মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১১

ফেসবুকে আলোচনা-২

হিল্লো গাবুজ্যার মন্তব্য ও অডঙ চাকমার জবাবের প্রেক্ষিতে
প্রথমে হিল্লো গাবুজ্যাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি লিখেছেন, 'এত কিছু বলার কারন-আপনার হয়ত স্মরন থাকার কথা এর আগে আপনার ফেসবুকে শেয়ার করা কয়েকটি লেখায়ও প্রশ্ন রেখেছিলাম কিন্তু উত্তর না পাওয়ায় বিব্রত হতে হয়েছি।' আপনার প্রশ্নের উত্তর যদি না দিয়ে থাকি, তাহলে সেটা হবে বেখেয়াল বশতঃ। তবে যেই হোক, তার জন্য আমি দুঃখিত। উত্তর না পাওয়ায় আপনাকে বিব্রত হতে হয়েছিল বলে দ্বিগুণ দুঃখ প্রকাশ করছি।এরপর আমি বলতে পারি, মতলববাজী মানসিকতা বাদ দিয়ে কেউ যদি আমাদের সাথে বিতর্ক করতে আসে, বা কেউ কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তখন তার সাথে আলোচনা করা বা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সাধারণভাবে একটা চেষ্টা আমাদের দিক থেকে থাকে।

যাই হোক, এবার আসল কথায় আসা যাক।প্রসিতদার 'আড়ালে থাকার' মধ্যে কোন রহস্য নেই।তিনি পার্টি শৃঙ্খলা ও নিয়ম নীতির অধীন।তিনি ইচ্ছে করছে বলেই যা কিছু করতে পারেন না। যে ইন্টারভিউটা তিনি দিয়েছেন, যেটা নিয়ে অডং বাবু আলোচনার সূত্রপাত করেছেন, সেই ইন্টারভিউতে তিনি যা বলেছেন তা তিনি তার উচ্চ পর্যায়ের সহযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা করেই বলেছেন।প্রসিতদা সন্তু বাবুর মতো প্রায় সময় মিডিয়ার সামনে হাজির হন না এটা ঠিক।কিন্তু তার মানে এই নয় তিনি জনগণের কাতারে নেই।বরং উল্টোটাই ঠিক। প্রসিতদার কাজের স্টাইল আর সন্তু বাবুর কাজের স্টাইল এক নয়।ইউপিডিএফের কাজের স্টাইল পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব পরিস্থিতিতে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে।

'আর পাঃ চট্টগ্রামের প্রধান আঞ্চলকি রাজনতৈকি দল এবং সবচেয়ে পুরনো দল হিসেবে কতটুকু র্মযাদা দেন এবং এ বিষয়ে আপনার পার্টির দূরদর্শিতা কতটুকু?'

আপনার এই প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পেরেছি কিনা বলতে পারবো না।তবুও যেটুকু বুঝেছি তার ভিত্তিতে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি। আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবেন যে, প্রসিতদা তার উপরোক্ত ইন্টারভিউতে জেএসএসের এক সময়কার প্রগতিশীল ভূমিকার কথা স্বীকার করেছিলেন।ইউপিডিএফের বহু লেখায় ও প্রচারপত্রে এটা স্বীকার করা হয়েছে।কারণ যা সত্য তা স্বীকার করতে আমাদের কোন সংকোচ ও দ্বিধা নেই।১৯৬০, ৭০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে সংগ্রাম শুরু করার ক্ষেত্রে জেএসএসের বড় ধরনের, বলতে গেলে একক, অবদান রয়েছে। জেএসএসের বহু নেতা কর্মী জীবন উসর্গ করেছেন স্বজাতির মুক্তির জন্য। ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, বহু ত্যাগ তিতিক্ষা করেছেন। এ সবই সত্য। কিন্তু একই ভাবে এটাও সত্য যে, জেএসএসেরও কিছু গুরুতর ভুল রয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। সে ভুলগুলো আজ এখানে আলোচনা করছি না।তবে এটুকু বলবো আন্দোলনে জেএসএসের অবদানের পাশাপাশি এই ভুলগুলোও আলোচনা হওয়া দরকার। তা না হলে আমরা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবো এবং একই জায়গায় ঘুরপাক খেয়ে পড়ে থাকবো।মোট কথা হলো, প্রত্যেক নতুন প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের ভূমিকাকে ক্রিটিক্যালি বিচার করতে হয়, অর্থা তার দোষ গুণ নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হয় এবং বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণিত ভুলগুলো ফেলে দিয়ে যা সঠিক তা গ্রহণ করতে হয়।পুরাতন প্রজন্ম এই সমালোচনা মেনে নিতে না পারলেও তা করতে হবে সামগ্রিক স্বার্থে।বিষ ফোঁড়া হলে সেটার পুঁজ জোর করে বের করতে হয়, এখানে জোর করা হচ্ছে ভালোর জন্য।ইউপিডিএফও সে কারণে জেএসএস নেতাদের ভালো না লাগলেও তাদের ভুলগুলোর সমালোচনা করে থাকে।এটা সামগ্রিক জাতীয় স্বার্থেই।যে সমাজে সমালোচনা নেই, বিতর্ক নেই, দ্বন্দ্ব নেই, সে সমাজ বন্ধ্যা, অচল।

ইতিহাসে দেখা যায়, বহু দল বা নেতা এক সময় প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করলেও পরে তাদের সেই ভূমিকা আর থাকেনি। জেএসএসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।এম এন লারমার জেএসএস আর সন্তু লারমার জেএসএস এক নয়। ভাই হলেও এম এন লারমা আর সন্তু লারমা এক নন, একই নীতি আদর্শের মানুষ নন। এমনকি তাদের দু'জনের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও টেমপেরামেন্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন, দুই মেরুর।
আপনার প্রশ্নের উত্তর কতটুকু দিতে পেরেছি জানিনা।তবে দেয়ার চেষ্টা করেছি, এটুকু বলতে পারি।

এবার অডঙ বাবুর জবারের প্রেক্ষিতে আসি। আপনাকেও ধন্যবাদ পুনরায় আলোচনায় অংশ নেয়ার জন্য। বৃটিশরা চাকমাদের সম্পর্কে বলেছেন চাকমারা নাকি তর্কপ্রিয়। আমার লেখার মাধ্যমে এই অভিযোগের (নাকি অন্য কিছু) সত্যতা প্রমাণিত হতে পারে সেই ভয় সত্বেও আপনার ১২ ডিসেম্বরের লেখার জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি।

(১)স্বীকার করছি এবং বুঝি যে, কোন কোন সময় কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একেবারে শীর্ষ নেতার কাছ থেকে বক্তব্য আশা করা হয়।তবে সস্তা হাততালি, বাহবা পাওয়ার জন্য বক্তব্য দেয়ার অভ্যাস যেন আমাদের পেয়ে না বসে।আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি, প্রসিতদা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের ঘোষণা ইতিমধ্যে দিয়েছেন।সমাবেশ ডেকে বক্তৃতাবাজি করে দেননি বটে, তবে কয়েকজন অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলোচনায় ওই ঘোষণা দিয়েছেন।সবচেয়ে বড় কথা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের জন্য আমরা ব্যর্থ হওয়ার পরও বার বার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের দিক থেকে।এ ব্যাপারে আগে দীর্ঘ আলোচনা করেছি।নতুন করে আর বলতে চাই না।তাই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের প্রশ্নে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতি সন্দেহ পোষণ করা হবে চরমতম অন্যায়ের মধ্যে একটি।যেখানে আমাদের সহযোদ্ধারা একের পর এক খুন হচ্ছে, অপহরণ হচ্ছে, ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে অস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে আমাদের জীবনেরও কোন নিরাপত্তা নেই এবং যেখানে আমরাই আর্থিকভাবে, সাংগঠনিকভাবে, মানসিকভাবে সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, সেখানে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে আমাদের চাইতে আর কে বেশী আন্তরিক হবে? এ জন্য যখন 'জ্ম্মুজাতির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না, মানুষের জীবন নিয়ে মস্করা করবনে না।' প্রসিতদার উদ্দেশ্যে লেখা অডঙ বাবু আপনার এই বাক্যটা পড়ি তখন কাঁদবো না হাসবো বুঝতে পারিনি। মনে কিছুটা ব্যথাও পেয়েছি। আপনার লেখাগুলো পড়লে মনে হয় আপনি ছাড়া বুঝি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে আর কেউ আন্তরিক নয়। তাই বলি কি, যদি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে আপনি এতই আন্তরিক হন, তাহলে কেবল কথা না বলে, কেবল ফেইসবুকে লেখালেখিতে সীমাবদ্ধ না থেকে মিছিল মিটিং ও সভার আয়োজন করুন, মানববন্ধন করুন, লং মার্চ ইত্যাদি করুন। জানি আমার এ কথা শুনে আপনি আপনার অপারগতা প্রকাশ করতে নানা অজুহাত খুঁজবেন। কারণ অন্যের সমালোচনা করা সহজ, বাস্তবে নিজে করা বড়ই কঠিন। এটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

(২) “কাজেই একজন সংঘাতের মূল হোতা হলে অন্যজন হবে উস্কানি দাতা কিংবা অনুঘটক।”
না, তারপরও 'সীতা কার বাপ' এর মতো কথা বললে আমার মতো অমের কী উপায় আছে? এক চোখা বিচারে নিরীহ ব্যক্তিও শাস্তি পায়, আর দোষী ব্যক্তি কেটে পড়ার সুযোগ পায়। দোহাই আপনি একচোখা বিচারক হবেন না।

আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি ইউপিডিএফের রাজনৈতিক চিত্ত অত্যন্ত পরিস্কার। আমি দৃঢ়ভাবে বলবো, আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত এড়ানোর জন্য, আর যখন সংঘাত বেঁধে গেছে তখন তা বন্ধ করার জন্য। এতে আমরা 'উত্তম' হয়েছি কিনা জানি না, তবে আমরা আমাদের দিক থেকে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি এটুকু বলতে পারি।

(৩) 'অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই, পঁচা ডিম, টমটো, জুতা ইত্যাদি নিক্ষেপ করার মত এরকম গণতান্ত্রকি পদ্ধতির সাথে একমত নই, সর্মথক নই। ...
স্বীকৃত সাধারণ মত ও পদ্ধতির সাথে দ্বিমত পোষণ করার পূর্ণ অধিকার আপনার আছে। ভুল বলেননি সেটাই ভালো।

“পঁচা ডিম, টমেটো, জুতা” ইত্যাদি নিক্ষেপ করে আপনি পেতে চাচ্ছেন “সাবাশ” আর সন্তুবাবু বুঝছেন “কচু”।" তাহলে কি বোঝা যাচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে এখানে দুটো মতের সাথে দ্বন্দ্ব -- এক পক্ষ গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলে, আর অন্য পক্ষ সেই গণতন্ত্রের ভাষা বোঝে না। তার কাছে সেটা এলিয়েন ল্যাঙ্গুয়েজ, ভিনদেশী ভাষা। অডঙ বাবুর আদালতের রায়ে সাব্যস্ত: উভয়েই দোষী! ইউপিডিএফ দোষী, কেননা জেএসএস না বোঝা সত্ত্বেও সে গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলেছে। আর, জেএসএস দোষী, কারণ সে গণতন্ত্রের ভাষা বোঝে না। জয় হোক অডঙ বাবুর বিচারের!

(৪) 'আত্মরক্ষার সাধারণ ধারনা নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই, কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিলো আপনাদের আত্মরক্ষার ধারনার ধরন ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে।'
শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকার করে নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, যদিও স্বীকার করাটা আনকোয়ালিফাইড নয়।

"যেই আত্মরক্ষার কথা বলছেন, আপনাদের পার্টির গঠনতন্ত্রে কোথাও কী কিছু লেখা আছে?আপনাদের গঠনতন্ত্র মেনে আপনারা কী আপনাদের আত্মরক্ষার নীতি কৌশল ঠিক করেছেন?"

একটি পার্টির গঠনতন্ত্রে সবকিছু লেখা থাকে না। সংবিধান যেমন একটি দেশের মূল দলিল, গঠনতন্ত্রও একটি দল বা সংগঠনের মৌলিক দলিল। এই গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতেই পার্টির অন্যান্য নিয়ম কানুন ঠিক করা হয়। আর আত্মরক্ষা বিষয়টি এতই সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি ব্যাপার যে সেটা কোন পার্টির গঠনতন্ত্রে লেখার প্রয়োজন হয় না।

(৫) সবশেষে বলবো, একটি বিষয়ে সবাইকে খেয়াল থাকতে অনুরোধ করবো। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের যে ডাক ইউপিডিএফসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে সেটা সেনাবাহিনীর অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত যাতে বন্ধ না হয়, যাতে আমাদের মধ্যে সব সময় মারামারি হানাহানি লেগে থাকে তার জন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা লক্ষণীয়। যেমন কিছুদিন আগে ১০ নভেম্বর সেনাবাহিনী 'ইউপিডিএফ এর এ কোন প্রহসন?' শিরোনামে জেএসএসের নামে একটি লিফলেট বিলি করেছে। আমরা মনে করি না যে জেএসএস এটি ছাপিয়েছে। কারণ জেএসএসএর লিফলেটের ভাষা এ রকম নয়। যাই হোক, লিফলেটের মূল কথা হলো সংঘাত বন্ধের দাবিতে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা নস্যাৎ করে দেয়া। আর সেটা করতে হলে প্রথমেই দরকার ইউপিডিএফের ঐক্যের আহ্বানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়া; জনগণের মনে সংশয় সৃষ্টি করে দেয়া। কাজেই এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সেনাবাহিনী জানে, ইউপিডিএফ জেএসএস এক হলে, জুম্ম জনগণ এক হয়ে গেলে, তাদের বিদায় ঘন্টা বাজবে। তবে আজ হোক কাল হোক সেই ঘন্টা বাজাতে হবেই।




বেক্ষুনে গম থাক্কুয়্য, সুগে থাক্কুয়্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন