শুক্রবার, ৭ মার্চ, ২০১৪

মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল প্রতিরোধ বার্ষিকী ও শহীদ অমর বিকাশ দিবস আজ

আজ ৭ মার্চ সেনা সৃষ্ট মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল প্রতিরোধ বার্ষিকী ও শহীদ অমর বিকাশ দিবস। ১৯৯৬ সালের এদিন খাগড়াছড়ির জনতা মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলে। এদিন মুখোশ বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন অমর বিকাশ চাকমা। জনতার প্রতিরোধের মুখে পরবর্তী সময়ে সরকার ও সেনাবাহিনী মুখোশবাহিনী ভেঙে দিতে বাধ্য হয়।
সে সময় তিন সংগঠনের (পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন) মুখপত্র স্বাধিকার বুলেটিনে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। নীচে স্বাধিকার বুলেটিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি হুবহু দেয়া হলো:
-----------------

খাগড়াছড়িতে দুর্বার গণ প্রতিরোধ ॥ বীরের আত্মাহুতি
পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে সংযোজিত হলো রক্ত ফুটানো এক যুগান্তকারী অধ্যায়। রচিত হলো বীরত্ত্ব, সাহসিকতা ও প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সেনাবাহিনী ও তাদের ঔরসজাত সন্ত্রাসী মুখোশধারী গুন্ডাদের বর্বরোচিত হামলার প্রতিরোধ রচনা করতে গিয়ে বীরত্ত্বের সাথে আত্মাহুতি দিয়েছেন শহীদ অমর বিকাশ চাকমা(২০)। সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করতে গিয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন সিন্ধু বিকাশ চাকমা (২৭) ও বিজয় কান্তি মারমা (২৫)।

ঘটনার সূত্রপাত :
দীর্ঘদিন ধরে সেনা মদদ ও প্রত্যক্ষ সহায়তায় এলাকায় শান্তি শৃংখলা বিনষ্টকারী ও স্বাভাবিক জনজীবনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী গুন্ডা বদমাইশরা পেরাছড়ায় সংগ্রামী জননেতা বিম্বিসার খীসার বাড়ীতে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা করতে গেলে ৭ই মার্চ রাতে ঘটনার সূত্রপাত হয়।

প্রতিবেশীরা “মুখোশ মুখোশ, মুখোশ বাহিনী এসেছে- বলে চিকার করলে মুহুর্তের মধ্যেই পেরাছড়া গ্রামের লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে আসে। চিকার শুনে পেরাছড়ার আশে-পাশের গ্রাম সিংগিনালা, খবংপজ্যা, নারাংহিয়া, মাজনপাড়া সহ বিভিন্ন এলাকর শত শত লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে সেনা ঔরসজাত গুন্ডাদের ধরতে রাস্তায় নেমে পড়ে। অপরদিকে সন্ত্রাসী গুন্ডা বদমাইশরা সেনাবাহিনীর সহায়তায় পেরাছড়ায় কার্তিক ত্রিপুরা নামে এক ছেলেকে রাত ১১টার দিকে মারধর করে। দরজা ভেঙে বিম্বিসারের বাড়ীতে জোড়পূর্বক ঢুকে পড়ে। দরজায় ধাক্কা লেগে তার মা কপালে আঘাতপ্রাপ্ত হন। সন্ত্রাসীরা তার বাবাকে অমানুষিকভাবে মারধর ও অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করে। মাইন্য ভ্যালরি কর্মচারী শিমুল চাকমাকেও গুরুতরভাবে আহত করে।

জনতার প্রতিরোধ:
ইতিমধ্যে শত শত লোক চতুর্দিক থেকে সেনা মদদপুষ্ট গুন্ডাদের ধরার জন্য তেড়ে আসে। পেরাছড়া ও স্বনির্ভর এলাকায় মধ্যবর্তী স্টেডিয়াম সংলগ্ন পানছড়ি সড়কে তাদেরকে ঘিরে ফেলে। ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করে। স্বনির্ভর ও পেরাছড়া এলাকার শষ্যক্ষেত্র রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেদিন রহস্য জনক কারণে ষ্ট্রীট লাইটগুলো আগে থেকেই অফ করে রাখা হয়। আর্মীরা চালাকি করে তাদের Pick up -এর বাতিও নিভিয়ে ফেলে। এতে হাজার হাজার জনতার ভীড়ে সন্ত্রাসী ও সেনাদের রাতের অন্ধকারে সনাক্ত করা দূরূহ হয়ে পড়ে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীরা ব্রাশ ফায়ার করে ও সন্ত্রাসীরা ককটেল ফাটিয়ে জনতাকে সন্ত্রস্ত করতে চায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিবাদী জনতা ক্ষান্ত হয়নি। আর্মীরা ব্রাশ করলে পজিশান নেয়। বন্দুকের আওয়াজ থামলে উত্তেজিত জনতা “ধর ধর” বলে চিকার করে এগুতে থাকে। এভাবে রাত ৩টা পর্যন্ত  চলতে থাকে। সেনাবাহিনীও সন্ত্রাসীরা জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে দুটি পিক আপ যোগে ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগুতে থাকে। বীর জনতা তাদেরকে খেজুর বাগান উপজেলা মাঠ পর্যন্ত ধাওয়া করে নিয়ে যায়। সেনাও গুন্ডারা জনতার তাড়া খেয়ে চেঙ্গী স্কোয়ার হয়ে ক্যান্টমেন্টে পালিয়ে যায়।

দৃশ্যপট পরিবর্তন ॥ পুলিশের আগমন :
সন্ত্রাসী ও সেনা সদস্যদর পলায়নের ১০/১৫ মিনিট পর শত শত যুদ্ধাংদেহী পুলিশ (জনগণের ভাষায় থোলা) নারাংহিয়া ও স্বনির্ভর এলাকায় এসে অবস্থান নেয়। এ সময় স্ব স্ব বাড়ীতে ফিরতে থাকা গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে বিনা উস্কানীতে নির্বিচারে শর্টগানের গুলি ছুঁড়তে থাকে। এতে অর্ধশতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী আহত হয়। খাগড়াছড়ির পুলশ সুপার এক প্রেস ব্রিফিং-এ দেড়শ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেন।

যেভাবে অমর নিহত হয় :
 সন্ত্রাসী গুন্ডাদের ধাওয়া করতে হাজার হাজার প্রতিবাদী জনতার সাথে অমর বিকাশ চাকমাও সামিল হয়। সেও সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধের প্রথম সারিতে এগিয়ে যায়। তার সাথে ছিল তার ভাই সিন্ধু বিকাশ চাকমা(২৭) ও বিজয় কান্তি মারমা সহ আরো কয়েকজন। তারা ধাওয়া করতে করতে স্বনির্ভর এলাকার স্কুলের কাছাকাছি এসে পড়ে। নির্ভিক অমর বিকাশ চাকমা "জীবন মৃত্যু পায়ার ভৃত্যু" এই পণ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলে এক পর্যায়ে সেনাঘাতকদের বুলেট তাকে বিদ্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে সে মাটয়ে লুটয়ে পড়ে। 
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে প্রকাশ, ঘাতকরা এতেও ক্ষান্ত না হয়ে বন্দুকের বাট ও বুট জুতা পায়ে তার বুকে আঘাত করে। সেনারা বুটের লাঠিতে দলিত মথিত অমর বিকাশ চাকমার দেহ টেনে হেঁচড়ে পিক আপে তুলে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মরদেহের পাশে অস্ত্র রেখে ছবি তোলে এবং স্বনির্ভর মাঠে অস্ত্রসহ শান্তিবাহিনীর লাশ পেয়েছে বলে অপপ্রচার চালায়। পত্র-পত্রিকায় পরিকল্পিতভাবে প্রচার করে।

লাশ নিয়ে তালবাহানা
বারংবার দাবী সত্ত্বেও পুলিশ লাশ  নিয়ে তালবাহানা শুরু করে দেয়। ৯ তারিখ দুপুর বারটায় লাশ ফেরত দিতে পুলিশ রাজী হয়। কিন্তু অমরের বাবা চিত্তর রঞ্জন চাকমা (৫৫) খালি হাতে মনের দুঃখে কাঁদতে বাড়ী ফিরে আসতে বাধ্য হন। লাশ নিয়ে যাতে মিছিল না হয় তার জন্য পুলিশ কঠোর ভাষায় তাকে হুমকি দেয় এবং অমর শান্তিবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে বলে প্রচার করতে বাধ্য করে। কিন্তু তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। লাশ নিয়ে মিছিলের ছবি দেশের বাইরে প্রচারিত হলে উ.ঈ ও ঝ.চ-এর চাকুরী ক্ষেত্রে সাংঘাতিক জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে তারা জানায়। ঐদিন বিকালে পাহাড়ী ছাত্র-গণ পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন মিছিল বের করে। তারা অচিরেই লাশ ফেরত দেয়ার দাবী জানায়। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি ও ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করা হয়। ঢাকা, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানেও ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল বের হয়।

লাশ ফেরত দান:
১০ তারিখ সকাল ১১টার দিকে লাশ ফেরত দেয়ার দাবীতে আবার মিছিল বের হয়। জেলা প্রশাসকের নিকট তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেয়া হয়। চার দিন পর পুলিশ ১০ তারিখ বিকেল ৪টার দিকে লাশ ফের দেয়।

শহীদের মরদেহ নিয়ে মিছিল ও সমাবেশঃ
১১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় শহীদের মরদেহ নিয়ে হাজার হাজার আবাল-বৃদ্ধ বণিতার মিছিল খবংপুজ্যা, কাশেম স’মিল, চেঙ্গী স্কোয়ার, নারাংহিয়া, রেড স্কোয়ার হয়ে স্বনির্ভরে এসে শেষ হয়। মিছিল শেষে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে শহীদ অমর বিকাশ চাকমাকে আন্দোলনের একজন মহান বীর হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। স্বনির্ভর থেকে কাশেম স’মিল পর্যন্ত সড়কটি তার নামে উসর্গ করার কথা ঘোষণা করা হয়। তিন সংগঠন শহীদের ‘সাপ্তাহিক ক্রিয়া’ সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেয়। সমাবেশ শেষে শহীদের প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শন করে দাহ করা হয়। 
(সূত্র: স্বাধিকার বুলেটিন নং-২, প্রকাশকাল: ২০ এপ্রিল ১৯৯৬)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন