রবিবার, ২ মার্চ, ২০১৪

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-সম্প্রীতির ঘুম পাড়ানি গান আর কতদিন?

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর এ যাবত যতগুলি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে নিরাপত্তার নামে নিয়োজিত বিশেষ কায়েমী স্বার্থবাদী মহলটি। মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুনর্বাসিত বাঙালিদের(যাদের সেটলার বলা হয়)। কায়েমী স্বার্থবাদী অংশটির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদেই এই সেটলাররা ঝাপিয়ে পড়ে পাহাড়িদের উপর। তারা পাহাড়িদের গ্রামকে গ্রাম পুড়ে ছাড়খার করে দেয়। সাজেক, খাগড়াছড়ি, শনখোলা পাড়া, তাইন্দং তারই উদাহরণ। অতি সম্প্রতি খাগড়াছড়ির কমলছড়ি ও বেতছড়িতে ঘটে যাওয়া হামলার ঘটনাও তার কোন ব্যতিক্রম ছিল না। যখন পাহাড়িদের উপর হামলা চলে তখন শান্তির দূতটি অশা্ন্তির কালো থাবা নিয়ে হাজির হয়। আর তখন শান্তি উধাও হয়ে যায় দূর থেকে অনেক দূরে। কিন্তু যখন পাহাড়িদের ঘরবাড়ি পুড়ে শেষ হয়ে যায়, যখন পাহাড়িরা রক্তাক্ত হয় তখন ঐ শান্তির দূতটি অট্টহাসি দিয়ে হাজির হয় শান্তি-সম্প্রীতি-উন্নয়নের শ্লোগান নিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস্তবতা এখন এটিই।

সবিতা চাকমাকে ধর্ষণের পর হত্যা, কমলছড়ি ও বেতছড়িতে পাহাড়ি গ্রামে হামলা অতঃপর ১৪৪ ধারা জারি; তারপর শান্তির দূতটি এসে হাজির হলো। সম্প্রীতির সমাবেশ করে কি সম্প্রীতি গড়ে তোলা যায়? যেখানে আমার মা, বোনকে ধর্ষণ হত্যা করা হয়, যখন আমার বাপ-ভাইয়ের ঘরবাড়ি পুড়ে দেয়া হয়, যখন আমার বাপ-ভাই, মা-বোন সেটলার হায়েনাদের হামলায় রক্তাক্ত হয়, তখন এই শান্তি-সম্প্রীতি সমাবেশের কোন মূল্য থাকতে পারে না। এই শান্তি সমাবেশ শেষে পাহাড়িরা হয়তো শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করবে, কিন্তু সেটলার হায়েনারা কি বুঝে শান্তির মর্ম? তারাতো ব্যবহৃত হয় বিশেষ একটি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অঙ্গুলি হেলনে। সেটলারদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে স্বার্থ আদায় করতে পারলেই এই গোষ্ঠীটি বিশেষভাবে লাভবান হয়ে ওঠে।

এভাবে শান্তি সমাবেশ, শান্তি মিছিল, সম্প্রীতির সমাবেশ'র নামে পাহাড়িরা আর কত প্রতারণার শিকার হবে? যারা শান্তি-সম্প্রীতি-উন্নয়নের কথা বলে মুখে ফেনা তুলছে আসল অশান্তির বীজতো তারাই রোপন করেছে। এই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে দিন দিন বড় হচ্ছে পাহাড়িদের ধ্বংস করতে। কিন্তু পাহাড়িরা এখনো বুঝতে পারছে না আগামীতে আমরা আরো কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবো। তাই তারা 'সহজ-সরল উপজাতি' সেজে সুরসুর করে হাজির হয় ওই শান্তি সমাবেশে, ওই শান্তি মিছিলে! আর এই 'উপজাতিদের' পেয়ে বেজায় খুশি হয় শান্তির প্রচারকারী গোষ্ঠীগুলো। সুন্দর সুন্দর কথা শুনিয়ে কান মলে দেয়া হয় 'উপজাতি'দের। পত্র-পত্রিকায় বড় বড় খবর হয় অমুক জায়গায় অমুকের উদ্যোগে শান্তি-সম্প্রীতির সমাবেশ। অথচ যখন হামলার ঘটনা ঘটে তখন এই শান্তি-সম্প্রীতির উদ্যোক্তারা হামলাকারীদের পেছনে পেছনে থেকে সহযোগিতা দেয়। আর পত্রপত্রিকায় এসব খবরগুলোর শিরোনাম হয়ে যায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ রূপে। ভাবতে বড়ই আশ্চর্য লাগে!

কমলছড়ি ও বেতছড়িতে পাহাড়িদের উপর হামলার পর গতকাল শনিবার(১ মার্চ) মহালছড়ি সেনা জোনের উদ্যোগে বিজিতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। অথচ, সবিতা চাকমাকে ধর্ষণের পর হত্যাকারীদের এখনো গ্রেফতার করা হয়নি, কমলছড়ি ও বেতছড়িতে পাহাড়িদের গ্রামে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাহলে, কিসের সম্প্রীতি সমাবেশ? পাহড়িদের উপর আর কোন হামলা হবে না, সবিতা চাকমার মতো আর কোন নারী হত্যার শিকার হবে না এই সমাবেশ কি তার গ্যারান্টি দিয়েছে? সবিতা চাকমার হত্যাকারী ও পাহাড়ি গ্রামে হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা হবে এ ধরনের কোন গ্যারান্টি কি এই সমাবেশ থেকে দেয়া হয়েছে? না, এ ধরনের কোন গ্যারান্টি এই সমাবেশ থেকে দেয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছে, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটছে (প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০১৪)।  কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে পাহাড়িদের উপর হামলা চালানো হচ্ছিল, তখন সেই আইন কেন প্রয়োগ করা হয়নি? আর কতদিন শান্তি-সম্প্রীতির নামে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখা হবে পাহাড়িদের?

পাহাড়িরা অবশ্যই শান্তি চায়। কিন্তু তা হতে হবে স্থায়ী। এই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যা যা করা দরকার, তাতেই বাধ সাধে এই শান্তি প্রচারকারীরা। কেন বাধ সাধে? কারণ তাদের কায়েমী স্বার্থ উদ্ধার হবে না তাই। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুনর্বাসিত বাঙালি সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে সমতলে ফিরিয়ে নেয়া হলে, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি আইনের স্বীকৃতি প্রদান করা হলে, সেনাবাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার সহ সেনা খবরদারি-নজরদারি বন্ধে 'অপারেশন উত্তরণ' নামক অঘোষিত সেনাশাসন তুলে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ অনেকটা সুগম হয়ে যায়। কিন্তু সরকার কি এ ধরনের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?

নিরন চাকমা
০২.০৩.২০১৪

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন