বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১

কিরণ বাবুর ‘কিছু অজানা কথা’ প্রসঙ্গে

কিরণ বাবুর লেখাটি পড়লাম। তিনি ৯৬ সালের নির্বাচনে কার কি ভূমিকা সে সম্পর্কে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। এ সম্পর্কে আমার জানা কিছু তথ্য তুলে ধরছি। পুরো বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য আগে ৯১ সালের নির্বাচনের ওপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেশে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বহু বছর পর নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা থেকেও প্রার্থী দেয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তখন পিসিপির সভাপতি ছিলেন বিশ্বজি চাকমা (গুল)। পাহাড়ি গণপরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন বিজয় কেতন চাকমা। দীপংকর তালুকদার রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে কানাডায় পাড়ি জমানোর পথে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সুযোগ বুঝে তিনি কলকাতা থেকে দ্রুত ঢাকা চলে আসেন এবং আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি এ জন্য যে কৌশলের আশ্রয় নেন তার তারিফ করতে হয়। তার পে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সরকারের সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারী শরদিন্দু শেখর চাকমা। যতদূর জানা যায় ঢাকায় প্রদানেন্দু বাবুর বাসায় নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে ঢাকাস্থ জুম্ম মুরুব্বীদের একটি মিটিঙের আয়োজন করা হয়। সেই মিটিঙে বিজয় কেতন বাবুকেও রাখা হয় কৌশল হিসেবে। মিটিঙে দীপংকর তালুকদারের প্রার্থীতা সমর্থন করে লিখিতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিজয় কেতন বাবু অনেকটা সৌজন্যতার খাতিরে সেই সিদ্ধান্তে স্বার করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে বিশ্বজি চাকমা ওই মিটিঙে উপস্থিত না থাকলেও পিসিপির সভাপতি হিসেবে তার স্বাক্ষর অন্য একজন দিয়ে দেন, তার কোন সম্মতি না নিয়ে। এরপর দীপংকর তালুকদার মিটিঙের রিজ্যুলেশন নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যান এবং তার মনোনয়ন নিশ্চিত করেন।

৯১ সালের নির্বাচনে জেএসএসের ভূমিকাও স্পষ্ট ছিল না। এ সময় থেকে জেএসএস নেতৃত্ব লেজুরবাদী ও আত্মসমর্পনবাদী লাইন গ্রহণ করেছিল। তারা 'তৃতীয় পক্ষের' মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে চেয়েছিল। এজন্য ঢাকায় শেখ হাসিনার কাছে চিঠিসহ একজন প্রতিনিধিকেও পাঠিয়েছিল। কিন্তু হাসিনা তার সাথে দেখা করেননি। পরে সমঝোতা ছাড়াই জেএসএস আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থন দেয়।

৯৬ সালের নির্বাচনে পিসিপি দীপংকর তালুকদারকে সমর্থন দিয়েছিল এ তথ্য সঠিক নয়। আমার জানা মতে জেএসএসও প্রথম দিকে তাকে সমর্থন দেয়নি। এই নির্বাচন যখন হয় তখন প্রসিত খীসা পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পাহাড়ি গণ পরিষদের হাল ধরেন। পিসিপি-পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ চেয়েছিল কোন দলের না হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়া হোক। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের প্রশ্নে কোন পার্টিরই সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল না (এখনো নেই)। আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালে পাহাড়িদের বাঙালি বানিয়েছিল। বাঙালি ঢুকিয়ে দিয়ে জুম্মদেরকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকী দিয়েছিল। এ কারণে জেএসএসকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি চার লক্ষ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করে, একের পর এক গণহত্যা চালায়, পার্বত্য চট্টগ্রামকে শ্মশান বানিয়ে দেয়। তাই এ দলগুলোকে নির্বাচনে সমর্থন দেয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু জেএসএস বাইরে এত বছর ধরে আন্দোলনরত তিন সংগঠন বা অন্য কারোর মতামত না নিয়ে মনগড়াভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্তু লারমা আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরের সাথে এ বিষয়ে একটি অলিখিত চুক্তি করে ফেলেন। (খেয়াল করবেন আওয়ামী লীগের সাথে অলিখিত চুক্তি করার অভ্যাস তখন থেকেই শুরু) তাদের দু'জনের বৈঠকে দূতিয়ালী হিসেবে কাজ করেন এডভোকেট শক্তিমান চাকমা। বৈঠকটি হয় ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোন এক জঙ্গলাকীর্ণ আস্তানায়। সেখানে যে সিদ্ধান্ত হয় তা হলো এই -- জেএসএস তিন জেলার প্রার্থীদের নাম দেবে। আওয়ামী লীগ তাদেরকে দলীয় মনোনয়ন দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই অলিখিত চুক্তির সম্পূর্ণ বরখেলাপ করে তার পছন্দমত প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়। ফলে জেএসএস তখন চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। মাঝ দরিয়ায় নৌকাডুবির মতো অবস্থা। এ কুলেও ফিরতে পারছে না, ওকুলেও পার হতে পারছে না। শেষ বেলায় কি করবে কোন উপায় না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে খাগড়াছড়িতে হংস ধ্বজ বাবুকে ও রাঙামাটিতে বিজয় কেতন বাবুকে সমর্থন দেয়। তবে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে জেএসএস কর্মীরা যার যার মত কাজ করে। কেউ সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগকে, আর কেউ প্রচারণা চালায় বিজয় কেতন বাবুর পক্ষে। জনগণ চরমভাবে বিভ্রান্ত হয়। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের মধ্যে যে এত আওয়ামী লীগ প্রীতি তা তো এক দিনে হয়নি। এই ক্ষেত্র তো জেএসএসই তৈরি করে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার জন্য লোকজনের ওপর জোর জবরদস্তি করা হয়েছিল। অথচ ১৯৭০, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রামে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। প্রধানত জেএসএস নেতৃত্বের ভুলের কারণেই আওয়ামী লীগ হিলে শিকড় গাড়তে পেরেছে।

দুই বা ততোধিক পার্টির মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য বা অন্য কোন বিষয়ে সমঝোতা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কৌশলগত ঐক্য আর সুবিধাবাদী ঐক্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগের সাথেও ক্ষেত্র বিশেষে ঐক্য হতে পারে বৈকি। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের জন্য যেভাবে জেএসএস আওয়ামী লীগের সাথে মৌখিক বা অলিখিত চুক্তি করেছে তা সুবিধাবাদী ঐক্য এবং চুক্তির ধরণটাও ঠিক ছিল না। ইউপিডিএফের বর্তমান নেতৃবৃন্দ সে সময় জেএসএস নেতৃত্বকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বার বার সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জেএসএস তাতে কণামাত্র কর্ণপাত করেনি। আওয়ামী লীগ যে কত ধূর্ত তা তারা সে সময় বুঝতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ওবায়দুল কাদেরকে সন্তু বাবুর সাথে দেখা করতে জঙ্গলে পাঠিয়েছিলেন, কারণ তখন তাদের প্রয়োজন ছিল। কারণ তখন জেএসএসের জনসমর্থন ছিল এবং সেই জনসমর্থন আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে কাজে লাগানোর দরকার ছিল। অথচ ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জেএসএসকে ফিরেও তাকায়নি। সন্তু বাবু এই দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালান। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা সন্তু বাবুকে সাক্ষাত পর্যন্ত দেননি। তাই অবশেষে ২০০১ সালে তিনি বিএনপি নেতা মান্নান ভূঁইয়ার সাথে দেখা করে বিএনপি প্রার্থীদের সমর্থন দেন। অবশ্য বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও জেএসএস প্রকাশ্যে নির্বাচন বানচালের হুমকী দিয়ে ইউপিডিএফ সমর্থিত এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনে হাসিনার সাত না পেয়ে শেষ বেলায় সন্তু লারমা রাঙামাটি ও বান্দরবানে তার দলের প্রার্থী দাঁড় করান।

কাজেই দেখা যায়, জেএসএস নেতৃত্বের ভুল নীতি, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা, সুবিধাবাদিতা, আত্মসমর্পনবাদী-পরাজয়বাদী লাইন ও পরাশ্রয়বাদী মানসিতার কারণে নির্বাচনে বার বার ভরাডুবি হয়েছে। ১৯৯১ ও ৯৬ সালের নির্বাচনের ভুলের মাশুল এখনো পর্যন্ত জেএসএস ও ইউপিডিএফ উভয় পার্টিকে দিতে হচ্ছে।

উপরের আলোচনা থেকে বিষয়টি কতটুকু স্পষ্ট করতে পেরেছি জানিনা, তবে যতদূর সম্ভব নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

উক্ত ঘটনাগুলোর সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তারা আলোচনায় অংশ নিলে আরো বেশী ভালো হয়। কারণ সামনে যাওয়ার জন্য অনেক সময় পেছনে যেতে হয়। আমাদেরকে অতীত কাজের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন