেতৃত্বেরও তাই হলো।'

আমাদের কথা ঘুরে ফিরে ওই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে এসে পড়লো বার বার। তিনি রাক ঢাক না করে তার হতাশার কথা ব্যক্ত করলেন। জুম্ম জাতির সেরারাই এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে আফসোস করলেন। আমি বললাম একজন সংগ্রামী বিপ্লবীর হতাশ হওয়া সাজে না। শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই হলো তার কাজ। আপনার এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ঠিক হয়নি।

তিনি বললেন 'আমি তো একজন সামান্য মানুষ। আমি কী করতে পারি।"

আমরা সামান্য হতে পারি, কিন্তু কেউ ফেলাজেয়্যা নই। আপনিও অনেক কিছু করতে পারেন।

যেমন?

আমি নাতিদীর্ঘ একটা বক্তব্য দিতে শুরু করলাম: 'আপনি যেহেতু ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত নিয়ে চিন্তিত, এটা বন্ধের জন্য আপনি কাজে লেগে যেতে পারেন। প্রত্যেকের এটা করা উচিত। এটা একটা দায়িত্ব। পাড়ায় কারো বাড়িতে আগুন লাগলে আমরা কী করি? আমরা গ্রামের সবাই সেই আগুন নেভানোর জন্য যার যার সাধ্যমত চেষ্টা করি। কারণ প্রথমত এটা একটা সামাজিক দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত তার সেই আগুনে আশে পাশের অনেকের বাড়িও পুড়ে যেতে পারে। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের যে আগুন এখন জ্বলছে সেটাও নেভানোর দায়িত্ব আছে আমাদের। কিন্তু আমরা কী সে দায়িত্ব পালন করছি? নিজো হিয়াত গরম ন ফুদিলে আমি জুরো থেই। নিজো হিয়াত পল্লে থে আমার দুনিয়া আন্ধার অয়। কিন্তু নিজের গায়ে পড়ার আগে আমাদের খবর থাকে না।'

তিনি ও তার বন্ধু আমার কথায় সায় দিলেন। তার বন্ধু বললেন আমিও তো বলি আমাদের কিছু একটা করা উচিত। আমরা আমাদের ছেলেদের এভাবে মরতে দিতে পারি না।

আমি বিয়ের বাড়িতে অধ্যাপকের বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, 'কোন সমস্যা যতই কঠিন হোক (অধ্যাপক ইংরেজীতে intractable শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন) বার বার চেষ্টা করলে তার সমাধান পাওয়া যায়। অনবরত বারিবিন্দু পড়ে পাথর পর্যন্ত ক্ষয় হয়ে যায়।'

তার বন্ধু বললেন, 'আমাদের সমস্যার সমস্যা হলো আমরা জুম্মরা কোন কাজে বিনি আদা করে লেগে থাকতে পারে না। অথচ লেগে থাকতে না পারলে কোন কিছুতে ফল পাওয়া যায় না।'

এরপর আমি অডং বাবুর মাধ্যমে চুচ্যাঙ্যা বাবু যে প্রশ্ন রেখেছিলেন সে প্রসঙ্গে চলে আসলাম; বললাম চুক্তি বাস্তবায়নে ইউপিডিএফের সহযোগিতার ধরণ কী হবে সেটা নেগোশিয়েশনের বিষয়। সব কিছু আগাম বলা ঠিক নয় আর সব জায়গায় সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমি তাকে একজন সংগঠন করা লোক ও একজন সাধারণ লোকের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্যের কথা তুলে ধরলাম। তার পর ইউপিডিএফ কেন গঠন হলো, কী ধরনের কঠিন কঠোর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে ও এখনো হচ্ছে, পার্টি কী চায়, আন্দোলনের ধরণ কী হতে পারে, এতে কার কী ভূমিকা থাকা উচিত এ সব ব্যাপারে সংক্ষেপে বললাম।

তিনি বললেন, 'আসলে আমার বোকামি হয়েছে। সংগঠন থেকে দূরে থাকায় আমার চিন্তা চেতনাও যেন লোপ পেতে বসেছে। নামটা আমার চুচ্যাঙ্যা হলেও দিন দিন ভুত্যাং হয়ে যাচ্ছি।' শেষ বাক্যটি বলে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন।

এরপর তিনি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন বলে অঙ্গীকার করলেন। নতুন করে আন্দোলন শুরু করার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। বিদায় নেয়ার আগে বললেন আমার সাথে আলাপ করে তার ভালো লেগেছে এবং মাঝে মধ্যে এভাবে আলোচনা করার জন্য অফিসে আসলে আমি বিরক্ত হবো কীনা জিজ্ঞেস করলেন।

'মোটেই না। বিরক্ত হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আমাদের অনেক কাজের মধ্যে একটি হলো জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের, জিজ্ঞাসার জবাব মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা।

আমার সাথে হ্যান্ডচেক করে তারা দু'জনে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোলেন। আমি বললাম, 'আপনার বন্ধু অডং বাবুকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন এবং বলবেন তিনি যেন তার ফেইসবুকে লেখালেখিটা চালু রাখেন।'

'আচ্ছা বলে দেবো' বলে তারা চলে গেলেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন