সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১১

ফেসবুকে আলোচনা-১

প্রিয় অডঙ, অমিত হিল ও অন্য বন্ধুরা,
"ভ্রাতৃঘাতীসংঘাত বন্ধে প্রসতি খীসার স্পষ্ট অঙ্গীকার শুনতে চাই" শিরোনামে ১১ ডিসেম্বর ফেসবুকে লেখা অডঙ চাকমার ও "শ্রদ্ধেয় স্যার প্রসতি বিকাশ খীসাকে এক খোলাচিঠি" শিরোনামে একই তারিখে লেখা অমিত হিলের লেখা আমাদের নজরে এসেছে। এছাড়া এ সম্পর্কিত অনেকের মন্তব্যও চোখে পড়েছে। লেখার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

যদিও লেখাগুলো প্রসিতদাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে, তবুও তার পক্ষ হয়ে আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছি। কারণ প্রসিতদা ফেইসবুক ব্যবহার করেন না। তবে তিনি তার ইন্টারভিউ সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং সরাসরি আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

অমিত হিল ও অডঙ ফেসবুকে নিয়মিত লেখেন, সে কারণে আপনারা পরিচিত মুখ, সরি, পরিচিত নাম বা আইডি। ইতিপূর্বেও আপনাদের সাথে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বিষয়ে আমার আলোচনা হয়েছে। সুতরাং আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের পার্টির অবস্থান আপনাদের জানা আছে। তাই নতুন করে সেটা ব্যাখ্যা করা অনেকটা চর্বিত চরণের মতো হবে। তারপরও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আমি আমাদের সাধারণ পার্টি লাইন অনুসরণ করে আপনাদের মন্তব্য, প্রশ্ন ও বক্তব্যের জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি। আমার বক্তব্য দীর্ঘ হবে, তাই ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ করছি।

(১)অডঙ বাবু ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধের জন্যে প্রসিতদার মুখ থেকে "প্যাঁচালো" (তার ভাষায়) কথা নয়, স্পষ্ট "অঙ্গীকার" শুনতে চেয়েছেন। খুব ভালো কথা। তবে প্যাঁচালো কথার চেয়ে অঙ্গীকার কি খুব বেশী উত্তম? যখন অনেক রাজনৈতিক ও নেতা মুহূর্তে অঙ্গীকার করে তা পর মুহূর্তেই ভেঙে ফেলেন? ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য ইউপিডিএফ অঙ্গীকারের চাইতেও অনেক বেশী করেছে ও এখনো করছে। সেটা হলো বাস্তব কাজ। যদি চোখ, কান খোলা রাখেন তাহলে এ বাস্তব কাজ সম্পর্কে জানতে পারবেন। সবকিছু খোলাসা করে বলার স্থান এটা নয়। দুঃখিত।

(২)"কুসুম প্রিয় চাকমা ও প্রদীপ লাল চাকমাদরে জেএসএস জঘন্যভাবে খুন করছিলো বলে ইউপডিএফকেও সেভাবে জঘন্য খুনরে নশোয় মেতে উঠতে হবে সেটা মেনে নিতে পারি না। খুনের বদলে ‍খুন এটা সুস্থ রাজনীতি হতে পারে না।"

আপনার সাথে এ ব্যাপারে আগেও বিতর্ক হয়েছে। নতুন করে এ প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু বলার নেই। তবুও একটা গল্প বলি। আমাদের এক ইউপিডিএফ নেতার সাথে এক বিদেশী শুভাকাঙ্খীর কথা হচ্ছিল। তখন ইউপিডিএফ-জেএসএসের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে (অবশ্য লড়াই বললে ভুল হবে, ইউপিডিএফ একের পর এক মার খাচ্ছিল, জেএসএসের আক্রমণে মারা যাচ্ছিল আর ইউপিডিএফ প্রতিরার চেষ্টা করছিল।) আলোচনার বিষয়বস্তুও ছিল ওই ভ্রাতৃঘাতি হানাহানি।ওই বিদেশী ইউপিডিএফ নেতাকে বলছিলেন 'আপনাদের উচিত পালিয়ে গিয়ে হলেও মারামারিটা এড়ানো।' ইউপিডিএফ নেতা সংঘাত শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপট, বাস্তব পরিস্থিতি, সংঘাত বন্ধের জন্য বারংবার চেষ্টা ইত্যাদি সম্পর্কে বলার পরও উক্ত বিদেশীর মনে তখনো সংশয় রয়ে গেছে দেখে তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন: ধরুন, আপনি একজনকে তার ভুলের জন্য সমালোচনা করলেন। কিন্তু তিনি আপনার সমালোচনার জবাব না দিয়ে আপনার গায়ে হাত তুললেন। আপনি মারামারি এড়ানোর জন্য দৌঁড় দিয়ে পালাতে থাকলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তিও আপনার পিছু পিছু দৌঁড় দিয়ে আপনাকে ধরে মারতে থাকলো। তখন আপনি কী করবেন?

এর জবাবে উক্ত বিদেশী শুভাকাঙ্খী স্পষ্টভাবে বললেন, I’ll fight back. অর্থাৎ আমি প্রতিরোধ করবো। তখন ইউপিডিএফ নেতা বললেন, ‘That’s what we’re doing." আসলে কোন ঘটনার প্রেক্ষিত বা পূর্ব অবস্থা জানা না থাকলে বিষয়গুলো ঠিকভাবে বোঝা কঠিন। অডং এর ক্ষেত্রেও এটাই হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

বর্তমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের প্রেক্ষিতটাও আমাদের ভালোভাবে জানা থাকা দরকার। প্রেক্ষিতটা আমি বহু আগের ঘটনা উল্লেখ করে শুরু করতে পারি। তবে সেটা দীর্ঘ হবে। তাই মোটা দাগে তুলে ধরছি: চুক্তি সই হয়েছে। ইউপিডিএফ সমালোচনা বা প্রত্যাখ্যান যাই বলেন সেটা করেছে। সারেন্ডারের সময় প্রতিবাদ করেছে। এগুলো সব গণতান্ত্রিক পন্থায়। কিন্তু জেএসএস তখন কী করলো? চুক্তির লিখিত ও মৌখিক সমালোচনার জবাব কি তারা লেখনির মাধ্যমে দিয়েছে? না। তারা তার জবাব দিয়েছে প্রদীপ লাল ও কুসুম প্রিয়কে হত্যা করে। কিন্তু হত্যা করেই শেষ নয়। প্রদীপ লাল কুসুম প্রিয়কে খুন করা হলো, কোন বিচার নেই। হত্যাকারীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে ও একের পর এক হুমকী দিয়ে যাচ্ছে। তারপর কয়েকদিন পর খুন করা হলো খাগড়াছড়িতে হরেন্দ্র ও হুরুক্যাকে। তারও কয়েকদিন পর দীঘিনালায় মৃণাল ও আনন্দময়কে এবং মারিশ্যায় অন্য এক ইউপিডিএফ সদস্যকে মেরে ফেলা হলো। তাছাড়া ধরে ধরে আরো অনেককে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। সিএইচটি কমিশনের রিপোর্টে এ সব বিস্তারিত লেখা আছে। তখন সে এক ভয়াবহ অবস্থা। প্রতিবাদে মিছিল পর্যন্ত করা যায় না। চট্টগ্রামে পর্যন্ত পুলিশ দাঁড়াতে দেয়নি। ইউপিডিএফের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে লালদীঘি ময়দান থেকে ৪৫জনকে গ্রেফতার করে। এত খুন, এত অন্যায়, অথচ তার কোন প্রতিকার নেই। পালিয়ে গিয়েও বাঁচার উপায় নেই। ধরে ধরে জবাই করা হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে। সে এক কঠিন পরিস্থিতি, যার মুখোমুখি আমরা ইতিপূর্বে কোনদিন হইনি বা স্বপ্নেও ভাবিনি। অডঙকে প্রশ্ন, এই অবস্থায় হলে আপনি কী করতেন? তবে আপনি মুখে যাই বলুন না কেন, এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লে আপনার নিজেরই অজান্তে আপনি কখন যে আত্মরক্ষায় নেমে পড়তেন তা নিজেই ঠাহর করতে পারতেন না। কারণ এটাই প্রকৃতির ধর্ম। প্রত্যেক প্রাণী সেটাই করে থাকে। চাকমা কথায় আছে, 'আগুনত পল্লে মরা সুগুনীবোয়্য তিন পাক খায়।' সে জন্য আত্মরক্ষার অধিকার আইনে পর্যন্ত স্বীকৃত। এ কথাগুলো মনে হয় আগেও বলেছি। কিন্তু যে অধিকার প্রকৃতি এবং আইন পর্যন্ত একজন মানুষকে দেয় সেই অধিকার অডং চাকমা আমাদের দিতে চান না। তার অভিধানে মনে হয় আত্মরা নামক শব্দটিই নেই। আর তাই তার বিচারে ডাকাত ও ডাকাতি প্রতিরোধকারী ব্যক্তি সবাই সমানভাবে দণ্ডনীয়। যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করতে চায় ও যে চায় না তারা সবাই তার চোখে সমানভাবে দোষী। কারণ তিনি 'নিরপেক্ষ’! আর তিনি এমন নিরপেক্ষ তার চোখে নিতান্ত সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগও অপরাধ হয়ে যায়ভ (যেমন তিনি প্রশ্ন করেছেন চুক্তি না মানার অর্থ কী প্রত্যাগত নিরীহ জেএসএসস স্যদরেকে পিনোন দেখিয়ে অপদস্থ করা? ইত্যাদি।) কিন্তু তার জানা থাকা উচিত পঁচা ডিম, টমেটো, জুতা ইত্যাদি নিক্ষেপ করে প্রতিবাদ জানানো বিশ্বে সর্বত্র স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। অথচ অডঙ চাকমার কাছে সেটা স্বীকৃতি পায় না।

(৩)অডঙ বাবু, উপদেশ দেয়া, সমালোচনা করা, অন্যের দোষ ধরিয়ে দেয়া, এবং এমনকি নিজের পরিচয় গোপন করে রূঢ় ভাষায় কঠোর কথা বলা অনেক সহজ। কিন্তু বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, উপর্যুপরি আক্রমণের বিরুদ্ধে সংযত থেকে মাথা ঠাণ্ডা করে সংগ্রাম করা অত্যন্ত কঠিন। যখন একটি পক্ষ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত আছে বলেও স্বীকার করতে চায় না, তখন সেই সংঘাত থেকে উত্তরণ অন্য পক্ষের ঐকান্তিক চেষ্টা সত্বেও সহজ হয় না। এটা কি এতই কঠিন বিষয় যে আপনারা অনেকে বুঝতে অপারগ? অনেক সময় দেখা যায় - দোষ করেছে এক ভাই, কিন্তু মায়ের বকুনী খেতে হচ্ছে অন্য ভাইকেও? ইউপিডিএফের অবস্থাটা হয়েছে অনেকটা ওই অন্য ভাইটির মতো যে কোন দোষ করেনি? সেজন্য অমিত হিলের কাছ থেকেও শুনতে হচ্ছে, "বারবার সবদোষের আঙ্গুলি শুধু স্যার সন্তুর দিকে নিক্ষেপ করেন কেনো? আচ্ছা, যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, সারেন্ডারের সময় পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানার দেখানো, পিনোন দেখানো ইউপিডিএফের অপরাধ হয়েছে, কিন্তু রূপায়ন দেওয়ান ও সুধাসিন্ধু খীসারা কী করেছেন? কেন তাদের কর্মী ও সমর্থকদেরও খুন করা হচ্ছে? কেন জেএসএসের পরীক্ষিত নেতা ও সন্তু বাবুর এক সময়কার একান্ত অনুগত চন্দ্র শেখর চাকমাকে পর্যন্ত গুলি করা হলো? ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের পক্ষে কথা বলায় ও জেএসএসের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলায় তো তাদের মহা কাল হয়েছে। যিনি সামান্যতম সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, যিনি গণতান্ত্রিকভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল মত পার্থক্যের মীমাংসা করতে চান, আপনারা যাই বলুন না কেন তাকে মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন। হয়তো অডঙ বা অন্য কারো কাছে এ ব্যাপারে ভালো 'তালিক' থাকতে পারে। যদি থাকে, তাহলে দয়া করে আমাদের জানালে বড়ই উপকৃত হই। তবে এটাও বলি যদি আগেভাগে আমরা জানতাম সন্তু বাবু সমালোচনা মোটেই সহ্য করতে পারেন না, গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে মোটেই মানেন না, এবং যদি কণা মাত্রও আঁচ করতে পারতাম যে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে তিনি এমন নিষ্ঠুরভাবে পশুশক্তি দিয়ে দমন করতে চাইবেন এবং শেষ পর্যন্ত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের জন্ম দেবেন, তাহলে আমরা অবশ্যই চুপ করে থাকতাম অথবা অন্য কৌশল ভেবে দেখতাম। তবে আগেও বলেছি, এখনও বলতে চাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য হিটলারকেই দায়ী করা হয়; মিত্র শক্তি ও অক্ষ শক্তি উভয়কে সমানভাবে দায়ী করা হয় না। বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার অনেক চেষ্টা সত্বেও, এমনকি তোষামোদী নীতি প্রয়োগ করার পরও হিটলারকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করা থেকে নিবৃত করা যায়নি। সন্তু বাবুও এমন টেমপেরামেন্টের মানুষ আমার সন্দেহ হয় চুপ করে থাকলেও ইউপিডিএফ নেতারা এবং বিশেষত প্রসিত খীসাসহ চার পাঁচ জন বাঁচতে পারতেন কীনা এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে এড়ানো যেত কীনা। কারণ আপনারা হয়তো জানেন না, চুক্তির আগেই সন্তু বাবু প্রসিতদাসহ আরো কয়েকজনকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি সে সময় বর্তমান ইউপিডিএফ নেতা সচিব চাকমা ও শান্তিদেব চাকমাকে শান্তিবাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে গিয়ে মানসিক নির্যাতন চালিয়েছিল এবং প্রসিত খীসার পক্ষে কাজ করবে না এই মর্মে লিখিত অঙ্গীকার নিয়েছিল। এছাড়া পানছড়িতে রিংকু (সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য) ও কুসুম প্রিয়কে (যাকে পরে খুন করা হয়) লতিবান থেকে ধরে নেয়া হয়েছিল। অপরাধ -- প্রসিতদার পক্ষে কথা বলা ও তার সংগঠন করা। তাদের দু'জনকে পরে ধূধূকছড়ায় নিয়ে যাওয়ার সময় রাতে পূজগাঙে গ্রামবাসীরা উদ্ধার করেছিল। এ ধরনের বহু ঘটনা আছে যা চুক্তির আগে ঘটেছে। তখনতো পিনোনও দেখানো হয়নি, পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ব্যানারও তোলা হয়নি।

সত্যি বলতে কী, প্রসিতদা ও রবিদা চুক্তি হওয়ার আগে রাজনীতি থেকে অফ যেতে চেয়েছিলেন। প্রসিতদা তো স্পষ্টভাবে সন্তু লারমাকে বলেছেন, 'ফুটবল মাঠে খেলার সময় কোন খেলোয়াড় আহত হলে তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। আমিও না হয় সে ভাবে রাজনীতি ও আন্দোলন থেকে ইস্তফা দিয়ে জেএসএসকে সাপোর্ট দিয়ে গেলাম। দর্শক গ্যালারীতে থেকেও নিজের টিমের খেলোয়াড়দের হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতে হয়। মূল লক্ষ্য হলো নিজের দলটা যাতে জেতে। আমিও না হয় দর্শক গ্যালারির একজনের মতো হয়ে গেলাম' এটা ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকের কথা। প্রসিতদা এ ব্যাপারে একেবারে লিখিতভাবে অঙ্গীকার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন সন্তু বাবু সেটাকে চ্যালেঞ্জ বলেছিলেন। সন্তু বাবুর এক কথা, প্রসিত খীসাকে জেএসএস পার্টিই করতে হবে। প্রসিতদাও করতে রাজী ছিলেন, তবে আগে গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচী পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু সন্তু বাবু জেএসএসের গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচী পড়তে দিতে রাজী হননি। এই হলো অবস্থা। প্রসিতদা অফ যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করার পর সন্তু লারমা যদি তাতে রাজী হতেন তাহলে আজ এ পরিস্থিতি হতো না। এটা প্রসিতদার কোন অভিমানের কথা ছিল না বা কৌশল ছিল না। তিনি মনে প্রাণেই চেয়েছিলেন জেএসএস যেহেতু এত বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, সেহেতু সে-ই আন্দোলনের মূল খুঁটি হিসেবে থাকুক। কোন ধরনের বিভেদ সৃষ্টি হলে তা আন্দোলনে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। কেউ যদি এতেও প্রসিতদার মধ্যে খুঁত দেখতে পায়, সেটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি। কিন্তু আমি বলবো, সন্তু লারমা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলার বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে প্রসিতদাকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার বা তার স্বপক্ষে নেয়ার যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাতে তার (সন্তু লারমা) রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তার মধ্যে গণতান্ত্রিক মনোভাবের অনুপস্থিতিই হলো সকল সমস্যার জনক। একটি পার্টিতে বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন মত থাকা খুবই স্বাভাবিক, না থাকাটাই অস্বাভাবিক। যখনই পার্টির মধ্যে এই মত পার্থক্যগুলো গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান করার সংস্কৃতির চর্চা না হয়, তখনই সমস্যা তৈরি হয়, এবং তখনই সেই সমস্যাগুলো অগণতান্ত্রিক পন্থায় সমাধানের চেষ্টা করা হয়। লাম্বা-বাদি গৃহযুদ্ধ থেকেই আমরা এই শিক্ষাই লাভ করে আসছি।

(৪)"কে আগে হত্যা শুরু করছে, আর কে পরে শুরু করছে সটো কোন প্রশ্ন নয়।"

কেন নয়? তবে বিষয়টার উপস্থাপনা আপনার সঠিক হয়নি। বিষয়টা এভাবে উপস্থাপন করা উচিত: কে আগে হত্যা শুরু করেছে, আর কে সে হত্যা থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে সেটা একটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক প্রশ্ন। কারণ আত্মরক্ষার অধিকার প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার। আমি যতটুকু জানি বাংলাদেশ পেনাল কোডেও এ অধিকার দেয়া হয়েছে। Nothing is an offence if it is committed in the exercise of the right to self defense. এমনকি আন্তর্জাতিক আইনেও রাইট টু সেল্ফ ডিফেন্স বা আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত। "Self-defence is an inalienable right of any nation. Right of self-defence, both individually and collectively is widely recognised in international law. Article 51 of the UN Charter affirms, "Nothing in the present Charter shall impair the inherent the right of individual or collective self-defence if an armed attack occurs against a Member of the United Nations, until the Security Council has taken measures necessary to maintain international peace and security"
BSF lodges 'war crime' FIR against BDR Is right of legitimate self-defence a 'war crime'?http://www.banglarights.net/HTML/incidence-6.htm

কে আক্রমণকারী আর কে আত্মরাকারী সেটা সকল দন্দ্ব সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু অডঙ চাকমা সে কথা স্বীকার করতে মোটেই প্রস্তুত নন। আত্মরক্ষা সম্পর্কে ইতিপূর্বেও তার সাথে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে। এক্ষেত্রে তার সমস্যা হলো, 'বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার।'

সেল্ফ ডিফেন্স সম্পর্কে আরো পড়ুন: http://en.wikipedia.org/wiki/Right_of_self-defense

(৫) অডঙ এর কথা, "জ্ম্মুজাতরি ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না, মানুষের জীবন নিয়ে মস্করা করবনে না।"

আপনার মনের ক্ষোভ, দুঃখ ও রক্তপাত বন্ধের আকুতি বুঝতে পারি। ক্ষোভের যন্ত্রণায় এ ধরনের কথা কারো মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়া একান্ত স্বাভাবিক। আপনাকে মোটেই দোষ দিই না। ইউপিডিএফ নেতাদের এসব সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে হরি কিশোর চাকমার সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে লেখা গল্পটা মনে পড়ছে।

(৬) "বারবার সবদোষের আঙ্গুলি শুধু স্যার সন্তুর দিকে নিক্ষেপ করেন কেনো? অমিত হিলের এই প্রশ্নের উত্তরে উপরে বলেছি। আরো কিছু বলার আছে। আপনার সন্তু স্যার যে দোষী তা তো তিনি তার নিজের বক্তব্যের মাধ্যমেই স্পষ্ট করেছেন। ১০ নভেম্বর এম এন লারমার স্মরণ সভায় কী বলেছেন ভুলে গেছেন? 'সন্তু স্যারের' দিকে দোষের অঙ্গুলী শুধু কি আমরাই তাক করছি? শ্রদ্ধেয় বনভান্তে এমনি এমনি বলেননি যে, 'হিটলার মারা যাওয়ার পরই কেবল ইউরোপবাসী শান্তি ফিরে পেয়েছিল; পার্বত্যবাসীও সন্তু লারমা মারা গেলেই তবে শান্তি পাবে।'

(৭) ইউপিডিএফ সংঘাত বন্ধে আন্তরিক কীনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে বলবো এটা অত্যন্ত অমূলক। কিছু দিন আগে একটা কৌতুক পড়েছিলাম। কৌতুকটা হলো এই: এক চোখ ফুলিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল ছেলে। মা দেখে আঁতকে উঠলেন: এ কী! কী হয়েছে!
ছেলে: জামানের সঙ্গে মারামারি করেছি।
মা: ছি, মারামারি করতে নেই। কাল স্কুলে যাওয়ার সময় মিষ্টি নিয়ে যাবে আর জামানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নেবে।
পরদিন ছেলে স্কুলে মিষ্টি নিয়ে গেল। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরল অন্য চোখটা ফুলিয়ে। মা বললেন, আজ আবার কী হয়েছে?
ছেলে: জামান আরো মিষ্টি চেয়েছে।

ইউপিডিএফেরও যেন ওই ছেলেটার দশা হয়েছে। মা ও ছেলের এত আন্তরিকতা সত্বেও জামানরা যদি আরো মিষ্টির লোভে এমন কান্ড করে তাহলে নিষ্কৃতির কী উপায়? ছেলেটা দ্বিতীয়বার জামানের কাছে মিষ্টি নিয়ে গেছে কীনা সেটা আমরা জানিনা, কিন্তু ইউপিডিএফ একটা চোখে আঘাত পাওয়ার পরও আবার মিষ্টি নিয়ে(ঐক্যের আহ্বান) হাজির হয়েছে জেএসএসের(সন্তু গ্রুপ) কাছে। দেখা যাক, কী হয়। তবে আপনারা যেভাবে ইউপিডিএফের আন্তরিকতায় অহেতুক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তাতে কী যারা ভাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ হোক চায় না তাদেরকে লাভবান করবে না? কৌশলগত দিক থেকেও আপনাদের ওই সন্দেহ প্রকাশ ইমেশিওর হয়েছে।

(৮) অমিত হিল: "তবুও আক্ষপে থেকে যাচ্ছ, আমার ব্যক্তগিতভাবে রাজনতৈকি ময়দানে বজ্রকন্ঠ বাজানোর সুযোগ হয়ে উঠনি। এরজন্য আপনারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। ছোটকাল থেকে রাজনৈতিক চেতনায় বেড়ে উঠেছি, ভেবেছিলাম একদনি স্বজাতির মুক্তিকল্পে নিজের জীবনকে উৎর্সগ করবো।"

আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, পড়ে হতবাক হলাম। তবে তার মানে এই নয় যে দায় অস্বীকার করছি। কারণ এটা ঠিক ভাতৃঘাতি সংঘাতের মতো পরিস্থিতি জান্তে অজান্তে অনেক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সমাজে অনেক খারাপ বাজে উপসর্গের জন্ম দেয়। তবে এটাও ঠিক দারিদ্র্য, কঠিন পরিস্থিতি, রূঢ় বাস্তবতা কাউকে কাউকে শেষ করে দিলেও, কাউকে কাউকে মহান করে তোলে। নজরুলের ভাষায়, হে দারিদ্র্য তুমি করেছো মোরে মহান। তবে সময় হারিয়ে যায়নি। আপনি এখনো 'স্বজাতির মুক্তিকল্পে নিজের জীবন উৎসর্গ' করতে পারেন। যারা প্রকৃত সংগ্রামী বিপ্লবী, যারা স্বজাতির মুক্তির চিন্তায় বিভোর, কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি তাদের দমাতে পারে না। এটাই বিশ্ব ইতিহাসের নিয়ম। কবে কখন অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হবে, তারপর নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন! অপো করতে করতেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে। অনুকূল পরিস্থিতিতে সবাই বিপ্লবী সাজতে পারে, কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্রোতের বিপরীতে অমিত তেজে এগিয়ে যেতে সবাই পারে না। আর সংগ্রামের পথ ফুল বিছানো নয় - এটাও নিশ্চয় আপনার জানা আছে। বুদ্ধ বলেছেন, আজ শীত, আজ গরম এই অজুহাতে ভালো কাজ ফেলে রাখা ঠিক নয়। সুতরাং আপনার কাছে পরামর্শ আপনিও অজুহাত না দেখিয়ে 'স্বজাতির মুক্তিকল্পে নিজের জীবন উৎসর্গ' করতে আজই নেমে পড়ুন।

(৯) অমিত হিল প্রসিতদাকে 'স্যার' সম্বোধন করেছেন। জেএসএসে সন্তু লারমাসহ অন্যান্য নেতাদের অবশ্যই স্যার বলে ডাকতে হয়। তবে ইউপিডিএফে নেতাদের স্যার বলে সম্বোধনের রেওয়াজ নেই। এটা আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক লেগাসি ও আমলাতান্ত্রিকতার মতো দেখায়। এমনকি ইউপিডিএফে নেতাদের নামের আগে বিশেষণও প্রয়োগ করা হয় না। এগুলো বাহুল্য ও অর্থহীন এবং ক্ষেত্র বিশেষে খারাপ। ইউপিডিএফে নেতাদের সাধারণত দা সম্বোধন করা হয়।

(১০) যারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে না বলেছেন তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। আপনারা দৃঢ়ভাবে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বিপক্ষে অবস্থান নিন, শুধু মুখে না বলে বাস্তবে সংঘাত বন্ধের জন্য নেমে পড়ুন, বাস্তব কর্মসূচীতে অংশ নিন, তাহলে একদিন এই সংঘাত বন্ধ হবেই। ইউপিডিএফ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য ১১ নভেম্বরের গণ বিক্ষোভ ও ১৮ নভেম্বরের গণপ্রার্থনা অনেক কাজ দিয়েছে। মুখের কথার চাইতে এ ধরনের কর্মসূচী অনেক ফলপ্রসূ।

দীর্ঘ জবাব পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন