আজ ১০ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামে
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি উত্থাপনের দিন। ১৯৯৭ সালের এদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সংগঠন
পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের
সামনে এক সমাবেশের মাধ্যমে এই পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি উত্থাপন করে এবং একটি প্রচারপত্র
বিলি করে। যে সময় এই দাবি উত্থাপন করা হয় সে সময় পার্বত্য চট্টগামসহ দেশে-বিদেশে সর্বত্রই
পার্বত্য চুক্তিকে ঘিরে চলছিলো জোর প্রচার-প্রচারণা, রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা ছিল
সরব, পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বৈরী ও প্রতিকূল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের
ছাত্র-যুব সমাজের অগ্রণী অংশটি এই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপনের মধ্যে দিয়ে জাতীয়
জীবনের সন্ধিক্ষণে পালন করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। এর ফলে অচিরেই শাসক চক্রের প্রতারণা
চুক্তি সম্পাদনকারী জেএসএসসহ সবার কাছে উন্মোচিত হয়।
সে সময় পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে যে প্রচারপত্রটি
বিলি করা হয়েছিল সেটি কম্পোজ করে নীচে হুবহু দেয়া হলো । পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক
ঘটনা প্রবাহে যারা এখনো সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছেন তাদের জন্য এটি সহায়ক হবে বলে মনে
করি।
--------------------------------------------------------------
পার্বত্য
চট্টগ্রামে
অবিলম্বে
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন মেনে নিন
বহিরাগতদের
সম্মানজনক পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিন
দীর্ঘ দুই যুগের অধিক দ্বন্দ্ব সংঘাত মুখর পার্বত্য
চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে আলাপ আলোচনা
চলছে। ইতিমধ্যে দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম দফা ২১ ও ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৬ খাগড়াছড়িতে
এবং দ্বিতীয় দফা ২৫-২৭ জানুয়ারী ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায়। পরবর্তী বৈঠকটি
আগামী ১২ই মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।
অতি শীঘ্রই পার্বত্য চট্টগ্রাম
সমস্যার ব্যাপারে সমঝোতা হতে যাচ্ছে বলে সরকার পক্ষ থেকে ব্যাপক আশাবাদ ব্যক্ত করা
হচ্ছে। বৈঠকে সরকারী পক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির
প্রধান সংসদের সরকারী দলের চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের
কাছে মন্তব্য করে যাচ্ছেন যে, সমাধান এখন শুধু কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক
স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী লেঃ জেঃ নূরুদ্দীন খান (অবঃ) ১৪
ফেব্রুয়ারী বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৫ জুলাই আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান
এবং তার আগে গেরিলাদের সাথে চুক্তি হবার কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারে
তিনি সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮টি নিয়মিত সেনা শিবিরে এবং বহিরাগতরা যে যেখানে
আছে সেখানেই থাকবে তা জোর দিয়ে বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তঃসংসদীয় সম্মেলন থেকে ফিরে ১৬ ফেব্রুয়ারী বিমান বন্দরে সাংবাদিক
সম্মেলনে বলেছেন কোন ষড়যন্ত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ প্রচেষ্টা
থেকে সরকারকে বিরত রাখতে পারবে না।
সরকারের এ ধরনের বক্তব্য
বিবৃতির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমনে যুগপৎভাবে একদিকে কিছুটা
হলেও যেমন আশা জাগছে, অপরদিকে আবার স্ববিরোধীমূলক কথাবার্তা আর পদক্ষেপে বেশ সংশয়ও
দেখা দিচ্ছে। আমরা গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ্য করছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের
আপামর জনসাধারণের প্রাণপ্রিয় ন্যায্য দাবি ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ সম্পর্কে নানান বিভ্রান্তি
ছড়ানো হচ্ছে। ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’ দাবি ভন্ডুল করে দেবার জন্য এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত
অশুভ তৎপরতায় মেতে উঠেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটানোর হীন উদ্দেশ্যে পার্বত্য
চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে। পাহাড়ী-বাঙালী বিভেদ সৃষ্টি করে
নিজেদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের
তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই : পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের
দাবি শুধু মাত্র পাহাড়ী জাতিসত্ত্বাসমূহের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নয়। এই দাবি পুরোণ
বস্তি বাঙালী জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্যও অপরিহার্য। তাই স্বায়ত্তশাসন দাবি
কেবল পাহাড়ী জনগণের নয়। এই দাবি পাহাড়ী বাঙালী উভয় জনগোষ্ঠীরই। পার্বত্য চট্টগ্রামে
স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা তথা সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য ‘স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত
করা’ পাহাড়ী বাঙালী জনগণের কাছে সমানভাবে অতি জরুরী।
কায়েমী স্বার্থবাদী মহল
উদ্দেশ্যমূলকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের প্রাণপ্রিয় দাবি ‘স্বায়ত্তশাসনের’
পক্ষ-বিপক্ষ আর পাহাড়ী-বাঙালী দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে আগের মতো ফায়দা লুটার জন্য মরিয়া
হয়ে উঠেছে। তার সুস্পষ্ট আলামত ইতিমধ্যে দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
১২ মার্চ বান্দরবান, রাঙ্গামাটি
ও খাগড়াছড়িতে হরতাল আহ্বান করে স্বার্থবাদী গোষ্ঠী স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে। বাঙালী
স্বার্থের ধুয়ো তুলে প্রকারান্তরে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়াই হচ্ছে এই লম্পটদের একমাত্র
উদ্দেশ্য। এই গুটি কয়েক মুখচেনা দুর্বৃত্তদের সাথে ব্যাপক বাঙালী জনগোষ্ঠীর স্বার্থ
এক নয়। সাধারণ নিরীহ বাঙালীদের সাথে ঐ টাউট-বাটপারদের সম্পর্কও নেই। অথচ বাঙালীদের
স্বার্থের নাম ভাঙিয়ে দুর্বৃত্তরা টু-পায়েস কামাই করছে।
এই মুখচেনা বাঙালী স্বার্থের
ধ্বজাধারী সুযোগসন্ধানীদের থেকে সাধারণ বাঙালী ভাইদেরকে সজাগ থাকতে হবে। এই আদম বেপারীরাই
বাঙালী-বাঙালী ধুয়ো তুলে সবচেয়ে বেশি বাঙালীদের ক্ষতি করছে। তাদেরকে চিনে রাখতে হবে।
ধান্দাবাজ, টাউট ও আদম বেপারীদের ষড়যন্ত্রে বাঙালী ভাইয়েরা পা দেবেন না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী
শান্তির লক্ষ্যে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে, আপনাদের অধিকার অবশ্যই রক্ষিত হবে। সুদূর
অতীতের মতো পাহাড়ী-বাঙালী সম্পর্ক আরো উষ্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ করে তুলতে আপনারাও আমাদের
সাথে সামিল হোন। দেশকে সমৃদ্ধ করে তোলার সুমহান দায়িত্ব যাতে আমরা যোগ্যতার সাথে পালন
করতে পারি, সেজন্য বিদ্বেষ নয় পরস্পরের সহযোগিতা করতে হবে।
পাহাড়ী জাতিসত্ত্বাসমূহের
মধ্যেও মুখ-চেনা কতিপয় সুযোগ সন্ধানী পাহাড়ী-পাহাড়ী ধুয়ো তুলে অহেতুক বিভ্রান্তি ও
বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত। এদের থেকেও জনগণকে সাবধান থাকতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কোন
অবস্থাতেই যাতে পাহাড়ী বাঙালীদের মধ্যে হানাহানি না হয়, তার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।
ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী
লেঃ নূরুদ্দীন (অবঃ) বহিরাগত বাঙালী ভাইদের সম্মানজনক সুষ্ঠু পুনর্বাসনের উদ্যোগ না
নিয়ে দেশের নাগরিক হিসেবে যেখানে আছেন সেখানে থাকবেন বলে দায়িত্ব(?) শেষ করেছেন। এতে
তিনি বহিরাগত বাঙালী ভাইদেরকে দারুণভাবে অবজ্ঞা করেছেন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজের ইচ্ছায় যাননি। অতীতের
সরকারসমূহ তাদেরকে নানান মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়েছে। মানবঢাল
হিসেবে ব্যবহার করেছে। সেনাবাহিনী তাদেরকে প্রয়োজনে কখনো গোয়েন্দাগিরির কাজে, কখনো
কুলি হিসেবে কিংবা কখনো লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম
সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য অবশ্যই বহিরাগত বাঙালীদেরকে অন্যত্র সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসনের
ব্যবস্থা করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ও সমাধানের লক্ষ্যে
নিম্নোক্ত দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে:
১। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে।
২। বহিরাগত বাঙালীদের সম্মানজনকভাবে অন্যত্র পুনর্বাসন
করতে হবে এবং তাদের জীবিকা ও ভরণ পোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৩। সাঁওতাল, গুর্খা, নেপালী, অহোমী ইত্যাদি microscopic
minorities দের স্বীকৃতি, অধিকার ও
মর্যাদা প্রদান করতে হবে।
৪। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে
ফিরিয়ে আনতে হবে এবং বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৫। জাতিগত বিদ্বেষ ও দাঙ্গা সৃষ্টির বিরুদ্ধে কঠোর
ব্যবস্থা নিতে হবে।
৭। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দায়েরকৃত পাহাড়ী গণপরিষদ, পাহাড়ী
ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা
ও হুলিয়া প্রত্যাহার করতে হবে।
৮। কল্পনা অপহরণ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের
বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতন
বন্ধ করতে হবে।
১০ মার্চ, ১৯৯৭ ইং
ঢাকা
পাহাড়ী গণ পরিষদ
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ
হিল উইমেন্স ফেডারেশন
---------------------------------------------------------------------------------
পাহাড়ী গণপরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স
ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার-প্রকাশনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন